Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন কোথায়?

Icon

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন কোথায়?

ছবি: সংগৃহীত

যে কয়টি উদ্ধারহীন সমস্যায় এদেশের সাধারণ মানুষ যুগ যুগ ধরে কাতরাচ্ছে, এর একটি হলো দ্রব্যমূল্য। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, উৎসব লাগে না; এদেশে পান থেকে চুন খসলেই দামের গরুটা আকাশে চড়ে বসে। কারণ বা যুক্তি লাগে না, ঠুনকো ‘ছুতা’ বা অজুহাত পেলেই দামের পারদটা উপরে উঠে যায়। দেশীয় ব্যবসায়ী আর আড়তদাররা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, তারা ‘চাহিবামাত্র’ এখানে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ধরে যায়, তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট। তাদের ইশারায় যখন-তখন লাটে ওঠে মানুষের জীবন। তাদের অঙ্গুলিহেলনে দুই মুঠো ডাল-ভাত জোগাতেই মানুষের জান ‘যায় যায়’ অবস্থা হয়।

দামের পাগলা ঘোড়ার লাগাম যে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের হাতে, তা কেবল ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্ন সময় স্বীকারই করেননি, এ তথ্য সরকারি গবেষণাতেও উঠে এসেছে। চাল, আলু আর পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) বলেছে, ‘সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে চাল, আলু আর পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।’ বিএআরসি উপস্থাপিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকারের হাতে পর্যাপ্ত চালের মজুত ছিল না। তা ছিল মিলারদের হাতে। ফলে তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চাল ছাড়েনি। সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত চাল থাকত, তাহলে ওএমএসের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আলুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এটা তো সরকারের হাতে থাকে না। থাকে কোল্ডস্টোরেজ ও ব্যবসায়ীদের কাছে। বন্যার কারণে যখন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন আলুর ওপর চাপ পড়ে। আলুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন কোল্ডস্টোরেজ থেকে পর্যাপ্ত আলু বাজারে ছাড়া হয়নি। অথচ সাড়ে তিন লাখ টন উদ্বৃত্ত আলু আমাদের রয়েছে। এখানেও সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আলু বাজারে আনতে পারেনি। আর পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে। কিন্তু ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় বাজারে সংকট তৈরি হয়। তখন অন্য জায়গা থেকে দ্রুত আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।’

সাধারণ মানুষের জীবনধারণ ও বেঁচে থাকা যেন আজ কার্যত কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে। দুঃখের বিষয় হলো, তারপরও সরকার সাক্ষীগোপাল। পণ্যের দাম বাড়লেই আগের আওয়ামী সরকার বরাবরই কিছু ভাঙা রেকর্ড বাজাত। যেমন: বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, ইউক্রেন যুদ্ধ বা করোনা মহামারির প্রভাব ইত্যাদি। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভাঙা রেকর্ড একটাই-বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা ৯ অক্টোবর বলেছিলেন, ‘অধৈর্য হবেন না, দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ কিন্তু এ কথার প্রয়োগ কোথায়? বাস্তবতা হলো, ওই আশ্বাসের পরও সিংহভাগ পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিশেষত, ডিম ও সবজির বাজার। পর্যাপ্ত উৎপাদন ও মজুত থাকা সত্ত্বেও ডিম ও সবজির দাম রীতিমতো নতুন ইতিহাস গড়েছে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য তাত্ত্বিকভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল, খাদ্য অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ সরকারের একাধিক বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা যে লাউ, সেই কদু। মাঝেমধ্যে বাজার পরিদর্শন, শহরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক কিছু অভিযান-জরিমানার নামই কি বাজার ব্যবস্থাপনা? কিছু বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা টানিয়ে দেওয়ার নামই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ?

লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাজারে অতিরিক্ত মুনাফাকারী, অননুমোদিত পরিমাণে পণ্য গুদামজাতকারী, অবৈধ আড়তদার, সংগঠিত সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত যারা নানা উপায়ে পণ্যের দাম অস্থিতিশীল করে, তাদের প্রতিরোধে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন-পুরোনো আধা ডজনেরও বেশি আইন রয়েছে। পুরোনো আইনগুলোর মধ্যে The Essential Articles (Price Control and Anti-Hoarding) Act, 1953; The Control of Essential Commodities Act, 1956, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৮১, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১ অন্যতম। কিন্তু এসব আইন এখন অনেকটাই ‘কাগুজে বাঘ’। নতুন আইনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২০ অন্যতম। অনেক বড় আশা ও স্বপ্নের সাইরেন বাজিয়ে আইনগুলোর জন্ম হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক আইনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ছিল দেশব্যাপী। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আইনগুলোর প্রয়োগ যেমন সীমিত, তেমনই গড়ে ওঠেনি নেটওয়ার্ক বা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োগকারী সংস্থা। তবে জনবল কম, আছে সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন। ভাবতে অবাক লাগে, দ্রব্যমূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণে এত আইন থাকার পরও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যে পুরো দেশে যুগ যুগ ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে অরাজকতা চলছে, মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে, যা খুবই হতাশাজনক।

সরকার পরিবর্তনের পর সবার আশা ছিল, আর কিছু হোক না হোক, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামটা অন্তত কমবে। কিন্তু ঘটল উলটো ঘটনা-দ্রব্যমূল্য আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। এজন্য আইন উপদেষ্টা ক্ষমাও চেয়েছেন। বস্তুত জীবনের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে এর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। জীবনধারণের অধিকারের সঙ্গে জীবনের অপরিহার্য মৌলিক চাহিদা (খাদ্য) পূরণের অধিকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সংবিধানের রক্ষক হিসাবে সরকার মানুষের ‘জীবনে’র নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য। ওই হিসাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় অপরিহার্য খাদ্যপণ্যের দাম (যেমন: চাল, ডাল, তেল, ডিম, সবজি, আলু ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য) নিয়ন্ত্রণেও সরকার সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।

আমরা বিশ্বাস করি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল লোকজন নিজেদের দায়িত্ব ও আইনগত বাধ্যবাধকতা বুঝতে সক্ষম। আশা করি, সরকার দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম স্থায়ীভাবে টেনে অসহায় জনগণকে বাঁচার সুযোগ দেবে এবং তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। জনগণের জন্য এটিই হবে এ মুহূর্তের সবচেয়ে কার্যকর ও অর্থবহ ‘সংস্কার’।

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : প্রাবন্ধিক; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

aftabragib2@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম