Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজার, দ্রব্যমূল্য : কার দায় কতটা

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজার, দ্রব্যমূল্য : কার দায় কতটা

অর্থনীতি-বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর আলোকে দ্রব্যমূল্য স্থির হওয়ার যেসব উপাদান ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে আমাদের বাজারে বা বাজারব্যবস্থায়, এর বাইরেও বহু অনানুষ্ঠানিক, অবৈধ, অদৃশ্য উপাদান বিদ্যমান। সেগুলো চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ বা সংশোধন করা খুবই দুরূহ। আমাদের ব্যবস্থায় অবৈধ, অদৃশ্য কার্যক্রম চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অনেক সময়ই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। এমনকি বাজারব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে। যেমন: চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে চাল, চিনি ও সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে ১/১১-এর সরকারকে ভীষণ বেকায়দায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বিডিআর দিয়ে পণ্য বিক্রি করেও তা সামাল দেওয়া যায়নি।

আমাদের কাঁচাবাজারের দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হওয়ার অনানুষ্ঠানিক ও অদৃশ্য কারসাজি সম্পর্কে একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ উল্লেখ করতে চাচ্ছি। একটু সস্তায় খাবার জোগাড় করার জন্য রাজধানীর বহু বাজারে হাঁটাহাঁটি করেছি। লোকমুখে যে বাজারে সস্তায় পাওয়ার কথা শুনেছি, অন্তত তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সেসব বাজারে গিয়েছি। অনেক সময় হেঁটে গিয়ে বাজার শেষে রিকশায় এসেছি। বাজার কম থাকলে হেঁটেও ফিরেছি। বহু বছর ধরে শুক্রবার সকালে বেইলি রোডের ভ্যান থেকে বা রাস্তার পাশে বসা মুরগিওয়ালার কাছ থেকে সাপ্তাহিক বাজার করি। উদ্দেশ্য দুটি-শান্তিনগরের স্থায়ী কাঁচাবাজার থেকে গড়পড়তা দামে ১০ শতাংশ সস্তা হয় এবং ভ্যানওয়ালারা দিনেরটা দিনে বেচা শেষ করে বলে কিছুটা তাজা শাকসবজি পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে দাম নিয়ে ভ্যানওয়ালা বা মুরগিওয়ালার সঙ্গে তর্কবিতর্কও হয়েছে। বর্তমানে যে ঘটনাটি বলব, তা বছর দুই আগের। একদিন এক ভ্যানওয়ালাকে একটু কড়াভাবে বললে সে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘আমরা কী করব, আমরা সবদিকেই মাইরের মধ্যে আছি।’ ওর ভাষ্যে আমরাই নাকি সমাজটাকে এরকম করে ফেলেছি। সেদিন আমি একটু দেরি করে গিয়েছিলাম। বাজারের সময়ের শেষভাগ, তাই তেমন ক্রেতার ভিড় ছিল না। তরকারিওয়ালা বলল, সে গড়পড়তা ৫-৬ হাজার টাকার পণ্য নিয়ে আসে। বেইলি রোডে সকাল ৯টা পর্যন্ত বসার জন্য তিনটি খাতে তাদের ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই তিনটি খাতের নামের প্রতিও সে ইঙ্গিত করেছে। আমি আর সে ইঙ্গিত দিচ্ছি না। পরে আমি অনতিদূরে দাঁড়িয়ে লেনদেনের ওই দৃশ্যও দুয়েকবার দেখেছি। ফলে এক্ষেত্রে ভ্যানওয়ালা পাইকারি বাজার থেকে যে মূল্যে পণ্য সংগ্রহ করেছে, তার সঙ্গে ৬ থেকে ৭ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়ে যায়। এরপরে ভ্যানওয়ালার মজুরি, মূলধনি খরচ, ব্যবসার ঝুঁকির বিচারে তাকে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ লাভ করতেই হবে। অর্থাৎ ৫ হাজার টাকার পণ্য ক্রয় করলে তাকে ১২৫০ টাকা লাভ করতে হবে। তার লাভ ও মজুরির ১২৫০ টাকা এবং অদৃশ্য খাজনা ৪০০ টাকা; অর্থাৎ ১৬৫০ টাকা যুক্ত করে তার প্রতি ৫০০০ টাকায় ক্রয়কৃত পণ্যের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৬৬৫০ টাকায়। অর্থাৎ পাইকারি বাজারের ক্রয়মূল্যের চেয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পায় খুচরা বাজারে।

আমাদের কাঁচা তরকারির বাজারব্যবস্থার সাপ্লাই চেইনে পাইকারি বাজার একটি অদ্ভুত ব্যাপার। এখানেও কোনো সূত্রের ভিত্তিতে অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। পাইকারি বাজারে যে পণ্য আসে, তার পাইকারি মূল্য নির্ধারণের যেসব স্বাভাবিক সূত্র রয়েছে, তার বাইরে বহু অস্বাভাবিক বিষয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। আমাদের সাপ্লাই চেইনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলো, নানা কারণে এ শৃঙ্খলটি অনেক দীর্ঘ ও সরু। দীর্ঘ হওয়ার কারণে উৎস প্রান্তে যে মূল্যে পণ্য সংগ্রহ হয়, তারপর বহু স্বাভাবিক কারণে প্রতি কিলোমিটার পথে মূল্য সংযোজন হতে থাকে। এর সঙ্গে রয়েছে, দেশের সীমানার মধ্যে হলে প্রতিটি প্রশাসনিক সীমানায় অন্তত দুই খাতে অস্বাভাবিক অদৃশ্য খাজনা পরিশোধ করতে হয় (এখানে খাজনা শব্দটি অর্থনীতির ভাষা থেকে ব্যবহার করেছি। আমাদের ঘাটে ঘাটে যে অদৃশ্য খাতে চাঁদা দিতে হয়, তা বোঝাতে অদৃশ্য খাজনা ব্যবহার করেছি)। ধরুন, যশোরের অভয়নগর বা রাজশাহীর বাঘা উপজেলা থেকে এক কেজি মাছ ঢাকা শহরে পৌঁছাতে নিয়মানুযায়ী খরচ এবং অনিয়মিত খরচ মিলে কত মূল্য স্থির হচ্ছে, তার কোনো গবেষণা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা অথবা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের আছে? আমাদের ভোক্তা পর্যায়ে আমরা কজন জানি ডিম, সয়াবিন তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, এমনকি কাঁচা মরিচ কোন কোন দেশ থেকে আসে? কীভাবে আসে? বিদেশের পণ্যসামগ্রী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সঙ্গে অদৃশ্য খাজনা কত যোগ হয়, এ সম্পর্কে খাতক বা ভোক্তা পর্যায়ে আমার কোনো জ্ঞান নেই। তা অবশ্যই আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। যা হোক, এ প্রলম্বিত সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে স্বাভাবিক-নিয়মিত এবং অস্বাভাবিক-অনিয়মিত খরচ যুক্ত হয়ে পাইকারি বাজারে একটি মূল্য নির্ধারিত হয়। আমাদের এ পাইকারি বাজারে ঘটে সব অদৃশ্য হাতবদলের ভূতুড়ে কারবার। কৃষক পর্যায়ের সংগ্রহমূল্য পাইকারি বাজারে এসে ২ থেকে ২১২ গুণ মূল্যে উন্নীত হয়। কিন্তু কেউ জানে না কোন ভূতে এ মূল্য নির্ধারণ করে এবং কীভাবে এসব হয়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এ মূল্যের বড় উল্লম্ফন কাজ করে, তখন চারদিকে হইচই পড়ে যায়। এ দীর্ঘ ও সরু সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট। সাপ্লাই চেইনটি সরু হওয়ার কারণে এ সিন্ডিকেটগুলো সহজেই মুরগির গলা টিপে ধরতে পারে। সরকার ব্যবস্থা নিতে নিতে সিন্ডিকেট তাদের ফায়দার মাখন চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। এমনকি এরা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে যে কোনো সরকারকে যে কোনো সময়ে চরম বেকায়দায় ফেলতে পারে।

অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, বাজারব্যবস্থার অদৃশ্য হাত আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে, কাঙ্ক্ষিত দামে কাঙ্ক্ষিত পণ্য পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্র্থাৎ বাজারব্যবস্থা কার্যকর দক্ষতায় সব উৎপাদক, ব্যবসায়ী, ভোক্তা-সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থায় কিছু অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে ভোক্তা ও সরকার সবসময়ই ‘আউয়া’ বনে যায়। ‘আউয়া’ সিলেটের আঞ্চলিক শব্দ। বাজার তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় কাজ করতে পারে না, বহিরাগত অদৃশ্য হাতের সাফাই চলে এখানে। এ মুহূর্তে সরকার বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কাঁচামাল, পণ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্রির মাধ্যমে সাপ্লাই চেইনের বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করছে। এটি কার্যকর হলে হয়তো মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল হবে।

এরপর দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া, প্রাকৃতিক উপায়ে তেমন কোনো উৎপাদন নেই বললেই চলে, যা মূল্যবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি দিকে আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো উৎপাদন এলাকার পরিসর। যেমন ধরুন আমরা শৈশব-কৈশোর দেখেছি গ্রামগঞ্জে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মৌসুমি শাকসবজি উৎপাদন হতো। শীতের দিনে খেজুরের রস-গুড়, সরিষা, তিল, তিশি, বিভিন্ন ধরনের ডাল প্রভৃতি। এসবের উৎপাদন এখন প্রায় বন্ধ। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও এখন মালয়েশিয়া বা তুরস্ক থেকে আমদানি করা সয়াবিন তেল, চীন থেকে আমদানি করা আদা-রসুন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা বিটের চিনি ব্যবহার করে। আমাদের যে বিস্তীর্ণ উৎপাদনক্ষেত্র ছিল, তা সংকুচিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। ফলে উৎপাদন উৎসগুলো সংকুচিত হয়ে যেমন আমাদের সাপ্লাই চেইন দীর্ঘ ও সরু করে ফেলেছে, তেমনই বিকল্প দ্রব্যের উৎপাদন সংকুচিত হয়ে বিলীন হওয়ার পথে। গ্রামের মোটামুটি সচ্ছল পরিবারগুলো কয়েক হাঁড়ি খেজুরের গুড়, ২/৪ মন ডাল, ২/৩ মন সরিষা, তিল ইত্যাদি উৎপাদন করত, যা বাজার সরবরাহ বৃদ্ধিতে বা স্থানীয় চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বিকল্প পণ্যগুলো বিলুপ্ত হওয়ায় এরাও এসে ক্রেতার কাতারে যোগ দিয়েছে। ফলে ক্রেতা বেশি, চাহিদা বেশি, দামও বেশি। বিকল্প সামগ্রী নেই একচেটিয়া পণ্যবাজার সয়াবিন তেলের। দেশের চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ, আখের উৎপাদনে লোকসান। আমদানিনির্ভর চিনির বাজারে হঠাৎ হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি। এরকম কাঁচামালের বাজারসহ সর্বত্রই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। ভোক্তার আচরণে নানা অসংলগ্নতা। ফাস্টফুড বা চীনাজাতীয় রেস্টুরেন্টে রান্নার পদ্ধতির কারণে চিনির ব্যবহার বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পর্যায়ে আরও একটি দিক রয়েছে, তা হলো উৎপাদন পদ্ধতি। এখন আর প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কোনো উৎপাদন নেই বললেই চলে। সবকিছুই কৃত্রিম পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে হয়। কেউ কেউ কৃত্রিম একটি পদ্ধতিকে ‘অর্গানিক’ নাম দিয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতির আবহ সৃষ্টি করে উৎপাদিত পণ্যের আরও উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে।

সাধারণভাবে আমাদের শৈশব-কৈশোরেও কিছু শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেখতাম সময়মতো বীজ বোনা হয়েছে, অঙ্কুরোদগম হয়েছে, হয়তো একবার বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি হলে দুবার নিড়ানি দেওয়া হয়েছে, ফসল ঘরে তোলা হয়েছে। এখন আর সেভাবে সহজ পদ্ধতিতে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় বীজের অঙ্কুরোদগমই হচ্ছে না। কোনোভাবে অঙ্কুরোদগম হলেও ফসল বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রচুর কীটনাশক, কৃত্রিম সার ব্যবহার করতে হবেই। তার ওপরে মাঝেমধ্যে বিশেষভাবে ভিটামিন থেরাপিও দিতে হয়। অতঃপর ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হবে। প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে এর বিস্তারিত ও পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। এরূপ উৎপাদন ব্যবস্থার বিশেষীকরণ বা কৃত্রিমায়ন করার ফলেও উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি উৎপাদনক্ষেত্রের পরিসর সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কাজেই কৃষি উৎপাদনেরও বড় একটা অংশ কতিপয়ের হাতে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির ওপর তাদের প্রভূত প্রভাব পড়েছে। গ্রামের দেশি মুরগি আর ডিম পাড়তেই চায় না। তারা শুধু খেতে আর ঘুরতে চায়। আমার এ রূপক কথাটির যথার্থতা খুঁজে পেলাম ১২ অক্টোবর যুগান্তরে প্রকাশিত ড. আর এম দেবনাথের কলামে। ডিম পাড়ার দায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরের ফার্মের মুরগির। আর তারাও যদি পর্যাপ্ত ডিম সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে ভারত বা ভিয়েতনামের মুরগির ওপর দায়িত্ব পড়ে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধির। আর তারাও সুযোগের সুযোগ নেয়। ফলাফল মূল্যবৃদ্ধি। গ্রামীণ জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন উৎপাদনবিমুখ, জনতা দুটি খালি হাত নিয়ে বাজারে যায় ক্রেতা হিসাবে। ফলে বহুমাত্রিক উৎস থেকে সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সেসব এলাকার চাহিদা মেটানোর ভার পড়েছে সংকুচিত উৎপাদন এলাকায়। ফলাফল দীর্ঘ ও সরু সরবরাহ ব্যবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির বারুদে আগুন।

যা হোক, লেখা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আমি আরও দু-একটি কথা বলে শেষ করতে চাই। আমাদের সার্বিক জাতীয় উৎপাদনব্যবস্থায় এবং ভোক্তার আচরণে যে ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে, তা আমাদের পুরো বাজারব্যবস্থার কার্যকারিতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে। এর ওপর রয়েছে গত ১৫ বছরের অপশাসনের কুশীলবের অকৃতি। গত ১০ অক্টোবর যুগান্তরে প্রকাশিত ‘আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর : অর্থনীতির সূচকে লুকোচুরি’ প্রতিবেদনটি উল্লেখযোগ্য। বিগত শাসনকালে একটি বায়বীয় অর্থনীতি তৈরি করা হয়েছিল। পেটের মধ্যে অধিক পরিমাণে গ্যাস জমা হলে আমাদের যেমন ভীষণ পেটের ব্যথায় ভুগতে হয়, তেমনই হয়েছে। আগস্ট বিপ্লবে সরকার পতনে ওই ফাঁপা অর্থনীতির ধাক্কাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু অর্থনীতিতে সে দূষণ তো পুরোপুরি নিঃসরণ হয়নি। কাজেই দুষ্টচক্রের সামষ্টিক অর্থনীতির কুফল থেকে মুক্ত হতে আরও সময় প্রয়োজন। এর ওপর যুক্ত হয়েছে ‘বাহুবলী’ সিনেমার দৃশ্যের যুদ্ধ কৌশলের দানবীয় ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা; যা একটা বিস্তীর্ণ উৎপাদন অঞ্চলকে ধুয়েমুছে সাফ করে নিয়ে গেছে। এর কিছুদিন আগে সিলেটের ফ্লাশ ফ্লাড। বর্তমানে বন্যা চলছে ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলে। কৃষিপণ্যের সরবরাহের উৎসে একটি বড় ধস বা ক্ষতি হয়ে গেছে। তা পুনঃস্থাপনে ছয় মাস থেকে এক বছর লাগবে। কাজেই আমরা যতই শোরগোল করি, শতভাগ আন্তরিকতা থাকলেও সরকার এখনই সব ফ্যাক্টরকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারবে না।

যা হোক, শেষ কথায় একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করি। স্পেনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাস্তায় ধবধবে চোখ ধাঁধানো কাপড়-চোপড় পরা লোকজন দেখা যেত না। প্রায় সবারই মলিন সাধারণ পোশাক। কারণ চারটি : ১. বিপ্লব হলেই সাধারণ মানুষের আর্থিক বা ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি হয় না। সে চাইলেই ধনীর মতো সবকিছু কিনতে পারবে এমনটি হয় না; ২. আয় কিছুটা সমতাভিত্তিক হওয়ায় ব্যক্তি দারিদ্র্য কমলেও সামষ্টিক দারিদ্র্য বেড়ে যায়; ৩. ধনীরা তাদের কাপড়-চোপড়, গাড়ি-ঘোড়া লুকিয়ে রাখে, পারলে অনেক দিনের পুরোনো কাপড়-চোপড় বা বাজার থেকে কম দামের কাপড়-চোপড় কিনে তা পরে রাস্তায় বের হয় এবং ৪. বিপ্লবের ফলে হঠাৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। কারণ যা-ই হোক, বিপ্লব-পরবর্তী সবকিছু ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লেগে যায়, যা বিশ্বের সব বিপ্লবের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তাই আমাদের কিছুটা সংযমী হতে হবে। ‘আগেই ভালো ছিল’-এ বয়ান এখনই চাউর হলে সরকার নিজেকে দুর্বলবোধ করবে আর ষড়যন্ত্রকারীরা এর সুযোগ নেবে। আমাদের শোরগোল অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে সরকার ঘুমিয়ে না পড়ে। আবার তা এত বাড়াবাড়িও করা যাবে না, যাতে সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।

উফশী জাতের একটা ধানের ফলনে অন্তত ৯০ দিন সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষুধা লাগে দিনে অন্তত তিনবার। তাই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। এর মধ্যে দৃশ্যমান, অদৃশ্য বহু শক্তি ক্রিয়াশীল। বর্তমানে বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯০ দিনও হয়নি। তারা যে বীজ বুনেছেন, তা কোন জাতের তা আমার জানা নেই। তা যদি উফশী জাতেরও হয়, ফসল কাটার সময় মনে হয় এখনো হয়নি। সবাইকে এটুকু বুঝতে হবে। তাদের গালমন্দ করার আগে একটু ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত। তাদের সতর্ক করতে হবে এবং তাদের ব্যাপারে আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তাদের বড় কোনো ভুল হতে না পারে। আমাদেরও যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় কাজ করতে হবে, ‘না হইলে সকলেরই ডুগডুগি বাজিয়া যাইবে।’

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম