নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ করুন
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কোনো কোনো অমানবিক আচরণ মানবতা ও শান্তির ধর্ম ইসলামকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সামনে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে। ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে ইসলাম ধর্মকে গভীরভাবে না জানা বক্তাদের দায় যেমন রয়েছে, তেমনইভাবে দায় রয়েছে নানা মতাদর্শে বিভক্ত আলেম এবং রাজনৈতিকভাবে সুবিধা লাভ করার মানসিকতায় থাকা জ্ঞানপাপীদের। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরুর পর্যায়ে কেন যে ধর্মীয় উগ্রপন্থি কোনো কোনো গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। স্বৈরাচারের নানা আবর্জনা সরাতে ব্যস্ত থাকায় এবং সম্ভবত জরুরি অনেক বিষয়ে সরকারের তেমন প্রতিক্রিয়া না থাকায় মনে হচ্ছে, এখন যেন সব পক্ষ ওয়াকওভার পেয়ে গেছে। অনেক বেশি স্বাধীন হয়ে গেছে যেন সবাই। এরই একটি কুৎসিত প্রতিফলন ঘটেছে। কিছুসংখ্যক ধর্ম বিষয়ে মূর্খ মানুষ দেশের নানা অংশে সুফিসাধকদের মাজারে হামলা করে ভাঙচুর করছে। অবস্থা বিচারে মনে হচ্ছে, এরা সব আইনের ঊর্ধ্বে। এসব হিংসা ছড়ানো মানুষ কি জানে, আজ যাদের মাজার ভাঙচুর করা হচ্ছে, এ ধারার সুফিসাধকদের প্রচার করা ইসলামের শান্তি ও মানবপ্রেমের বাণীই আকৃষ্ট করেছিল সাধারণ মানুষকে। এদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল সুফিদের হাত ধরেই। মানুষের মধ্যে সুফিদের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই উনিশ শতকে ওয়াহাবি ভাবধারার হাজি শরিয়তউল্লাহর অনুসারী ফরায়েজিরা মাজার ভাঙচুর করলেও জনসমর্থনের অভাবে এ আন্দোলন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এ কারণেই শরিয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে পির মুহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া এ আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন।
আমাদের সমাজ কতটা আধুনিকমনস্ক হয়েছে, আমি ঠিক বলতে পারব না। কোনো সমাজবিজ্ঞানী এ ধরনের কোনো গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে এটি ঠিক, আমাদের সমাজে এখনো মসজিদের ইমামদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে আমার মনে হয়, যদি অনেক ইমাম প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা এবং আল কুরআনের তাফসির ও সহি হাদিস উপলব্ধি করতে পারতেন এবং নানা তরিকাভুক্তির অন্ধত্বে নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে না তুলতেন, তাহলে ইসলাম ও মুসলমানের যেমন উপকার হতো, তেমনই সমাজজীবনের নানা সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। আর এর উলটোটা যদি হয়, কোনো ইমাম জুমার দিন কুরআন-হাদিসের বর্ণনার সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনের অক্ষমতার কারণে অথবা নিজস্ব রাজনৈতিক বা তরিকার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিকৃত ব্যাখ্যায় মুসল্লিদের উত্তেজিত করে সামাজিক সংহতি বিনষ্টে ভূমিকা রাখেন, তাহলে তা ভয়ানক অকল্যাণ ডেকে আনতে বাধ্য। যদি এদেশের সিংহভাগ মুসলমান গভীরভাবে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতেন, তাহলে আশঙ্কার কারণ হতো না।
জ্ঞানচর্চার নানা অগ্রগতির কারণে এখন ইসলামি চিন্তাবিদ, মুফতি, আলেমদের ওয়াজ বা জুমার দিন মসজিদে তাদের বয়ান শুনে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অনেকটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু কোনো কোনো মসজিদে ইমাম ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানদানকারীদের জানার সীমাবদ্ধতা ও সুবিধাবাদী চিন্তার কারণে এবং নানা সংকটে মানুষ যেমন ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী খুঁজে পায় না, তেমনই সমাজে হিংসাবিদ্বেষও ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুর্গাপূজার মণ্ডপে ইসলামি দলসমর্থিত কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান গাইতে ওঠে। তাদের গাওয়া দুটি গানের একটি ইসলামি ভাবাদর্শের গান। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু জনগোষ্ঠীসহ সব বিবেকবান মানুষকে এ ঘটনা আহত করেছে। এ ছেলেগুলো কি বুঝতে পারেনি, একটি ইসলামি জলসায় যদি হিন্দু গায়ক দল কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কীর্তন গায়, তাহলে ধার্মিক মুসলমান যেমন আহত হবেন, একই রকমভাবে তারা আহত করেছে হিন্দু প্রতিবেশীকে? অবশ্য প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
বছর তিনেক আগের কথা। কেরানীগঞ্জের এক মসজিদে জুমার বয়ান শুনে বুঝতে পারলাম কীভাবে ভুল ব্যাখ্যায় সাধারণ মুসল্লিদের উত্তেজিত করে কেউ কেউ সামাজিক সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। এর বেশ কিছুদিন আগে ভোলায় ফেসবুকে একটি আরোপিত পোস্ট ভাইরাল করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ মুসলমানদের উত্তেজিত করে অনেক হিন্দু বাড়িঘর ভাঙা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। পরে স্পষ্ট হয় কোনো কুচক্রী মহল নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য হিন্দু ছেলের নাম ব্যবহার করে মহানবিকে (সা.) অবমাননা করে বক্তব্য রেখেছিল। ‘কান চিলে নিয়েছে’ শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল মানুষ। পরে কানে হাত দিয়ে দেখে কান যথাস্থানে রয়েছে। এরপর উত্তেজনা প্রশমিত হয়। সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও সাধারণ মানুষকে অন্ধ বানিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর খায়েস মেটেনি কেরানীগঞ্জের ওই ইমাম সাহেবের। তিনি মহানবি (সা.)-কে অপমান করার দায়ে বদলা নেওয়ার জন্য জেহাদি বক্তব্য দিচ্ছিলেন মুসল্লিদের উদ্দেশে। মুসল্লিদের অনেককে উত্তেজিতও করতে পেরেছিলেন। শোরগোলে মনে হচ্ছিল, তারা এখনই ভোলার ঘটনার দায়ে কেরানীগঞ্জের অমুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন!
কোনো কোনো মসজিদে শুক্রবারের বয়ানে প্রকৃত খুতবা খুঁজে পাওয়া যায় না। খুতবা শব্দটির প্রকৃত অর্থ ভাষণ বা বক্তৃতা। খুতবার তাৎপর্য হচ্ছে, শুক্রবার জুমার নামাজের জমায়েতে সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুসল্লিদের সামনে ইসলামের আলোকে বয়ান করা। সবাইকে সচেতন করে তুলবেন ইমাম সাহেব। কিন্তু প্রকৃত অর্থে অনেক মসজিদে একটি বিধিবদ্ধ খুতবার কিতাব থেকে তা পড়া হয়। প্রায় শতভাগ মুসল্লি আরবির অর্থ বোঝেন না। তাছাড়া একটি বহু আগের ছাপানো কিতাব তো আর সমসাময়িক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা হয় না। ফলে ইমাম সাহেব তোতা পাখির মতো পড়ে যান আর মুসল্লিরা কিছু না বুঝেই ভক্তি সহযোগে শুনতে থাকেন। নামাজ পড়তে আরবি সুরা পড়া বাধ্যতামূলক হলেও খুতবার বক্তৃতা আরবিতে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই যে ভাষায় মানুষের কাছে বক্তৃতা পৌঁছবে না, তেমন বক্তব্য কি অর্থহীন হয়ে যায় না? অবশ্য এখন কোনো কোনো মসজিদে শিক্ষিত খতিবরা আরবি খুতবার সারমর্মটি আগে বাংলায় বলে নেন। তবুও তা মন্দের ভালো।
আমি একবার কলকাতার খিদিরপুরের এক মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। সেখানে মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে উর্দু ভাষা বেশি ব্যবহার করেন। তাই ইমাম সাহেব উর্দুতেই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বয়ান করলেন। কোনো নির্দিষ্ট খুতবার বই পড়লেন না বা আরবিতে মুখস্থ আওড়ালেন না। আরেকবার পূর্ব-লন্ডনের কেন্দ্রীয় মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছিলাম। সেদিন মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সৌদি আরবের একজন সুশিক্ষিত ইমাম অতিথি হিসাবে এসেছিলেন জুমার নামাজ পড়াতে। আমি বিমোহিত হয়েছিলাম তার বয়ান শুনে। বিশাল মসজিদের নানা স্থানে স্ক্রিন রয়েছে। তাতে ইমাম সাহেবের বয়ান এবং পাশাপাশি ইশারা ভাষায় অনুবাদ দেখা ও শোনার ব্যবস্থা ছিল। ইমাম সাহেব উদ্ধৃতি হিসাবে আরবি ভাষায় দু-একবার কুরআন শরিফের আয়াত ব্যবহার ছাড়া পুরোটাই ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেন। আর বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নিলেন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। ইসলামের দৃষ্টিতে তা ব্যাখ্যা করে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে মুসল্লিদের উদ্বুদ্ধ করলেন। আমার মনে হলো, আজ আমি প্রকৃত অর্থে খুতবা শুনলাম।
আমার দৃষ্টি যায় বাংলার ইতিহাসের দিকে। প্রাচীন বাংলায় এদেশ ছিল বৌদ্ধ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেশ। ইসলাম বিস্তার প্রধানত ঘটতে থাকে মধ্যযুগের সূচনালগ্ন থেকে। তবে আট শতকে নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে কোনো কোনো আরব মুসলিম বণিক স্থানীয় নারী বিয়ে করে ইসলামের প্রথম পদচিহ্ন এঁকেছিলেন। এরপর এগারো শতক থেকে তেরো শতকের মধ্যে কোনো কোনো সুফিসাধক ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এদেশে আসেন। তবে এদেশের শাসনদণ্ড বহিরাগত মুসলমান শাসকদের হাতে তেরো শতকে চলে যাওয়ার পর সুফিসাধকদের ভূমিকায় ইসলাম বিস্তারের ধারা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিপরীতে সুফিদের প্রচারে ছিল মানবিকতার আবেদন। সুফিদের আল্লাহপ্রেম ও মানবপ্রেমের বাণী আলোড়িত করেছিল এদেশের সাধারণ হিন্দুদের। সুফিরা ইসলামকে একটি মানবিক ও শান্তির ধর্ম হিসাবেই উপস্থাপন করেছিলেন। নিজ ধর্মে ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের দ্বারা নিগ্রহের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেক শূদ্র হিন্দু সুফিদের খানকায় আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ বলা যায়, অপেক্ষাকৃত ভালো আশ্রয়ের জন্য মানুষ ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে।
অথচ আজ ইসলামের রক্ষক বলে যারা নিজেদের মনে করেন, তাদের অনেকে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারছেন না। এর বদলে ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংসা ছড়াচ্ছেন। আবদ্ধ বুদ্ধির ভেতর নিজেদের আটকে রেখেছেন। তাদের বয়ান ও আচরণকে ইসলাম কতটুকু সমর্থন করছে, তা নিয়েও একবার ভাবছেন না। একশ্রেণির মানুষের জেহাদি বয়ান শুনলে পবিত্র বোখারি শরিফের ৬৮৩৬ নং হাদিসের বক্তব্য আমার সামনে চলে আসে। হাদিসটি ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি নবি করিম (সা.)-কে ফজরের নামাজে রুকু থেকে মাথা ওঠানোর সময় বলতে শুনেছেন, ‘হে আমাদের রব! সব প্রশংসাই আপনার জন্য নিবেদিত। তিনি আরও বললেন, হে আল্লাহ! আপনি অমুকের অমুকের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করুন।’ তারপর এ আয়াত নাজিল হয়, ‘(হে নবি) চূড়ান্তভাবে কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বা এখতিয়ার আপনার হাতে নেই, (বরং এটি) আল্লাহরই এখতিয়ারে রয়েছে। তিনি চাইলে তাদের ক্ষমা করবেন, আর চাইলে তাদের শাস্তি দেবেন।’ অথচ আমাদের একশ্রেণির মানুষ নিজেরাই অন্যদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির বিধান দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে সমাজে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তাদের বিধ্বংসী ফতোয়া আমার কাছে ‘শিরক’ পর্যায়ের মনে হয়। কারণ মানুষের যে ভালোমন্দের বিচার আল্লাহ করবেন, সে দায়িত্ব আমরা নিয়ে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি?
এমন সব আচরণ সমাজের সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই সরকারপক্ষের কাছে নিবেদন থাকবে, সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ করতে অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে প্রয়োজনে কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com