Logo
Logo
×

বাতায়ন

যেভাবে সম্ভব ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

Icon

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যেভাবে সম্ভব ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব বিস্তার লাভ করেছে শহর থেকে গ্রামে। বিশেষ মৌসুমের গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে সারা বছরই। তাই ডেঙ্গুরোগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব ও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দায়িত্বের পরিধি মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর হয়ে ইউনিট থেকে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তাই সব অংশীজনই এর অন্তর্ভুক্ত। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে এ কাজে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব নিরূপণ, তার প্রজননস্থল চিহ্নিত ও ধ্বংস করার দায়িত্ব প্রথমত আমাদের নিজেদের। নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রবল সদিচ্ছা থাকতে হবে। নিজেকে সচেতন নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের প্রত্যেক দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে শুধুই সরকারি প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, সম্পৃক্ত করতে হবে নিজের নাগরিক দায়িত্ব পালনে। তাদের শুধু একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যেই ঘুরপাক খেলে চলবে না, নিজেদের মধ্যে শুভবুদ্ধি ও ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার সেবাপ্রার্থীর অনুপাতে সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই নিজের কাজে মনোযোগ দিতে হবে।

দেশে বিষয়ভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার পরিসর বেড়ে চলেছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং যোগ্য ব্যক্তিদের যথাস্থানে নিয়োগ প্রদান দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো ইকুইটি বা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে অবশ্যই দক্ষ ও নির্মোহ জনবল থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সে আলোকে স্বাস্থ্য একটি অন্যতম মৌলিক চাহিদা। এ খাতে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তির সংখ্যা ও দক্ষতা পূরণ ও তা নিশ্চিত করা জরুরি। যেমন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ধরনের জনবল প্রয়োজন। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন মশকনিধন কর্মী, বিশেষজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ, দক্ষ প্রশাসক ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। আরও স্পষ্ট করে বলতে হয়, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নির্বিঘ্নে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট জনবলের মধ্যে সমন্বয় সাধন জরুরি। তাই দক্ষ জনবলের সংখ্যা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ইউনিটের সংশ্লিষ্টতায় মশকনিধন কর্মীর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। একইভাবে প্রান্তিক এলাকায় ফারমার্স ফিল্ড স্কুল বা এফএফএসের সমন্বকারী কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা জরুরি। পরিবেশসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা জরুরি।

এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস এবং সবুজ ও প্রশান্তিময় পরিবেশ গড়ে তোলা ডেঙ্গু দমনের পূবশর্ত। আমাদের মাথায় ভর করে আছে, শুধু কীটনাশক প্রয়োগেই মশা ধ্বংস করা যায়। আর এ দায়িত্ব শুধু সিটি করপোরেশনের। এ ভুল চিন্তাভাবনার কারণে ডেঙ্গু আজ দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। কেড়ে নিচ্ছে অতি মূল্যবান মানুষের জীবন। সময় এসেছে সংশোধনের। সময় এসেছে সচেতনতার পাশাপাশি সময়ের বিবর্তনে স্বাস্থ্য খাতকে সমন্বিত করার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি ইউনিটে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কীটতত্ত্ববিদ এবং অ্যান্টোমো-টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ ও কর্মপরিবেশ সৃষ্ট করার। এক তথ্যমতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, সিডিসি, বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তর, সিভিল সার্জন অফিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে সব মিলে ৯৪টি কীটতত্ত্ববিদ ও অ্যান্টোমো-টেকনোলজিস্টের পদ থাকলেও মাত্র ৪৭টি পদ পূরণ আছে। উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যয়ে কোনো পদ নেই। তারপরও উপরের স্তরগুলোর পদে চরম স্বল্পতা আছে। তার মধ্যে ৫০ শতাংশ অপূর্ণ। এমন জনবল স্বল্পতা আর বিশেষজ্ঞের অভাবে কিভাবে চলতে পারে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য খাতের এ অংশ। এত কিছুর পর গবেষণা ও অর্ধের অপ্রতুলতা লেগেই আছে। যন্ত্রপাতি আর প্রশিক্ষিত কর্মীর স্বল্পতা চরমে।

জনস্বাস্থ্য একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি খাত হওয়ায় পরিবেশ ও পুষ্টির নিবিড়তা সমানভাবে গুরুত্বের দাবিদার। পরিবেশ যতক্ষণ পরিচ্ছন্ন না হবে, মশা ও মশাবাহিত রোগের বিস্তার ততক্ষণ থামানো সম্ভব নয়। মশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরো-টাইপও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। মশার প্রতিরোধী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে বাহিত ভাইরাসেরও মিউটেশন হয়, যা আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এর সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার সেরো-টাইপের সংক্রমণের তীব্রতারও তারতম্য ঘটে পরিবর্তিত পরিবেশে। পরিবেশ ও পুষ্টির যথার্থতা নিরূপণ করে তার কাঙ্ক্ষিত প্রয়োগ সদিচ্ছা আর জবাবদিহিতা ছাড়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভেকটর নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত জনবলের সদিচ্ছা, জবাবদিহিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেম ছাড়া কখনই বাহক নির্মূল সম্ভব নয়। দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে দেশপ্রেম আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আমাদের যতটুকু অবকাঠামো আর মানবসম্পদ আছে, তার সঠিক ব্যবস্থাপনা যদি সম্ভব হয়, তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি আর অপমৃত্যু দেখতে হবে না। নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, এডিস মশা দমনে আমার অবদান কতটুকু, আর মশার প্রজননস্থল বাড়াতে আমার অবদান কতটুকু? মশা যে স্থানে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা উৎপাদন করে, সে ক্ষেত্রগুলো প্রতিদিন মানুষের কার্যক্রমের কারণে কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার অ্যাসেসমেন্ট নিজের মধ্যেই রয়েছে।

আমরা খুব ভালো করেই জানি, ভাইরাস আক্রান্ত মশা দেশের যত্রতত্র ছড়িছে পড়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সর্বোচ্চ। এক্ষেত্রে রোগীর প্রকৃত ঠিকানা অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি প্রত্যেক ভর্তিকৃত রোগীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধান করে সত্যিকার ঠিকানা পাওয়া যায়, তখন অবশ্যই ওই নির্দিষ্ট বাড়ির চারপাশে কমপক্ষে ২০০টি বাড়ি পর্যন্ত ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে। আর সঠিকভাবে এই ক্রাশ-প্রোগ্রাম চালানোর অভাবেই দ্রুত গতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। এখন প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ টিমের আওতায় ওয়ার্ড পর্যন্ত লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে ডেঙ্গু অধ্যুষিত এলাকাগুলো সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারিতে রাখা। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি শক্তিশালী কর্মী বাহিনীর সঙ্গে বিশেষজ্ঞ টিমকে ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত রাখা। কোনো ধরনের অবহেলা নয়। প্রতিটি প্রাণই মহামূল্যবান। একইসঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে নিবিড় ডেঙ্গু কর্নার চালু করে ২৪ ঘণ্টা প্রশিক্ষিত ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞের উপস্থিতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এফএফএসের কৃষকদের আইপিএম যেভাবে প্রয়োগ করার প্রশিক্ষণ হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন, একইভাবে একই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পৃক্ত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্যক জ্ঞানে ঋদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। নির্মোহভাবে মনে রাখা দরকার, দেশটা আমাদের সবার। এর প্রতিটি অঙ্গ সচল রাখতে প্রয়োজন সবাইকে রোগমুক্ত ও সুস্থ রাখা। এ দৃঢ় প্রত্যয় সবাইকে ব্যক্ত করতে হবে। ভাইরাস যেমন চোখে দেখা যায় না, তেমনি মশা কখন ও কোথায় কামড়াবে, তাও নিশ্চিত করা যায় না। তাই মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করাই উত্তম সমাধান, যা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করার মূল সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে। যে মানুষ অসাবধানতাবশত মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করছে, তাকে ওই প্রজননস্থল ধ্বংস করার কাজে সম্পৃক্ত করাতে হবে। একজন ড্রাইভার যখন গ্যারেজে গাড়ি ধৌত করে, তখন তাকেই ওই জমে থাকা পানি অপসারণে সংযুক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। গাড়ির নষ্ট টায়ার ওয়ার্কশপে কর্মরত ব্যক্তিরাই পরিষ্কার করবে। যারা ময়লা পরিষ্কার করে ডাম্পিং করেন, তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো ধরনের ভেজা বা পানিযুক্ত কনটেইনার খোলা স্থানে পড়ে না থাকে। এমনকি ডাম্পিং স্টেশনেও কোনো খোলা পানিযুক্ত কনটেইনার থাকতে পারবে না। আসুন, ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ি।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম