স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হাত ধোয়ার গুরুত্ব
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে’ পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা তৈরি এবং জনগণকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে রোগ প্রতিরোধ করার উদ্দেশে এ দিবসটি প্রতিবছর পালিত হয়। সবাইকে হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা ও হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। দিবসটির সূচনা ২০০৮ সাল থেকে। প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সকলের হাত সুরক্ষিত থাক’। সুস্থ থাকার প্রাথমিক কাজই হলো খাবার গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে সাবান বা অন্য যে কোনো অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করে সুন্দরভাবে হাত ধোয়া। অনেকেই এ ব্যাপারটা জানলেও বাস্তবে অনুসরণ করেন কম। আবার কেউ কেউ হয়তো এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।
হাত ধোয়া কর্মসূচি নতুন কিছু নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৮০০ সালে। ভিয়েনার একটি হাসপাতালে কাজ করতেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ইগনাল সেমেলউইজ। এ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে মাতৃমৃত্যুর হার হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। আতঙ্কিত রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। ডা. সেমেলউইজ এর কারণ খুঁজতে লাগলেন। তিনি অনুসন্ধান করে দেখলেন, নবীন চিকিৎসকরা অ্যানাটমি ক্লাসে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে হাত ভালোভাবে না ধুয়েই প্রসূতি ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা করছেন। তিনি মতামত দিলেন, এভাবে অপরিষ্কার হাত দিয়ে রোগীদের সংস্পর্শে আসায় সংক্রমণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু হার। তিনি উদ্যোগ নিয়ে হাত ধোয়া কর্মসূচি শুরু করেন, ফলে জীবাণু সংক্রমণ কমে যায় ও মাতৃমৃত্যুর হার ৫ গুণ কমে আসে। ডা. সেমেলউইজের এ কর্মসূচি হাসপাতালে হাত ধোয়ার গুরুত্বকেই প্রমাণ করে। রোগ প্রতিরোধে হ্যান্ড ওয়াশিং বা হাত ধোয়ার ভূমিকা এখন শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্কুল, কলেজ, রেস্তোরাঁ সর্বত্র স্বীকৃত।
হাত পরিষ্কার রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস। সাধারণত হাত নোংরা হলে আমরা হাত ধুই, খাবার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধুই। আবার প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময় অভ্যাসের বশেও হাত ধুই। শুধু ভালোভাবে হাত ধুয়েই কমপক্ষে ২০ ধরনের অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করে আমরা মানব ইতিহাসের মহামারি কলেরা ও ডায়রিয়াকে বাগে এনেছি। তবে পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণের পর থেকে হাত ধোয়া আমাদের জীবনে মরা-বাঁচার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ২০১৯ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সারা পৃথিবীর মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে, হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা কতটা জরুরি। বলা হচ্ছে, সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস করোনার ভ্যাকসিনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং সর্বস্তরের মানুষের জন্য বেশি কার্যকরী। বিগত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষকে খাবার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধুতে সচেতন করার প্রচেষ্টা চলেছে।
করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি। মাস্ক ব্যবহারের আগে এবং পরে হাত অবশ্যই ধোয়া উচিত। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জীবনের অঙ্গ। খাবার খাওয়ার আগে যেমন হাত ধোয়া দরকার, তেমনি খাবার বানাতে বা পরিবেশন করতেও হাত ধোয়া জরুরি। আবার খাবার শেষে হাত ধুয়ে মোছার তোয়ালেটাও পরিষ্কার থাকা উচিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে হাত ধোয়া, হাত পরিষ্কার রাখা সুস্বাস্থ্যের অন্যতম পূর্বশর্ত। এই একটি অভ্যাস আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রভাব রাখতে পারে।
অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় নাকে-মুখে হাত দেওয়া বা হাত ভালোভাবে না ধুয়ে খাবার খেলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। ফলে সাধারণ ঠান্ডা বা ফ্লু থেকে শুরু করে ডায়রিয়া, জন্ডিস, আমাশয়, টাইফয়েড ও কৃমির মতো রোগসহ বিভিন্ন পানি ও খাদ্যবাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। অনেকেই আবার হাঁচি, কাশি ইত্যাদি অপরিষ্কার জামা বা রুমালে মোছেন। এসবের মাধ্যমে এমনকি করমর্দনের মাধ্যমেও রোগ ছড়াতে পারে। কারণ হাতের গোড়ায় লোমকূপের জায়গায় অনেক জীবাণু থাকতে পারে, এ হাতে অন্যজনকে স্পর্শ করলে তার মাঝেও জীবাণু ছড়ায়।
বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু সংক্রমণের হার আরও বেশি। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়া-যা মূলত পানিবাহিত। এছাড়া সঠিক নিয়মে হাত না ধুয়ে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন করলে রোগাক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে তা অন্য শিশুতে ছড়াতে পারে। অপরিষ্কার খাবার ধরার পর সেই হাত দিয়ে শিশুকে ধরলেও রোগ ছড়াতে পারে। শিশুকে খাওয়ানোর আগে হাত ধোয়ার অভ্যাস করালে রোগ সংক্রমণের হার কমে এবং তাদের মৃত্যু হারও সহজেই কমানো যায়। সঠিক হ্যান্ড ওয়াশিং পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশ রোগ ঠেকানো যায়।
কীভাবে হাত পরিষ্কার রাখবেন : হাত পরিষ্কার রাখার উপায় কম-বেশি সবারই জানা। তবুও কিছু কিছু উপায় নিুে উল্লেখ করা হলো, শুধু অভ্যাস করলেই সহজে এগুলো পালন করা সম্ভব।
(১) কলের পানি ছেড়ে দিয়ে চলমান অবস্থায় দুই হাত ধুতে হবে।
(২) যে কোনো সাবান দুই হাতে লাগিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় ধরে হাতের সামনে ও পেছন ভাগ, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে, নখে ও কব্জিতে ভালোভাবে ঘষা উচিত।
(৩) সাবান ব্যবহারের পর প্রবহমান পানি দিয়ে পুরো হাত ভালোভাবে কচলে আবার পানি ঢেলে দিলেই পরিষ্কার হবে। (৪)
হাত দুটি কলের পানির নিচে ধরলেই পানি নিচে পড়বে। বেসিনের ট্যাপেও এভাবেই পরিষ্কার করা যায়।
(৫) সাবানের বদলে অনেক অ্যান্টিসেপটিক জাতীয় তরল পদার্থ পাওয়া যায়। এগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার অনেকে শুধু হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন, সেটিও একটি ভালো বিকল্প।
হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে কী ভুল হতে পারে : হাত ধোয়ার সময় বিশেষ কিছু জিনিসের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, যেমন :
(১) ২০ সেকেন্ডের কম সময় ধোয়া।
(২) সাবান ব্যবহার না করে শুধু পানি দিয়ে হাত ধোয়া, হাত ঘষে সাবানের ফেনা না করে ধোয়া অথবা সাবান ব্যবহারের পর তা ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে না ফেলা।
(৩) হাতের পেছনের অংশ, আঙুলের ফাঁকের জায়গা ও নখের নিচের অংশ পরিষ্কার না করা।
(৪) খাবার তৈরি, পরিবেশন ও খাওয়ার আগে হাত না ধোয়া।
(৫) একবার ব্যবহার করা পানিতে আবার হাত ধোয়া অথবা বাটিতে পানি নিয়ে সে পানিতে একাধিকজন হাত ধোয়া। একই তোয়ালেতে সবার হাত মোছা। হাত মোছার তোয়ালে মাঝে মাঝে পরিষ্কার না করা।
হাত ধোয়ার মাধ্যমে রোগবালাই থেকে বেঁচে থাকতে হলে যা মানতে হবে :
(১) খাবার শুরুতে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং খাবার শেষে হাত ধুয়ে পরিষ্কার কাপড়ে বা তোয়ালেতে মুছে ফেলা।
(২) খাবার প্রস্তুতকারীদেরও ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। কারণ তাদের তৈরি করা খাবারই মানুষ খেয়ে থাকে।
(৩) বাথরুম বা শৌচকর্মের পর ভালোভাবে হাত ধোয়া উচিত। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার পর, এমনকি স্পর্শ করার পর হাত পরিষ্কার করতে হবে।
(৪) নাক ঝাড়া, কফ ফেলা বা হাঁচি দেওয়ার পর হাত ধোয়া জরুরি।
(৫) অসুস্থ কারও সেবা, দেহের কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতের চিকিৎসা করার আগে এবং পরে হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
(৬) ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য মেডিকেলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাত ধোয়ার ব্যাপারে আরও সতর্কতা জরুরি। কারণ তাদের কারণে রোগীদের শরীরে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। রোগী দেখার পর প্রত্যেক চিকিৎসককে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে, হাসপাতালে এমনকি প্রাইভেট চেম্বারেও। বিশেষ করে একজন রোগী পরীক্ষা করার পর দ্বিতীয় রোগী দেখার আগে অবশ্যই হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
(৭) শিশুদের ডায়াপার বদলানো বা পায়খানা পরিষ্কারের পর হাত ধোয়া জরুরি।
(৮) পোষা প্রাণী হাতে ধরলে, কোলে নিলে বা কোনো পশুপাখি ও তাদের খাবার, বিষ্ঠা ধরার পর হাত ধুতে হবে।
(৯) এছাড়া সঠিকভাবে হ্যান্ড ওয়াশিংয়ের জন্য আঙুলের নখ ছোট রাখা, কৃত্রিম নখ ব্যবহার না করা, হাত ধোয়ার সময় ঘড়ি, আংটি ও ব্রেসলেট খুলে রাখা এবং জামার হাতা ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে হাতা গুটিয়ে রাখা বাঞ্ছনীয়।
উপসংহার : রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ ছড়ানো থেকে নিজে এবং অন্যকে বাঁচাতে হ্যান্ড ওয়াশিং জরুরি একটি কাজ। নিজে নিয়মিত অভ্যাস করুন এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করুন। যেহেতু সুস্থ থাকার জন্য হাত ধোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই হাত ধোয়াবিষয়ক সচেতনতাকে শুধু একটি দিবসের সঙ্গে সংযুক্ত না করে সারা বছরই এর প্রচারণা থাকা দরকার। পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়তা দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে ও স্কুলে শিশুদের মাঝে এ সংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞানদান করা, বিশেষ করে শিক্ষকদের সচেষ্ট ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কারণ শিশুরাই অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগে ভোগে বেশি, যদিও বড়দের বেলায়ও তা প্রযোজ্য। তাছাড়া যে কোনো ব্যক্তির জীবন আচরণে শৈশবের শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব অপরিসীম। শিশুরা যা ছোটবেলা থেকে শেখে, তা তাদের জীবনে অভ্যাসের মতো থেকে যায়। তাই শিশুদের ছোট থেকেই হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করাতে হবে। বর্তমানে করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্য হিসাবে শিশুদের মাঝে শৈশব থেকে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকে হাত ধোয়াবিষয়ক তথ্য সন্নিবেশিত করা জরুরি। এমনকি তাদের পড়ার মাঝে, ‘এইচ’ ফর ‘হ্যান্ড ওয়াশিং’ এবং ‘হ’-তে ‘হাত ধোয়া’-এ রকম শব্দ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিশুকাল থেকেই হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতামূলক তথ্য পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত করা হলে জাতীয়ভাবে সারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন অবশ্যই ঘটবে-এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
পরিশেষে, হাত ধোয়া খুবই সহজ অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অভ্যাস, যার মাধ্যমে সহজেই অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। তাই আসুন নিজে, নিজের পরিবার ও আশপাশের সবার মাঝে হাত ধোয়ার অভ্যাস ছড়িয়ে দিই। মনে রাখতে হবে, রোগের ক্ষেত্রে প্রতিকার নয়, প্রতিরোধই সর্বদা উত্তম। তাই অবহেলা না করে এ বিষয়ে সবাইকে আরও যত্নবান হতে হবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক