দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ানো দরকার
এম এ হালিম
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ১৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, ‘Empowering the next generation for a resilient community’. ১৯০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর গড়ে ৪০০টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়। ফলে ২০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে (Our World in Data)। ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে ৩৯৯টি দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে নয় কোটি মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৮৭ হাজার মানুষ (Reliefweb)। এর বাইরে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ তথা যুদ্ধ-হানাহানির কারণে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা আর অসংখ্য আহত-নিহত তো রয়েছেই। ইউএনএইচসিআর এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (আইডিপি) ও শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১৭ মিলিয়ন বা ১৭ কোটি। ২০২৪ সালেও বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে অনেক। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস ও সিঙ্গাপুর, আফ্রিকার কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে, ইউরোপের জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, পোল্যান্ড, এমনকি পূর্বের রেকর্ড ভেঙে সৌদি আরব, ইউএই ও ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সংঘটিত হয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় রিমেল এবং শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় চলমান বন্যাসহ কয়েক দফায় বন্যা হয়েছে।
দুর্যোগ বিষয়ে সত্তরের দশক পর্যন্ত আমাদের ভাবনা ছিল, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমকেন্দ্রিক। মনে করা হতো, দুর্যোগের আগে মানুষের তেমন কিছুই করণীয় নেই, যদিও ঘূর্ণিঝড়ের (বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে) পূর্বাভাস প্রদানে অনেক দেশেই সফলতা ছিল। যেমন বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি। বন্যা বিষয়েও পূর্বাভাস ব্যবস্থা ছিল। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা এখনো বিদ্যমান। কিন্তু দুর্যোগে মানুষ ও সম্পদের ক্ষতি কমানোর ভাবনা বা উদ্যোগ একেবারেই সীমিত। তাই দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ত্রাণ প্রদানের মাধ্যমে মানুষের দুর্দশা কমানোর চেষ্টাকেই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মনে করা হতো একমাত্র করণীয়। তবে সময়ের পরিবর্তনে মানুষের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে ত্রাণের পরিবর্তে দুর্যোগের ঝুঁকিহ্রাসের ধারণায় রূপান্তর হয়েছে। সমকালীন দুর্যোগে বিপদাপন্ন মানুষ ও কমিউনিটির অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃতি প্রদানসহ স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তাদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্যোগ প্রশমনে কমিউনিটির ভূমিকাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
আশির দশক থেকে দুর্যোগে মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অনুধাবন করে দুর্যোগে সাড়া প্রদান অর্থাৎ ত্রাণকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের লক্ষ্যে নব্বইয়ের দশককে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দশক ঘোষণা করে, যার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১ জানুয়ারি ১৯৯০। একইসঙ্গে প্রতি বছর ১৩ অক্টোবরকে দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বৈশ্বিকভাবে সচেতনতার অভ্যাসকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দুর্যোগ-সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ UN Office for Disaster Risk Reduction (UNDRR) প্রতিষ্ঠা করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের অংশ হিসাবে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কৌশল গৃহীত হয়ে আসছে। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জাপানের কোবে শহরে জাতিসংঘ আয়োজিত World Conference on Disaster Reduction: Hyogo Framework for Action 2005-2015 গৃহীত হয়, যার মূল বার্তা ছিল, দুর্যোগে নিরাপদ ও সহনশীল কমিউনিটি। এ ফ্রেমওয়ার্কের যথার্থতা ও সফলতা পর্যালোচনা করে জানুয়ারি ২০১৫ এ জাপানের সেন্দাই শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে Sendai Framework for DRR গৃহীত হয়, যার আওতায় ২০১৫-২০৩০ সময়ের জন্য কতিপয় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়; যেমন-১. সর্বমহলে দুর্যোগের ঝুঁকি, সম্ভাবনা ও ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, ২. দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ, ৩. দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা, ৪. দুর্যোগ-পূর্ব অবস্থার চেয়ে অধিকতর ভালো অবস্থা তৈরির জন্য প্রস্তুতি, ৫. সহনশীল কমিউনিটির জন্য ঝুঁকিহ্রাস উদ্যোগে বিনিয়োগ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে, ২০২২ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসের লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস প্রস্তাব করেন, ‘সবার জন্য পূর্ব সতর্ক সংকেত’। এর প্রেক্ষাপট হিসাবে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ এখনো দুর্যোগের পূর্ব সতর্ক সংকেত পায় না। এছাড়া দুর্যোগ বিষয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরাম রয়েছে; যেমন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য এশিয়া-প্যাসিফিক কনফারেন্স অন ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন, গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ) ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বলা হয়, ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের মৌসুম, ধরন, ফ্রিকোয়েন্সি, তীব্রতা, প্রভাব ইত্যাদি পরিবর্তিত হচ্ছে। এ বছর বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এ কথার সত্যতা মিলবে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে গত সপ্তাহে সংঘটিত হেরিকেন মিল্টনসহ একই বছরে অস্বাভাবিকভাবে পাঁচটি হেরিকেন আঘাত হেনেছে। এছাড়া ২০২৪-এ সংঘটিত আরও কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা এ নিবন্ধের প্রারম্ভে উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশে ২০২৪-এ একমাত্র ঘূর্ণিঝড় রিমেল উপকূলে আঘাত হানলেও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যার কোনোটি সীমিতভাবে দেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে অথবা কোনোটির গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে ভারতে আঘাত হানে। ইইউ জলবায়ু সংস্থা কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ৬ অক্টোবর ২০২৪ সালকে বিশ্বের উষ্ণতম বছর হিসাবে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশে এ বছর এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। ২৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডিং অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, উষ্ণায়নের ফলে গ্রিনল্যান্ড গলছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন গ্রিন হাউজ গ্যাস বিশ্বকে উত্তপ্ত করে চলেছে। ফলে সাগরে পানি স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিনি আশঙ্কা করেন, এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
এ বছর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের প্রতিপাদ্যে আগামী প্রজন্ম বলতে প্রধানত শিশুদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই দুর্যোগ-পূর্ব সতর্ক সংকেত উদ্ভাবন এবং এর সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সক্ষম করে তোলার মাধ্যমে দুর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়তে হলে শিশু ও যুব সমাজকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশলের সঙ্গে শিশুদের পরিচিতির পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যালয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে দুর্যোগ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫.৭ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাঠ্যসূচিতে দুর্যোগবিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্তি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে তা আরও বাস্তবসম্মত হওয়া দরকার। পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্তি চূড়ান্ত করার আগে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ, অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং অন্তর্ভুক্ত তথ্যের যথার্থতা পরীক্ষা (ফিল্ড টেস্ট) যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ যে কোনো শিখন বিষয়কে বাস্তবানুগ করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কার্যকর দুর্যোগ প্রশমনের লক্ষ্যে দুর্যোগ প্রস্তুতিতে সম্পৃক্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের সম্মিলিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যা দুর্যোগসহিষ্ণু কমিউনিটি গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এমএ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক বিষয়ে লেখক
halim_64@hotmail.com