Logo
Logo
×

বাতায়ন

শক্তিপূজার উৎস সন্ধানে :- স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ

Icon

বাতায়ন

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শক্তিপূজার উৎস সন্ধানে :- স্বামী  পূর্ণাত্মানন্দ

বিশ্বপ্রপঞ্চের পেছনে এক সর্বনিয়ন্তা, সর্বশক্তিমান সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের মনে কখন প্রথম চেতনা জেগেছে, আমরা কেউই তা জানি না। তবে যখনই জেগে থাকুক, সেই আদিম চেতনাই যে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরভাবনার জ ন্ম দান করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আদিম মানুষ অরণ্যে বা পর্বতগুহায় অথবা নদী বা সমুদ্রতীরে; উ ন্মু ক্ত আকাশের নিচে বাস করত। হিংস্র জন্তুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা অস্তিত্ব রক্ষা করত। কখনো সে যুদ্ধে তারা প্রাণ হারাত। কখনো তারা অপর কোনো জনগোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হতো, কখনো আবার অপর কোনো গোষ্ঠীকে আক্রমণ করত। অরণ্যের ফল, অরণ্যের পশু-পাখির মাংস, নদী ও সমুদ্রের মাছ এবং নদীর জল তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাত। এভাবে তাদের জীবন চলত। এর মধ্যে হঠাৎ তারা একদিন দেখল তাদের মধ্যে একজন অসুস্থ হয়ে পড়ল, কেউ চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ল। কখনো তারা দেখল প্রচণ্ড ঝড় এসে প্রকৃতিকে লন্ডভন্ড করে দিল। কখনো আবার প্রবল বর্ষণে সব ভেসে গেল। কখনো বা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলসানি অথবা বজে র গর্জন তাদের শঙ্কিত করে তুলল। কখনো বা কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির আকার ধারণ করে গোষ্ঠীর বহু মানুষের জীবনান্ত ঘটাল। কখনো বা রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে সুখস্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে আনন্দ অথবা আতঙ্কের অনুভূতি লাভ করল। তারা অবাক হয়ে ভাবতে বসল-নারীর বুকে কেন স্তন্যক্ষীরধারা প্রবাহিত, নারীর মধ্য থেকেই কেন বের হয়ে আসে এক নতুন জীবন-এক নতুন মানুষ; আকাশের নীলিমা, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, অমাবস্যার অন্ধকার, পূর্ণিমার সর্বপ্লাবী জ্যোৎস্না , গ্রীষ্মের প্রখরতা, শীতের তীব্রতা তাদের মনে জাগাত বিস্ময়, আনন্দ ও শঙ্কা। ওই অনুভূতি থেকেই তারা এক সর্বনিয়ন্তা সর্বশক্তিমান সত্তার মধ্যে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করল। তখন থেকেই মানুষের ঈশ্বরভাবনার উন্মেষ।

আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে এসব ঘটনা আদিম পুরুষ ও নারীদের জীবনে কোন বিস্ময়, কোন আতঙ্ক, কোন আনন্দের অনুভূতি আনত-তা আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। কিন্তু ধর্মবেত্তা, ঐতিহাসিক, সমাজদার্শনিক, নৃবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদরা একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ওই ধরনের অনূভূতিই আদিম মানুষের মনে ঈশ্বরভাবনার জ ন্ম দিয়েছিল।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য ‘ঋগ্বেদ’র মধ্যে আমরা ক্রমপরিণত সেই ঈশ্বরভাবনার সুপ্রাচীন রূপটির পরিচয় লাভ করি। বৈদিক যুগের ব্যাপ্তি একশ’-দুশ’ বছর নয়, অন্তত এক হাজার বছর। এ এক হাজার বছরে ভারতবর্ষের মানুষের পূর্বপুরুষদের ঈশ্বরভাবনার বিবর্তনের ধারাটিও স্পষ্ট। সেই ধারা আরও পরিণতির দিকে কীভাবে গেছে, তার পরিচয় রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, তন্ত্র ও প্রাচীন পুরাণগুলোতে এবং প্রাচীন কাব্য, ব্যাকরণ, নাটক ও স্মৃতিগ্রন্থগুলোতে। অপরদিকে বৈদিক সভ্যতার পাশাপাশি সিন্ধুসভ্যতার বিকাশের যে প্রমাণ আমরা পেয়েছি, সেখানেও প্রাচীন মানুষের ঈশ্বরভাবনার রূপরেখা বিদ্যমান। উভয় সভ্যতার মধ্যে কোনটি প্রাচীনতর, কোনটি কতখানি মূলগতভাবে ভারতীয় অথবা অভারতীয়, তা নিয়ে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্তে আসা এখনো সম্ভব হয়নি। আবার উভয় সভ্যতার মধ্যে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের তত্ত্ব নিয়েও বাদ-প্রতিবাদ এখনো থামেনি।

সে যাই হোক, আদিম যুগ থেকে সহস্র সহস্র বছরের দূরত্বে অবস্থান করে আমরা এখন ভারত ও পৃথিবীর অন্যত্র ঈশ্বর ভাবনার উন্মেষ ও বিবর্তন সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছি। ভয়, বিস্ময় এবং আনন্দ ঈশ্বরভাবনার জ ন্ম দান করে থাকলেও মানুষের প্রথম ঈশ্বরভাবনা পুরুষকেন্দ্রিক ছিল নাকি নারীকেন্দ্রিক ছিল-সে বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, মানুষ তখন ঈশ্বরকে যেমন পুরুষ ভেবেছে, তেমনি আবার নারীও ভেবেছে। এর প্রমাণ যেমন ‘ঋগ্বেদ’-এ আমরা পাচ্ছি, তেমনি আবার পাচ্ছি সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতেও। বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ যখন ঈশ্বরের কল্পনা করেছে তখন সে তার নিজের আদলেই তাকে কল্পনা করেছে। মানুষ তো শুধু পুরুষই নয়, মানুষ নারীও। সুতরাং আদিম মানুষের ঈশ্বরভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল পুরুষ-ঈশ্বর সম্পর্কে পিতৃভাবনা এবং নারী-ঈশ্বর সম্পর্কে মাতৃভাবনা। মজার ব্যাপার এই যে, ভারতেই হোক অথবা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই হোক, ‘মা’ শব্দটি সুপ্রাচীনকাল থেকে কোনো না কোনোভাবে জননী সম্পর্কে প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। শিশু যখন প্রথম পৃথিবীর আলো দেখে-তখন তার মুখে ভাষা থাকে না, থাকে ক্রন্দনধ্বনি। আশ্চর্য, সেই ধ্বনিটি সব দেশেই ‘মা’-এর মতোই শোনায়। প্রকৃতির নিয়মে কিছুকালের মধ্যে শিশুর মুখে ভাষা ফোটে। মানবশিশুর মুখে উচ্চারিত প্রথম শব্দটিই ‘মা’। সেজন্য সংস্কৃত, ল্যাটিন প্রভৃতি প্রাচীন ভাষাতেই হোক কিংবা ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, বাঙলা, তামিল, মারাঠী-যে কোনো আধুনিক ভাষাতেই হোক; জননীকে যে-শব্দে আমরা ডাকি তার প্রথমে বা শেষে ‘মা’ বা ‘মা’-র কাছাকাছি একটি ধ্বনি আছেই।

সেজন্য পণ্ডিতরা অনেকে মনে করেন, ঈশ্বরভাবনার উন্মেষলগ্নে মানুষ ঈশ্বরকে নারীরূপেই দেখেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই নারীরূপের মধ্যে মাতৃরূপটিই ছিল প্রধান। কারণ, আদিম সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তখন মায়ের পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় চিহ্নিত হতো। নারী ছিল স্বাধীন। বিবাহ বা দাম্পত্য সম্বন্ধের ভাবনা অনেক পরের ব্যাপার। মহাভারত থেকে জানা যায় যে, ঋষি উদ্দালকের পুত্র ঋষি শ্বেতকেতু দাম্পত্য-সম্পর্ক তথা বিবাহ-সম্পর্কের ‘শৃঙ্খলা’ প্রবর্তন করেন। বিবাহ-সম্পর্ক প্রবর্তিত ও স্বীকৃত হওয়ার আগে প্রাচীন সমাজে স্ত্রীপ্রাধান্য ছিল। বৈবাহিক সম্বন্ধ স্বীকৃত হওয়ার পর ক্রমে ক্রমে পুরুষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ধনসম্পদ পুরুষের অধিকারে আসে, নারীও পুরুষের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হতে থাকে। মানবসমাজের ক্রমবিকাশ প্রসঙ্গে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’-এ স্বামীজি বলেছেন : ‘আদিম অবস্থায় বিবাহ ছিল না। ক্রমে ক্রমে যৌন সম্বন্ধ উপস্থিত হলো। প্রথম বৈবাহিক সম্বন্ধ সর্বসমাজে মায়ের ওপর ছিল। বাপের বড় ঠিকানা থাকত না। মায়ের নামে ছেলেপুলের নাম হতো। মেয়েদের হাতে সব ধন থাকত ছেলে মানুষ করার জন্য। ক্রমে ধন-পত্র পুরুষের হাতে গেল, মেয়েরাও পুরুষের হাতে গেল। ... বর্তমান বিবাহের সূত্রপাত হলো।’ আদিম সমাজব্যবস্থা প্রসঙ্গে মার্ক্সীয় বর্ণনার সঙ্গেও স্বামীজির চিন্তার সাদৃশ্য রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে নারীর কর্তৃত্ব থেকে সমাজে পুরুষের কর্তৃত্ব এলো? আমরা দেখেছি, আদিম অবস্থায় মানুষ ছিল প্রকৃতির খেলার বস্তু। আদিম মানুষ প্রকৃতির খেয়াল, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভয় পেত। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হতো অথবা মরতে হতো। তখনকার সেই রুক্ষ, রসহীন, মাধুর্যহীন জীবনে রস ও মাধুর্যের একমাত্র উৎস ছিল নারী। নারীর কাছে তারা পেত স্নে, মমতা এবং মানসিক ও শারীরিক আশ্রয় ও আনন্দ। এ আনন্দ ও আশ্রয় তাদের কাছে একাধারে ছিল স্বাভাবিক, আবার ছিল বিস্ময়েরও বিষয়। আদিম সমাজ যখন ক্রমে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ল, তখন বীজ বপন থেকে শস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে নারীরাই ছিল অগ্রণী। এতে নারীই হয়ে উঠেছিল পরিবার তথা গোষ্ঠীর ভরকেন্দ্র। ফলে নারীর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ নির্ভর করতে আরম্ভ করল। নারীর প্রতি এ নির্ভরতা তাদের মাতৃবন্দনায় ব্রতী করল। এ মাতৃবন্দনাই সমাজকে মাতৃপ্রাধান্য দান করল। ভগিনী নিবেদিতা মনে করতেন, মাতৃপ্রাধান্যের বিষয়টি আদিম সমাজের ভাবাবেগ ও নৈতিক চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সায়েন্স কংগ্রেসে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের ভাষণে তিনি আদিম মানব সমাজে মাতৃপ্রাধান্যের বিষয়টি আলোচিত হতে শুনেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মাতৃবন্দনা ও মাতৃনির্ভরতা মানুষের আদিম ঈশ্বরভাবনাকেও প্রভাবিত করল। মানুষ ঈশ্বরকে নারীরূপে এবং প্রধানত মাতৃরূপে ভাবতে শুরু করল। ভগিনী নিবেদিতা তার ‘ফুটফলস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’তে লিখেছেন : সমাজে রানী-ভাবনা যেমন রাজা-ভাবনা অপেক্ষা প্রাচীনতর, তেমনি দেবী-ভাবনাও দেব-ভাবনা অপেক্ষা প্রাচীনতর। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত দেবী মূর্তিগুলোতে এবং ঋগ্বেদের ‘দেবীসূক্ত’, ‘রাত্রিসূক্ত’ প্রভৃতি আর্যসভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোতে এর ইঙ্গিত মিলবে। সমকালীন অথবা কিছু পরবর্তীকালের বহির্ভারতীয় সভ্যতাতেও, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরের উপক‚লবর্তী বহু দেশে, মাতৃপূজা যে খুব জনপ্রিয় ছিল-সে বিষয়ে বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ বিষয়ে শশিভূষণ দাশগুপ্ত ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘পৃথিবীর প্রাচীন মাতৃপূজার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগরের উপক‚লবর্তী বহু দেশে প্রাচীনকালে মাতৃদেবী ও তাহার পূজার প্রচলন ছিল। গ্রিসের রুহী দেবী, এশিয়া মাইনরের সিবিলি, ইজিপ্টের ইস্থার, আইসিস প্রভৃতি প্রাচীন মাতৃদেবীর এই প্রসঙ্গে উলে­খ করা যাইতে পারে। ... ভূমধ্য-সাগরস্থিত ক্রীট দ্বীপে এক সময় সিংহবাহনা ‘পার্বতী’ (পর্বতবাসিনী) দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, তাহার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। ভূমধ্যসাগরীয় এসব অঞ্চলে ভূখননের ফলে বহু প্রাচীন নারীমূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই নারীমূর্তির প্রাধান্যও একটা মাতৃপূজার প্রচলনই সূচিত করে।’

ক্রীট দ্বীপে প্রাপ্ত দেবীমূর্তিটি একটি পর্বতের শীর্ষদেশে দণ্ডায়মান। তার দুই পাশে দুটি সিংহ যেন তার বাহন বা রক্ষক। গ্রিসের মাতৃদেবী রুহীর যে-মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে-তিনিও পর্বতশীর্ষে দণ্ডায়মান এবং তার পাশেও রয়েছে সিংহ। এশিয়া মাইনরের দেবী সিবিলির মূর্তিতে দেখা যায়, তার পদপ্রান্তে রয়েছে একাধিক সিংহ। প্রাচীন ভারতের সিংহবাহনা এবং পর্বতরাজকন্যা উমা বা পার্বতীর বা দুর্গার কথা এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে আসা স্বাভাবিক। প্রাচীন ভারত এবং প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পর্বতবাসিনী এবং সিংহবাহনা মাতৃদেবতার এ সংযোগ কি আকস্মিক? আমাদের তা মনে হয় না। বরং এটাই মনে হয় যে, মাতৃপূজার বিষয়টি ছিল প্রাচীন সমাজের একটি সাধারণ বিষয়। পারস্পরিক কোনো যোগাযোগের কারণে নয়, প্রাচীন সমাজে মাতৃপ্রাধান্য তথা মাতৃ-উপাসনার স্বাভাবিক উদ্ভবের কারণেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দেবীমূর্তি বা দেবীভাবনার মধ্যে এ সাদৃশ্য। আবার ভারতবর্ষের সুপরিচিত মহিষমর্দিনী দুর্গার মূর্তির সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধপ্রিয়া দেবী ভির্গোর এক অদ্ভুত সাদৃশ্যও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এ দেবীও মহিষমর্দিনী। ভারতীয় পুরাণের মতে, দুর্গা মহিষরূপী অসুর ও তার অসংখ্য অনুচরকে বধ করেছিলেন। ‘মহিষ’ আর কিছুই নয়, অসংস্কৃত, নারীলোভী, হিংস্র, বর্বর এক জনগোষ্ঠী এবং ‘মহিষাসুর’ তাহাদের নেতা। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলেও প্রাচীনকালে ‘মনখেমর’ নামে আদিম এক মিশ্র জনগোষ্ঠী বাস করত। তাদের ‘টোটেম’ বা ঈশ্বরের প্রতীক ছিল মহিষ। অর্থাৎ মহিষ ছিল তাদের কাছে খুব পবিত্র। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সুসভ্য জনগোষ্ঠী মন্খেম্রদের পরাভূত করেছিল। যুদ্ধদেবী ভির্গোর মহিষমর্দিনী মূর্তির মাধ্যমে মন্খেম্রদের ওপর তাদের ওই বিজয়ের ঘটনাই রূপায়িত। ভির্গো এবং দুর্গার এ সাদৃশ্যের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাবের বিষয়টি অবান্তর। কারণ, প্রাক্ ঐতিহাসিক সেই প্রাচীনযুগে পারস্পরিক সংযোগের সম্ভাবনা ছিল না। উভয় ক্ষেত্রেই প্রাচীন সমাজে মাতৃপূজার ভাবনাটি স্বতন্ত্রভাবে উদ্ভূত হয়েছিল এবং হয়েছিল আদিম সমাজের মাতৃপ্রাধান্যের স্বাভাবিক ধারা অনুসারেই।

দেবীকে সিংহবাহনা ও মহিষমর্দিনীরূপে কল্পনার মধ্যে আদিম সমাজে হিংস্র অরণ্যপশুকে টোটেম-রূপে গ্রহণের মনস্তত্ত্বটি সুপরিস্ফুট। সিংহ এবং মহিষ-ওই দুই টোটেমের মধ্যে শুধু ধর্মভাবনাই নয়, সভ্যতার তারতম্যের দুটি ধারাও নিহিত। প্রসঙ্গত উলে­খ্য যে, রুহী, সিবিলি, ভির্গো, দুর্গা ভিন্ন এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ার ফ্রিজীয় জাতি খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীর আগে থেকে পাহাড়ের গুহামন্দিরে এক সিংহবাহনা দেবীর পূজা করত। ফ্রিজীয়রা এ দেবীকে তাদের ভাষায় বলত ‘গদান মা’। ভাষাচার্য সুকুমার সেনের মতে, সংস্কৃত অনুবাদে শব্দটির অর্থ ‘ক্ষমা’। এ থেকে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, ওই মূর্তিটি ছিল ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক-মাতা পৃথিবীর। পৃথিবীকে দেবীরূপে কল্পনা অতিপ্রাচীন। এটি যেমন বহির্ভারতের, তেমনি ভারতের।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূচনা সিন্ধুসভ্যতা থেকে ধরা হয়। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত দেবীমূর্তিগুলোর মধ্যে মাতা পৃথিবীর মূর্তি অন্যতম। মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি মূর্তির অঙ্ক থেকে একটি বৃক্ষকে উদ্গত হতে দেখা যায়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, শস্য, প্রাণশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীকরূপে আদিম মানুষ দেবী পৃথিবীর কল্পনা করেছিল। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র জগতের মধ্যে এ মূর্তিটিই সম্ভবত পৃথিবী-দেবীর প্রাচীনতম মূর্তি। মিশরীয় দেবী মাউত, মেক্সিকান দেবী মায়োএল, জার্মান দেবী নের্থাস, গ্রিক দেবী রুহী, রোমান দেবী সিবিলি, এশিয়া মাইনরের গদান মা ছিলেন পৃথিবী-দেবী।

ভারতের বৈদিক সাহিত্যেও পৃথিবী-দেবী বিশেষ মহিমান্বিতা। ঋগ্বেদে ঋষি বলেছেন : ‘মাতা পৃথিবী মহীয়ম্’-বিস্তীর্ণা পৃথিবী আমার মা (১।১৬৪।৩৩)। ঋগ্বেদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘দৌ’ বা স্বর্গ বা আকাশ-এর সঙ্গে পৃথিবীর নাম উচ্চারিত। ঋগ্বেদে ‘দৌ’ জগতের পিতা-রূপে এবং পৃথিবী জগতের মাতা-রূপে কল্পিত। দৌ এবং পৃথিবী মিলে বেদের দ্যাবা-পৃথিবীর কল্পনা। শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন: ‘এই সকল বর্ণনা দেখিলে বেশ বোঝা যায় যে, পৃথিবীকে যে এই মাতৃরূপে বর্ণনা, ইহা বৈদিক কবিগণের নিছক কবি-কল্পনা মাত্র নয়, ইহার পশ্চাতে বৈদিক কবিগণের একটা ধর্মবোধ প্রচ্ছন্ন ছিল-পৃথিবীর সীমাহীন বিস্তার, তাহার রূপবৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি-বৈচিত্র্য, তাহার অন্নদা এবং ধনদা রূপ; সর্বোপরি পৃথিবীর বুকে লুক্কায়িত অনন্ত প্রাণশক্তি-নিরন্তর অসংখ্য-রূপে তাহার প্রকাশ-এই সকল একত্র হইয়া মুগ্ধ কবিগণের চিত্তে একটা বিস্ময়জনিত শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিয়াছিল। এই শ্রদ্ধার প্রগাঢ়তায়ই মানুষের ধর্মবোধের উদ্বোধন এবং সেই ধর্মবোধকে অবলম্বন করিয়াই পৃথিবীর দেবীমূর্তি।’

ঋগ্বেদ মতে, আদি পিতা দৌ বা আকাশের সঙ্গে আদি জননী পৃথিবীর মিলন ঘটে বর্ষণের মাধ্যমে। আকাশ থেকে পতিত বৃষ্টিধারা পৃথিবীকে সন্তানবতী বা শস্যশালিনী করে। মানব-সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই এমন একটি ধর্মবিশ্বাস বহু জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, বর্ষণের মাধ্যমে আকাশরূপী পিতা-ঈশ্বর পৃথিবীরূপিণী মাতা-ঈশ্বরের গর্ভসঞ্চার করেন এবং তার ফলেই পৃথিবী বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, ফল, ফুল ও শস্যে পূর্ণ হয়ে ওঠেন। ঋগ্বেদে ‘আদিত্যগণের জননী’ দেবী অদিতি ও দেবী পৃথিবী অভিন্না। আদিত্যগণের জননী অদিতি পরবর্তী কালে ‘দেবমাতা’ হয়ে গেছেন। আরও পরবর্তী কালে তাকে আমরা প্রজাপতি দক্ষের জননী ও কন্যা-উভয় রূপেই দেখতে পাই। সেখান থেকেই কি তিনি দক্ষকন্যা সতীতে-যিনি রূপান্তরে উমা, গৌরী, দুর্গারূপে আমাদের মধ্যে পূজিতা হন-পরিণতি লাভ করেছিলেন? এ-প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে উঠতে পারে। ঋগ্বেদের এ পৃথিবী-দিতির কল্পনাই হিন্দু-ভারতের শক্তিপূজার আদি উৎস। ‘রাত্রিসূক্ত’ ও ‘দেবীসূক্ত’তে ওই কল্পনারই আরেক প্রকাশ ঘটেছে। এ দুই ধারা থেকেই পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্ব ও শক্তিসাধনার ঐতিহ্য প্রধানত গড়ে উঠেছে। ঋগ্বেদের অন্যান্য নারী-দেবতার মধ্যে বিশেষ স্থান উষা ও সরস্বতীর। মানবজননী পৃথিবী, আদিত্যবৃন্দের মাতা অদিতি, সূর্যপ্রেয়সী ঊষা, জ্যোতিরূপিণী সরস্বতী, দেবীসূক্তের দেবী এবং রাত্রিসূক্তের রাত্রি পরবর্তী কালে পৌরাণিক যুগে একীভূতা হয়ে অসুরনাশিনী, জগদ্ধাত্রী, রুদ্রুশিবজায়া জগ ন্ম াতা দুর্গা ও কালীতে পরিণত হয়েছেন। এ পরিণতিতে অবশ্য আর্যতর সংস্কৃতির ভূমিকাও উলে­খযোগ্যভাবে মিশ্রিত হয়েছে।

ঋগ্বেদের দ্যাবা-পৃথিবীর কল্পনার মধ্যে হিন্দুর সুপরিচিত শিব-শক্তির কল্পনা ও তত্তে¡র উৎস নিহিত আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন : ‘বেদের এই দ্যাবা-পৃথিবীর রূপ পিতা-মাতার পরিকল্পনায়... আমরা একটা গভীর তাৎপর্য লক্ষ করিতে পারি। সৃষ্টির ভেতর এই যে একটি সর্বজনীন পিতা-মাতার পরিকল্পনা দেখিতে পাইলাম, ইহা পরবর্তীকালে আমাদের নানা প্রকারের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক সূ² বুদ্ধির দ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া, আমাদের শিব-শক্তির পরিকল্পনাকে জাগাইয়া দিয়াছে।... অস্পষ্টভাবে একটি ‘জগতঃ পিতরৌ’র কল্পনা আমরা এখানেই পাইতেছি, এ কথা অস্বীকার করিতে পারি না।’

বলাবাহুল্য, আদিম মানুষের নারী-দেবতার পূজা পৃথিবীতে সর্বজনীন হলেও, স্বামী সারদানন্দ ‘ভারতে শক্তিপূজা’ গ্রন্থে দাবি করেছেন : ‘শক্তিপূজা, বিশেষত মাতৃভাবে শক্তিপূজা ভারতেরই নিজস্ব সম্পত্তি।’ ভারতের বাইরের প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে যে নারী-দেবতার পূজার নিদর্শন আমরা পেয়েছি, তা শুদ্ধভাবে মাতৃপূজায় পর্যবসিত হয়নি। প্রতীক ও প্রতিমার মাধ্যমে জগ ন্ম াতার পূজা পরম মুক্তি লাভের সহায়ক, এ কথা ভারতের ঋষি, সাধক ও আচার্যগণ আবহমানকাল থেকে স্বয়ং উপলব্ধি করে প্রচার করেছেন। ভারতের অগণিত শক্তি-সাধকদের সাধনা যুগে যুগে এর সত্যতা প্রমাণ করেছে। অবশেষে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিসাধক যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ জগজ্জননী এবং সহধর্মিণীকে পূজার মাধ্যমে শক্তিপূজা ও শক্তি-সাধনাকে চরম পরিণতি দান করে জগতের সাধনার ইতিহাসে তাকে এক অনন্য গৌরবে স্থাপন করে দিয়েছেন।স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ : অধ্যক্ষ ও সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম