দেবী দুর্গা ও মাতৃবন্দনা :- ড. সনজিত পাল
বাতায়ন
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্ষা ঋতুর শেষে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর আগমন। নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা, নদীর তীরে সাদা সাদা কাশ ফুলের সমারোহ, শিউলি ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে বাংলা মায়ের কোলে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনাগোনা। ঢাকের বাদ্যে, শঙ্খের সুর-ধ্বনিতে, শ্রীশ্রী চণ্ডীর শ্লোকের উচ্চারণে, নীল পদ্ম সমর্পণের মাধ্যমে বাঙালি নিজের মাতৃশক্তিকে বরণ করার আয়োজন করছে। এই শারদীয় আয়োজনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শুভ শারদীয়।
ভারতবর্ষের অধ্যাÍ-ভাবনায় মাতৃবন্দনা সর্বব্যাপী। কোন সুদূরকাল থেকে জগৎশক্তিকে ভারতবর্ষ মা বলে ভেবে এসেছে। এ ভাবনাতত্তে¡ পরিপুষ্ট হয়েছে এমন এক রূপ, যা সমগ্র পৃথিবীকে মাতৃবন্দনায় স্না ত করতে উৎসুক। বেদে আমরা দেবী আরাধনার কথা পাই কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে। এখানে দেবীকে অগ্নিশিখা স্বরূপিণী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্। দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সরতসি তরসে নমঃ।’ অর্থাৎ ‘আমি সেই অগ্নিবর্ণা শত্র“দহনকারী, কর্মফলদাত্রী দুর্গাদেবীর শরণাগত হই।’ বেদের যুগ ছাড়িয়ে দেবী ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে চিহ্নিতা ও পূজিতা হয়েছেন। দুর্গাপূজায় এসব শক্তিকে মহাশক্তি রূপে পূজা করা হয়। দেবী দশমহাবিদ্যায় দশরূপ ধারণ করেছেন। কিন্তু এই একটি ক্ষণে মহাশক্তির আরাধনায় সব শক্তি, সব দেবীরূপ একটি রূপে প্রকাশমান হন-তিনিই দুর্গা, তিনিই মহিষাসুরমর্দিনী।
আদিম কাল থেকেই মানুষ একটি ক্ষেত্রে নির্ভরতা প্রকাশ করেছে বারবার, এ ক্ষেত্রটি হলো সুকোমল মাতৃস্নে। প্রায় প্রতিটি ধর্মের কাছেই ন্যায়পূর্ণ ঈশ্বর হলেন গুরুগম্ভীর পিতা। কিন্তু ভারতবর্ষ মাতৃত্বের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে সৃষ্টির রহস্য, আবার ধ্বংসের বীজও। দেবীরূপে তাই তার এক চোখে ফুটে ওঠে সমরনিষ্ঠুরতা, অপর চোখে অপার স্নে, ক্ষমা, সন্তানকে রক্ষা করার নিশ্চিত প্রত্যয়। শক্তির যে একই দিকে প্রসব আর প্রলয় রূপ বর্তমান-এই সত্য ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোনো দেশের ধর্মসাহিত্যে বর্ণিত হয়নি। দেবীশক্তির রূপ সম্বন্ধে মানব মনের চিরন্তন জিজ্ঞাসা দিয়েই শুরু হয়েছে মার্কন্ডেয় পুরাণের কাহিনি, যে কাহিনি আজ আমরা শ্রীচণ্ডীরূপে বর্ণনা করি। শত্র“র কাছে পরাজিত এবং স্বজনের কাছ থেকে বিতাড়িত রাজা সুরথ আর স্বজন পরিত্যক্ত সমাধি বৈশ্য মেধস ঋষির কাছে জানতে চেয়েছেন, যারা এদের জীবনে এনে দিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার জ্বালা, তাদের ওপর স্নে কেন কম হয় না? কেন এই মায়া? জবাবে ঋষি জানিয়েছেন, মহামায়ার মায়ায় আচ্ছাদিত জীবকুল। সত্যের ওপর এই মায়ার আবরণ যিনি প্রদান করেন, সেই মহামায়া দেবী সর্বদা জাগরূক। এমনকি কল্পান্তে যখন সৃষ্টি জলমগ্ন, সৃষ্টির দেবতা নারায়ণ অনন্তশয্যায় নিদ্রিত, তখন জেগে আছেন যোগনিদ্রারূপী দেবী। এই দেবীই মহামায়া, মহানিদ্রা, মোহনিদ্রা, মহারাত্রি।
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর তিনটি মূলরূপের দেখা পাওয়া যায়। তিনি মহাকালিকা, মহাল²ী আর মহাসরস্বতী। মহাসরস্বতী চিদ্রূপা, মহাল²ী সদ্রূপা ও মহাকালী আনন্দরূপা। এই তিন রূপের সমন্বয়ে দেবী চণ্ডিকা। ব্রহ্মায় প্রার্থনায় দেবী তামসিক শক্তিরূপী মহাকালিকায় জাগ্রত হলেন। এইরূপে দেবী অন্ধকারময়ী, মহাঘোরা। আর চণ্ডীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মহাসরস্বতী। তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীমা হয়ে জ্ঞান দান করেন। আর মহাল²ীরূপে দেবী জগৎ পালন করেন।
দেবী দুর্গা বাঙালির জীবনে-মননে দুর্গতিনাশিনীর থেকেও বেশিভাবে শিবজায়া পার্বতীরূপে বিরাজিতা। তিনি হিমালয়কন্যা, সিংহ তার বাহন। মাতৃপূজা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু অঞ্চলে প্রাচীন যুগ থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। গ্রিকদেবীর হাতে বর্শা, তিনি পর্বতশিখরে দণ্ডায়মানা এবং সিংহকর্তৃক রক্ষিতা। পণ্ডিতদের মতে, ক্রিটের মাতৃদেবী এশিয়ার প্রসিদ্ধ মাতৃদেবীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বিচিত্র রূপ ধারণ করেছেন, এ সিবিলি দেবীর চার পাশে সিংহ, ভলুক, চিতাবাঘ এবং অন্যান্য পশুকে দেখা যায়। প্রাচীনকালের মাতৃ-উপাসনায় যেসব দেবীর উপস্থিতি ছিল, তারই ভারতীয়-রূপ আমাদের দুর্গতিনাশিনী দুর্গদেবী। আবার ভিন্ন দিক দিয়ে দেখলে ‘উমা’ শব্দটি কোনো সংস্কৃত শব্দ নয়। ব্যাবিলনীয় ভাষায় ‘উম্মু’ শব্দের অর্থ হলো মা। দ্রাবিড়ী প্রতিশব্দ হলো ‘উম্মু’। এ উম্মু থেকেই কি উমার উদ্ভব? অন্নদামঙ্গল কাব্যে কবি ভারতচন্দ্র বলেছেন, ‘উ শব্দে বুঝহ শিব মা শব্দে শ্রী তার।/বুঝিয়া মেনকা উমা নাম কৈল সার।’ আবার কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, উমা শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো ‘ওঁ মা’। উদ্ভবের ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, আমাদের কাছে যিনি দুর্গা তিনিই উমা, আবার তিনিই মহিষাসুরমর্দিনী। তার রূপ ও ইতিহাস বিশাল হলেও বাঙালির মনে কন্যারূপে দেবী কোমল স্থান অধিকার করেছেন।
ভারতবর্ষের মাতৃবন্দনার ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করতে চাই, তবে দেখব অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ মাতৃবন্দনার সূচনা। প্রথমত, দেবী পৃথিবীমাতা রূপে বন্দিতা। ধরিত্রীকে আমরা মহাশক্তির এক প্রকাশ বলে মনে করে এসেছি দীর্ঘকাল ধরে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় আবিষ্কৃত সভ্যতাকে আমরা প্রাক্-আর্য সভ্যতা বলি। এই প্রাক-আর্য সভ্যতায় আমরা দেখি পৃথিবী মাতৃরূপে বন্দিতা। হরপ্পায় যে কটি নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে এমন একটি মূর্তির দেখা আমরা পাই যা হলো, নারীমূর্তির গর্ভ থেকে নির্গত হয়েছে বৃক্ষ। পৃথিবীর প্রজনন শক্তিকে, সৃষ্টি-ক্ষমতাকে এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
দুর্গাদেবীকে শাকম্ভরী নামে আমরা বন্দনা করি। শাক শব্দে সবরকম শস্যকেই বোঝানো হয়েছে বলে মনে হয়। শস্যের মাধ্যমে সব জগৎ পরিপালন করবেন যে দেবী তিনিই বসুন্ধরা। দুর্গাপূজার বোধনের দিন দেবীকে আমরা ‘নবপত্রিকা’ রূপে পাই। এ নবপত্রিকা নয়টি শস্যের সমন্বয়। একটি কলাগাছের সঙ্গে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, ডালিম, মানকচু, অশোক ও ধান একত্রে বেঁধে তৈরি করা হয় শস্যবধূ। এ শস্যবধূই নবপত্রিকা। শারদীয়া পূজা যেন শস্যদেবীরই পূজা। প্রতিটি শস্যের জন্য নির্দিষ্ট একজন দেবী। কলার দেবী ব্রাহ্মণ, কচুর কালিকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্তিকী, বিল্বের শিবা, দাড়িম্বের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ল²ী। দেবীর অসুর বিনাশকালে দাড়িম্ব বীজের মতো দন্তিকা রক্তবর্ণ ধারণ করেছিলেন, তাই তিনি রক্তদন্তিকা নামে খ্যাত। তাই দুর্গাপূজার মধ্যে যে আদি পৃথিবীপূজা সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতের কাশ্মীরের হিমালয়ে ত্রিকুট পর্বতের গুহায় দেবী দুর্গার অতি প্রসিদ্ধ এক মন্দির হলো বৈষ্ণোদেবীর মন্দির। সেখানে দেবী দুর্গা বৈষ্ণবী নামে খ্যাত। এখানে দেবীর এরূপ নামকরণের কারণ, এখানে দেবী দুর্গা বিষ্ণুস্বরূপ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পাদপদ্মের ধ্যানে রত রয়েছেন। দেবীর ধ্যানে যেন বিঘœ না হয়, সেজন্য প্রভু শ্রীরামের পরমভক্ত হনুমানজি সর্বদা সেখানে অবস্থান করেন। নবরাত্রি পূজার সময় সারা ভারতের লাখ লাখ শক্তি উপাসকগণ দেবী মায়ের দর্শনের জন্য সেখানে সমবেত হন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাতৃবন্দনায় আমাদের আরেকটি বিশেষ দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। এ দিকটি হলো দেশকে মাতৃরূপে আরাধনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নন, বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ, ভগিনী নিবেদিতা-প্রত্যেকের কাছেই দেশ প্রকাশ পেয়েছে মাতৃরূপে। দেশের সেবা ছিল মায়েরই সেবা। পরাধীনতায় শৃঙ্খলিত ভারত স্বাধীন করতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন ‘আনন্দমঠ’, ঋষি অরবিন্দ লিখেছেন ‘ভবানীমন্দির’, ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন ‘কালি দি মাদার’। এ দেবী বন্দিতা হলেন ভারতমাতারূপে। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে মন্দিরের ভবতারিণী, জননী সারদামণি আর ভারতমাতা একাধারে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। তার কাছে দেবী প্রলয়রূপিণী স্বয়ং মৃত্যুস্বরূপা। ভারতবর্ষের মাতৃবন্দনা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বিশেষ রূপ পেয়েছিল, সেই রূপচ্ছবির ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।
ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা দেবী আরাধনার সূচনা, এর পরে কালীপূজা-দেবীর আধ্যাত্মিক রূপ তাতে পরিস্ফুট, সর্বশেষে জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজা। জগদ্ধাত্রী দেবী এখনে ধরিত্রীরূপিণী-এই তিন দেবীর আরাধনার মধ্য দিয়েই আমাদের দেবীপক্ষের উপাসনার শুরু ও শেষ। এই তিন দেবীর পূজাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে ধরতে হবে।
শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গার শ্রী চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির প্রাণের উৎসব শ্রীশারদীয় দুর্গাপূজার সমাপন হবে। ভয়হীন চিত্তে, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে, ভ্রাতৃত্ববোধের আবেশে আনন্দের সঙ্গে দুর্গোৎসব পালন করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে। অসাম্প্রদায়িক বোধ-বিশ্বাসের শক্তিতে আমরা বলীয়ান হয়ে আগামীর পথে এগিয়ে যাব-এই আমাদের প্রত্যাশা।ড. সনজিত পাল : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাবেক সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়