Logo
Logo
×

বাতায়ন

কুমারীপূজার তাৎপর্য :- তারাপদ আচার্য্য

Icon

বাতায়ন

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কুমারীপূজার তাৎপর্য :- তারাপদ  আচার্য্য

সনাতন ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ বেদ, পুরাণতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক শাস্ত্রগ্রন্থগুলোয় যত ধরনের সাধনা, অনুভব ও অভিজ্ঞতা আছে; হিন্দুধর্ম তার যুগ-যুগান্তরব্যাপী তত্ত্বান্বেষণের সুমহান ইতিহাসে যত দেবদেবীর সাধনার প্রবর্তন করেছে-দুর্গাপূজায় তার পূর্ণ সমন্বয় ঘটেছে। এ সমন্বিত দুর্গাপূজার অঙ্গপূজারূপে কুমারীপূজা আমাদের কাছে এক গভীর তত্ত্বের দ্বারোদ্ঘাটন করে। কুমারী হলো শুদ্ধ আধার। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, অন্নপূর্ণাপূজা এবং কামাখ্যার শক্তিক্ষেত্রেও কুমারীপূজার প্রচলন আছে। কুমারী সম্বন্ধে এসব প্রশস্তির দ্বারা এটাই বোঝা যায়, কুমারী দেবী ভগবতীর অতি সাত্তি¡ক রূপ। জগ ন্ম াতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্ত্রী হয়েও চিরকুমারী। সেজন্য প্রত্যেক শক্তিপিঠেই কুমারীপূজার রীতি প্রচলিত।

শ্বেতাশ্বর উপনিষদেও কুমারীপূজার উলে­খ পাওয়া যায়। শাস্ত্রমতে, কুমারীপূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, বানাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবরা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সেসব দেবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে বানাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারীপূজার প্রচলন শুরু হয়। সূদূর অতীত থেকেই যে কুমারীপূজার প্রচলন ছিল, তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় ‘কুমারীপূজাপ্রয়োগ’ গ্রন্থের পুঁথি থেকে।

কুমারীপূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে কোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সব জায়গায় প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সি যে কোনো কুমারী মেয়েকে পূজা করা হয়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এসব কুমারীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন-১ বছরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, ২ বছরের কন্যার নাম সরস্বতী, ৩ বছরের কন্যার নাম ত্রিধামূর্তি, ৪ বছরের কন্যার নাম কালিকা, ৫ বছরের কন্যার নাম সুভাগা, ৬ বছরের কন্যার নাম উমা, ৭ বছরের কন্যার নাম মালিনী, ৮ বছরের কন্যার নাম কুষ্ঠিকা, ৯ বছরের কন্যার নাম কালসন্দর্ভা, ১০ বছরের কন্যার নাম অপরাজিতা, ১১ বছরের কন্যার নাম রূদ্রাণী, ১২ বছরের কন্যার নাম ভৈরবী, ১৩ বছরের কন্যার নাম মহালপ্তী, ১৪ বছরের কন্যার নাম পীঠনাযিকা, ১৫ বছরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ১৬ বছরের কন্যার নাম অন্নদা বা অম্বিকা।

বর্তমানে কোনো কোনো রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে কুমারীপূজা হয়ে থাকে, তবে সব রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে হয় না। প্রথমে দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার প্রচলন থাকলেও পরবর্তীকালে এ পূজার চল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে ভ্রমণকালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারীপূজা করেন। এরপর ১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল ম ন্ম থ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারীরূপে পূজা করেছিলেন। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা ও কুমারীপূজা শুরু করেন। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম কুমারীপূজায় স্বামী বিবেকানন্দ ৯ জন কুমারীকে পূজা করেন। স্বামীজীর দিব্যদৃষ্টিতে সব কুমারীই দেবীর একেকটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি পূজা করেছিলেন ৯ জন কুমারীকে। স্বামীজী প্রত্যেক কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে। এই ৯ জন কন্যার একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা, যার কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজী ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে তিনি বলেছিলেন, ‘আঃ, দেবীর বোধহয় তৃতীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।’

তার দৃষ্টি ঠিকই। আমাদের দুটি চোখ থাকলেও তৃতীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃতীয় চোখ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার দৃষ্টিতে তিনি যেমন ‘সেদিন দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’, পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজীর স্নেধন্যা ছিলেন এই কন্যা। স্বামীজীর কুমারীপূজায় যেন সত্যি সত্যিই দুর্গামারূপে তিনি পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘দুর্গামা’ অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজীর অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এই ৯ জন কুমারীর মধ্যে দুর্গামা যেমন ছিলেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলালদাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানীও ছিলেন। স্বামীজী এ পূজার দ্বারা যেন একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সব নীতির উর্ধে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন নীতি। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিদর্শন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ইদানীং যে দুর্গাপূজার সময় জীবন্ত কন্যাকে কুমারীপূজা করার প্রচলন, তা স্বামীজীরই আবিষ্কার বা তিনিই এর প্রচারক। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের কোনো কোনো পূজামণ্ডপে কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

কুমারী কথার সাধারণ অর্থ ‘কন্যা’। কুমারী মানেই ‘সর্ববিদ্যা স্বরূপা’। দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্না ন করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গয়না ও নানাবিধ অলংকারে সাজানো হয়। পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল। কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানা উপাচার। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়। প্রতিমায় দেবীর পূজাতে ‘আংশিক ফল’ হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় ‘পরিপূর্ণ ফল’ পাওয়া যায়। ‘কুমারীর পূজা’ নয়, ‘কুমারীতে পূজা’। কুমারীতে ‘ভগবতীর পূজা’। এটি একাধারে ‘ঈশ্বরের উপাসনা’, ‘মানব বন্দনা’, আর ‘নারীর মর্যাদা’। ‘নারীর সম্মান’, ‘মানুষের জয়গান’ আর ‘ঈশ্বর আরাধনা’ই কুমারীপূজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।তারাপদ আচার্য্য : সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম