ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা

মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অনেক বছর আগে দেশের প্রথম সারির একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দূর থেকে হইচইয়ের শব্দ কানে ভেসে এলো। আরেকটু এগিয়ে মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন ক্যান্টিনের সামনে এসে বুঝতে পারলাম, ক্যান্টিনের ভেতরে মেডিকেল স্টুডেন্টদের একটি দল মিছিল নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা ক্যান্টিনের ভেতর থেকেই তাদের রাজনৈতিক দলের প্রয়াত নেতার নাম নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের ওই ছোট দলটি স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে বের হয়ে পড়ল। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি রাজনৈতিক দলের মিছিল নিয়ে যখন স্লোগানে স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করে তোলেন, তখন আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না মেডিকেল শিক্ষার কী দশা!
২.
একাধিক খ্যাতনামা চিকিৎসকের কাছে শুনেছি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি। পড়াশোনার চাপে নাকি তাদের প্রায়ই দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা হতো। একবার একটি জেলার এক সিভিল সার্জন কথায় কথায় আমাকে বলেছেন, মেডিকেল কলেজে পড়াকালে ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবারের অপেক্ষা করার সময় অনেকের মতো তার হাতেও একটা বই থাকত। অর্থাৎ তখনকার সময়ে মেডিকেলের পড়ালেখার চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, তাদের অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময়ই ছিল না, নষ্ট করার মতো সময় থাকত না হাতে; রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং তো দূরের কথা! কাজেই ডাইনিং রুমের সামনের কিউতে দাঁড়িয়ে হোক কিংবা ক্যান্টিনের ভেতরে চায়ের টেবিলে হোক, সব সময় শুধু পড়া আর পড়া। আর আজকাল মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই রাজনীতির পেছনে তাদের পড়ালেখার একটা বিরাট সময় ব্যয় করেন। তাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে ওঠেন!
এ নিয়ে আমার নিজের মনেও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের কীসের অভাব? তারা দেশের সেরা মেধাবীদের অন্তর্ভুক্ত। তারা তাদের মেধার প্রমাণ রেখে দেশের অন্যতম তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা মোকাবিলা করে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে থাকেন। এ মেডিকেল শিক্ষার্থীরাই মানুষের সেবা করার স্বপ্ন মনের মধ্যে বহু বছর ধরে লালন করেন। তাহলে এমন কী কারণ থাকতে পারে, একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় তাদের চলতে হবে? কেনইবা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হয়ে ক্যাম্পাসে তাদের মিছিল নিয়ে বের হতে হবে? তারা তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলের আদর্শের অধিকারী হতে পারেন; তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মেডিকেল কলেজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী কেন একটি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়বেন? কীসের স্বার্থে? এর পেছনে কি রাজনীতিই একমাত্র কারণ, নাকি অন্য কোনো কারণ নিহিত রয়েছে? উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি এ ধরনের রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায়?
মেডিকেলে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই যারা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন, তাদের দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার গুণগত মান বজায় রাখা কতটুকু সম্ভব, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। অনেকেই মনে করেন, মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব সংগঠন থাকতে বাধা নেই। তারা ওই সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের চাহিদা, সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে তো এর জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হয় না। এটা যে তারা বোঝেন না, তাও নয়। তবে বাস্তবে এর কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না।
শুধু মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাই শেষ নয়। মেডিকেল কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষকও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন; কিন্তু কেন? আজকাল দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক-চিকিৎসক কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও দর্শনের ভাবধারায় বিভাজিত। মেডিকেল শিক্ষক-চিকিৎসকদের পেশামুখী সংগঠন করতে বাধা নেই। কিন্তু তাদের সংগঠনকে নিজেদের পেশামুখী পরিচয়ের পরিবর্তে যখন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়, শিক্ষক-চিকিৎসকরা নিজেরা যখন রাজনৈতিক দলের অন্ধ অনুসারী হন, তখনই সমস্যা তৈরি হয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে (?) কিছু কিছু শিক্ষক-চিকিৎসকের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়! কে কার আগে রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবেন, সেই চেষ্টাই সব সময় প্রকাশ পায়!
রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবস্থা কী, সেটাও আলোচনায় নিয়ে আসা দরকার। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, দেশের প্রায় ৩৩টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরের বর্ণনা মতে, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের অন্তত ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি সরকারি কলেজ ও ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে ২৭টিতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার বিষয়ে কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের এক সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানালেও ছাত্র সংগঠনগুলো এর পক্ষে নয় বলেও খবর বেরিয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র মতভেদ রয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে নানা রঙের অনুসারী শিক্ষক দেখা যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাদা, কেউ কেউ নীল রঙের রঙে আচ্ছাদিত। এখানেও দেখা যায়, যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থাকে তখন সেই দলের অনুসারী শিক্ষকদের সংগঠন বেশি প্রভাবশালী ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। অন্য কথায় বলা যায়, ক্যাম্পাসে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরই তেমন একটা অস্তিত্ব থাকে না। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনেও নানামুখী স্বার্থ কাজ করে বলে শোনা যায়। যারা সরকারি দলের অনুসারী হন তারা বিভিন্ন লোভনীয় পদের দায়িত্ব পান, অথবা বাগিয়ে নেন; আর অন্যরা সাধারণ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির জগতে থাকেন একরকম নির্বাসিত! এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্র-সংগঠনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন বলেও শোনা যায়। তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিলের জন্য অনৈতিকভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী হওয়ার কারণে ছাত্ররাও প্রথম ওই শিক্ষকদের অনৈতিক সুবিধাগুলো পূরণের পথ সুগম করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। পরবর্তীকালে তারাই আবার নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য শিক্ষকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। এ ধরনের ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ নামের একটা খেলা আবর্তিত হতে থাকে! এ খেলার নীরব দর্শক যেমন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, ঠিক তেমনই এর ফলে ক্যাম্পাসে উদ্ভূত নানা ধরনের সংঘাতমূলক কার্যক্রমের শিকারও হয়ে থাকেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই। তবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যদি সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে একবার প্রতিবাদ করতে শুরু করেন, তখন কী অবস্থা হয়, সেটা আজ আর কাউকে নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। এর রক্তক্ষয়ী উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। অথচ শিক্ষকদের মধ্যে যদি শুধু তাদের নিজেদের নিয়ে একটি পেশামূলক সংগঠন থাকত, তাহলে তারা সরকারের ভ্রান্ত নীতির তীব্র সমালোচনা করতে পারতেন এবং প্রয়োজনে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারতেন। সরকারও তাদের সমীহ করে চলত। এখন যা ঘটে তা হলো, একদলের সমর্থক শিক্ষকরা সরকারের সমালোচনা করে যা বলবেন, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার দলের সমর্থক শিক্ষকরা বিপরীত অভিমত তুলে ধরবেন। কখনো কখনো এসব কারণে রেষারেষি, সংঘাত ও নিজেদের মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের সৃষ্টি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এর যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যাবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব ভালো করেই জানেন। আমরা শুধু চাই, দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক সবার, সব শিক্ষকের, সব শিক্ষার্থীর মতপ্রকাশের, জ্ঞানচর্চার, আর নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির এক অনন্য স্থান; যা দেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থে সবসময় স্বস্তিতে রাখতে পারবে।
মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা), ময়মনসিংহ