মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ অত্যাসন্ন?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ২ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ১৮০টি সুপারসনিক মিসাইল হামলার পর হিজবুল্লাহ ২ ঘণ্টার ব্যবধানে ২০০টিরও বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের একগুঁয়েমি মনোভাবের কারণ তার প্রতি মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তির সমর্থন। কিন্তু লেবাননে একটানা হামলা চালানোর পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন চেতনা জেগে উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লেবাননে বেসামরিক মানুষের ওপর বোমাবর্ষণের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠে ঐক্য গড়ে তুলবে।
ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডসের পরামর্শে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট জোট একই নির্দেশনায় কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। ফিলিস্তিনের হামাস, ইরাক ও ইরানের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুথি, লেবাননের হিজবুল্লাহ-সবার লক্ষ্য এখন ইসরাইলের আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাধ্যমে শত্রু দমন। সৌদি যুবরাজ সালমান এই প্রথম লেবাননের বেসামরিক মানুষের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর শতাধিকবার বোমাবর্ষণের প্রতিবাদ করেছেন। এদিকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাসা শহরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। হুথি দাবি করেছে, তারা তেল আবিবেও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। শত্রুপক্ষ এসব ড্রোন প্রতিহত বা ভূপাতিত করতে পারেনি। ইতঃপূর্বে হুথিরা ইসরাইলে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। গত নভেম্বর থেকে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে বিভিন্ন জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠন ইসরাইলি বাহিনীর স্থল আক্রমণ প্রতিহত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা সম্মুখযুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তৈরি করে তিনটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে এবং আটজন ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যা করেছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। এর মধ্যে হামাসের যোদ্ধা, কর্মকর্তা ছাড়াও হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ রয়েছেন। যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল জানিয়েছিল, গাজা থেকে হামাসকে তারা পুরোপুরি নির্মূল করে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত দখলদার ইসরাইল তাদের এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
২০২৪ সালের অক্টোবরের শুরুতে লেবাননে আক্রমণের পর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলায় এ উপত্যকার হামাস সরকারপ্রধান রাহী মুস্তাহাসহ আরও দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে দখলদার ইসরাইল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরাইলের আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সব বৈরী দেশগুলোর ওপর একইসঙ্গে চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে মার্কিনিরা নির্লজ্জের মতো ইসরাইলি বাহিনীকে গোলাবারুদ, রসদ জোগাচ্ছে। ইরানকে তারা প্রত্যক্ষ হুমকি দিলেও ইরান সেটার পালটা জবাব হুমকির মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে দেরি করছে না। হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের এক কমান্ডারকে হত্যার জবাব দিতে মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলে একসঙ্গে ১৮০টি মিসাইল ছোড়ে ইরান।
এ মিসাইল হামলা ইরান-ইসরাইল উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ছক কষছে দখলদার ইসরাইল। মূলত হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর ইসরাইল সরকারের একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, তারা এখন ভালো অবস্থানে আছে এবং চাইলে ইরানের ধর্মীয় নেতাকেও হত্যা করতে পারবে। আর এমন খবর প্রকাশের পরই নেতানিয়াহুকে ইরানের ‘হিটলিস্টে’ রাখার তথ্য প্রকাশিত হলো। উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি তালিকায় ইরান ‘হত্যা করতে’ চায় এমন ব্যক্তিদের নাম বের রয়েছে। এই ‘হিটলিস্টে’ নাম আছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ তিন বাহিনীর প্রধানের। এছাড়া ইরানের হিটলিস্টে আছে দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও। ইরানের গোয়েন্দারা বলছেন, নেতানিয়াহুকে না হলেও দখলদার ইসরাইলের বড় নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের দোসররা চুপ করে থাকলেও কাতার, জর্ডান, তুরস্ক, মিসর ইত্যাদি দেশের পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের সুস্পষ্ট অবস্থান এখনো জানা যায়নি। লেবাননে শত শত প্রাণ হারানোর পরও আমেরিকাবিরোধী ব্লক চুপ করে থাকার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে যুদ্ধ দ্রুত ছাড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্রমাগত হুমকি ও পালটা হুমকির মুখে সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে? পুরো বিশ্বের নজর এখন ইরান-ইসরাইল পরিস্থিতির দিকে। ইরানের হামলার জবাবে ইসরাইলের পদক্ষেপ কী হবে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। অপরদিকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ সক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায়, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। তবে দুটি দেশই বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরাইলের ১৭। কিন্তু শক্তির ভারসাম্য যতই কাছাকাছি হোক না কেন, একবার সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে শক্তির ক্ষয়সাধন কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার ব্যাপার মাত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তার দেশ ইসরাইলের পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকে সমর্থন করবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে যে ভয়ানক শক্তি ব্যবহারে ইসরাইলকে উসকে দেওয়া হয়েছে, তাতে কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে?
এসব বিষয়কে কেউই আমলে নিচ্ছে না। অস্ত্র ব্যবসার প্রয়োজনে এমন ভয়ংকর বিষয়কে ওরা অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ইসরাইল অবাঞ্ছিত তথা ‘পারসনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করেছে। ফলে তিনি ইসরাইলে প্রবেশ করতে পারবেন না। গুতেরেসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কারণ, তিনি ইরানের মিসাইল হামলার নিন্দা জানাননি।
এদিকে ব্রিটিশ অভিনেত্রী জুলিয়েট স্টিভেনসন ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে বোমাগুলো ৯০ জনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল, সেগুলো এফ-৩৫ বিমান থেকে ছোড়া হয়েছিল। বিমানটির যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের তৈরি। কিন্তু এসব শুনে মানবতার শত্রুদের কার কী আসে যায়? বিশ্ববাসীর ঘৃণা উপেক্ষা করে ইসরাইলি বর্বরদের মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার এবং নির্বিচারে হত্যা করার রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমারা। পরিস্থিতি আরেকটু ব্যাপৃত হলে এর প্রভাব উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশেও পড়বে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে সবখানে। তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সনির্ভর আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে। ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে রেমিট্যান্স আসার প্রধান উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স কমে গেলে বা বন্ধ হলে আমাদের বাজেট ফেল করতে থাকবে। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে চাকরিহারা শ্রমিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করলে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়ে ‘থ্রি-জিরো’ যুদ্ধে জয়লাভের আশা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনই অনুমান করা কঠিন। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রণীত ‘থ্রি জিরো’ তথা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও বিপজ্জক হয়ে উঠলে, সেখানকার শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসা শুরু হলে আমাদের জিরো দারিদ্র্য ও জিরো বেকারত্ব ধারণার বাস্তবায়ন খুব কঠিন হতে পারে।
ইসরাইলের পারমাণবিক হুমকির জবাবে ইরান অনমনীয়। তবে কি মধ্যপ্রাচ্যে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ অত্যাসন্ন? বিশ্বে ক্রমাগত পারমাণবিক হুমকি নিরসনে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য আসুক এবং আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা দূর হোক।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd