Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ব শিক্ষক দিবস

নতুন ভাবনা ও প্রেক্ষিত

Icon

কাজী ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকের মতামতের প্রতি কার্যকর গুরুত্ব দিয়ে তার আর্থ-সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতে বিশ্বব্যাপী শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ ও আহ্বান সংবলিত প্রতিপাদ্য : ‘ভ্যালুইং টিচার ভয়েসেজ : টুয়ার্ডস এ নিউ সোশ্যাল কনট্রাক্ট ফর এডুকেশন’ অনুসারে এবং জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার নীতিগত অবস্থান ও মরণপণ লড়াইয়ের পটভূমিতে আজ ৫ অক্টোবর দেশে ভিন্ন ও নতুন এক মাত্রায় পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কো, আইএলও, ইউনিসেফ ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে এ বছর দিবসটির ধারণাপত্রে বিশ্বজুড়ে উচ্চ ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে একইভাবে শিক্ষকতা পেশার প্রতি বর্তমানে প্রদত্ত গুরুত্ব স্বল্প ও ক্রমহ্রাসমান। এর বিপরীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য : শিক্ষা ব্যাহতকারী কোভিড-১৯ মহামারিসহ সাম্প্রতিক সময়ে সংকটেও এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, অনুকূল পরিবেশ এবং স্বায়ত্তশাসন পেলে শিক্ষকরা শিক্ষায় যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং এমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেন, যা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়ন নিশ্চিত করে। গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষকরা শিক্ষার বিষয়গুলো আয়ত্ত করে পাঠক্রমের বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দিয়ে মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিক করেন, সাধ্যমতো শ্রেণিকক্ষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দেন এবং শ্রেণিকক্ষে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় অর্জন ও অগ্রগতি সাধনে, তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন সত্ত্বেও তাদের সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথা বা পরামর্শ যথাযথভাবে বিবেচিত হয় না। শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর খুব কমই শোনা যায়, বা মতপ্রকাশ করতে তাদের খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয় না। যদিও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘হাই লেভেল প্যানেল অন দি টিচিং প্রফেশন’ এবং সর্বশেষ ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন টিচার্সে’র বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ক্রমবর্ধমান শিক্ষকস্বল্পতার সংকট ও তাদের অবনতিশীল কর্মপরিবেশের প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অভিব্যক্তি প্রকাশের অপরিহার্যতায় শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক চুক্তির প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে আসছে। আবার দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ; দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত; তৃতীয় অবস্থানে ভুটান; চতুর্থ অবস্থানে নেপাল। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এমপিওবহির্ভূত বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকরা।

খুদে শিক্ষার্থীদের কাঁধে বই-খাতা দিয়ে ভারী ব্যাগের বোঝা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে স্কুল-মাদ্রাসায় এবং শিশুর নিজ গৃহে শারীরিক শাস্তি ও মানসিক নিপীড়ন চলে আসছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ২০১৮-এর মধ্যে ১:৩০-তে পৌঁছানোর কথা থাকলেও ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিচে নামেনি ।

দেশে শিক্ষার মোট ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে পরিবার। পাকিস্তানে যা ৫৭ শতাংশ। ভারতে আর্থিক দিক থেকে ভালো অবস্থানে থাকা ২০ শতাংশ পরিবার, খারাপ অবস্থায় থাকা ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় সরকারি, বেসরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং অনুদানবিহীন সবরকম স্কুলে প্রায় চারগুণ বেশি ব্যয় করে (ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২)।

শিক্ষা উপদেষ্টার অবস্থান ও বিশিষ্টজনদের মত

শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে সংশ্লিষ্টদের তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও নানাভাবে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে (প্রথম আলো, ০৪-০৯-২৪)। বিশিষ্ট শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক ড. মনজুর আহমদ বলেছেন, ‘আধিপত্য ও আনুগত্যের রাজনীতির প্রভাবে ও যোগ্য শিক্ষা-নেতৃত্বের অভাবে গত দেড় দশক শিক্ষার গতি-প্রকৃতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের যথার্থ আলোচনায় আগ্রহ দেখা যায়নি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমুক্ত বর্তমান সরকার নির্মোহ সংলাপে উৎসাহী হবে বলে আশা করা যায়’ (প্রথম আলো, ২৬-০৮-২৪)। ব্র্যাকের শিক্ষা গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ বলেন, ‘প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এ শিক্ষাব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এগিয়ে নেওয়া এ সময়ের চ্যালেঞ্জ’ (প্রথম আলো, ০৪-০৯-২৪)।

লেখার শুরুতে শিক্ষা নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের উপলব্ধি ও বিশ্ব সংস্থার ভাবনা, যা শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের অপরিহার্যতায় শিক্ষককে প্রাপ্য যথোচিত অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতের সপক্ষে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তার উল্লেখ করেছি। শেষ করব বহুল প্রচলিত, একটি পুরোনো বাক্য দিয়ে : ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’!

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : সদস্য, এডুকেশন ওয়াচ

principalqfahmed@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম