Logo
Logo
×

বাতায়ন

ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মানবিক অঙ্গীকার

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মানবিক অঙ্গীকার

ড. মুহাম্মদ ইউনূস/সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার গৌরবগাথায় সমুজ্জ্বল জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান। ফলস্বরূপ, শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত। বিগত সরকারের সবরকম অসংগতিকে সমূলে উৎপাটন করে নতুন চেতনায় সমৃদ্ধ দেশ প্রতিষ্ঠায় তার প্রতিশ্রুতি সুস্পষ্ট। স্বল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্র সংস্কারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পন্থাগুলো চিহ্নিত করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশংসিত হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন কমিশন গঠনের মাধ্যমে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রদেয় সুপারিশগুলো কার্যকর করে টেকসই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার সর্বত্রই সমাদৃত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিবর্তন-পরিমার্জন-সংশোধনের লক্ষ্যে নিয়মনীতির যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত। ইতোমধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরও কয়েকটি বিশেষ কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সচলতায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আশাজাগানিয়া। দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যই ইতিবাচক। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তার আশ্বাস ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।

সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষ্যে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। উন্নত-উন্নয়নশীল বিশ্বের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা-দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠানে তিনি খুবই ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। এ সফরটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দেশের স্বার্থে নানামুখী উদ্দেশ্যসাধনে বৈঠকগুলো ছিল যুগান্তকারী। মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে পরিবেশ দূষণের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বিশ্বদরবারে উত্থাপিত ড. ইউনূসের বক্তব্য ছিল দৃঢ় ও বস্তুনিষ্ঠ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের চলমান সমস্যাগুলো সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল উচ্চমার্গের ও ভারসাম্যপূর্ণ। তার আবেগঘন উপস্থাপনায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণজাগরণের পরিপ্রেক্ষিত ও নির্মম সহিংসতা সম্পর্কে বিশ্ববাসী অবগত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে দেড় হাজারের অধিক প্রাণ বিসর্জন এবং বিপুলসংখ্যক বিপ্লবীর পঙ্গুত্ববরণের ঘটনা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে প্রদত্ত তার বক্তব্যে বলেন, ‘এ গণ-আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। যার জন্য নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পর আমাদের জেনারেশন জি (প্রজন্ম জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ রকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার সময়েও। বাংলাদেশের এ অভ্যুত্থান আগামী দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।’

এটি স্পষ্ট, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান ও ভাষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। জাতিসংঘে সাবলীল ভঙ্গিতে একটানা দীর্ঘসময় ধরে প্রদত্ত বাংলা ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার রূপকল্প তুলে ধরেছেন। তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নের নতুন সমাজ গঠনে নিরন্তর সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ তিনি এ স্থানে উপস্থিত হতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন। বিশ্বনেতাদের সম্মুখে তিনি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ, বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের গভীর প্রত্যাশাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপ তুলে ধরেন। বর্তমানে দেশের সব রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে বলে মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। তিনি জানান, আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে-এটাই আমাদের লক্ষ্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার সব পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই তার সরকারের অভীষ্ট বলে উল্লেখ করেন তিনি। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে তিনি ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। আগামী দিনে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের হৃদয়ে তারুণ্যের এ অভ্যুত্থান নতুন অনুপ্রেরণার বাতিঘর হবে।

এ ভাষণে অর্থ পাচারের ইস্যুটিও প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি অবৈধ অর্থের প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ পাচার বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সম্পদ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিক কর কনভেনশন গৃহীত হওয়ার বিষয়টিও তার বক্তব্যে উপস্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া তিনি রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা নিয়েও আলোচনা করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, প্রধান উপদেষ্টা ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বর আগ্রাসনের বর্তমান বাস্তবতায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববাসীর উদ্বেগ ও নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের। একজন মানুষ হিসাবে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে। তাই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।’

বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসাবে প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছে, তা থেকে বাংলাদেশও যেমন সহযোগিতার বার্তা পেয়েছে, তেমনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করছে। নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে টানাপোড়ন চলছিল, এ সফরের ফলে সে সংকট অনেকটাই কমেছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, তা-ও প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল অতুলনীয়। তাদের মতে, বাংলাদেশ যে মুহূর্তে গণতন্ত্র উত্তরণের পথে রয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থেকে সহযোগিতা করছে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ নতুন দেশ গঠনে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বসভাকে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার বৈশ্বিক উপযোগিতা সম্পর্কেও স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থানের পেছনে সময়ক্ষেপণ না করে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সংকল্পকে সুদৃঢ় করার আহ্বান জানান। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণের ভিত্তিতে সামাজিক ব্যবসাকে অগ্রগণ্য করার ধারণা বিশ্বসভায় উপস্থিত সবার ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। বাংলাদেশকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার জন্য একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে ড. ইউনূসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম