Logo
Logo
×

বাতায়ন

কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন

Icon

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন

সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা দুটোই প্রয়োজন-তবে প্রয়োগের আগে জানতে হয়, কোথায় কোনটা প্রয়োগ করা উচিত। সেখানেই সংশ্লিষ্ট সংস্থা লাভ করে বিশ্বাসযোগ্যতা। নিরপেক্ষতার পূর্বশর্ত এ বিশ্বাসযোগ্যতা। তদন্তকারী সংস্থা কিংবা আদালত-সবাইকেই জনগণের বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। আর এ সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষভাবে স্থির করতে হয়-কোথায় তারা সক্রিয়তা দেখাবে, আর কোথায় নিষ্ক্রিয়তা! রাজনৈতিক সরকার তার কাজে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করতেই পারে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো শুধু ন্যায়বিচারের মানদণ্ড খুঁজবে, রাজনীতি করবে না। রাজনৈতিক সরকার সময়ের সঙ্গে বদলে যাবে; কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো পাকাপাকি থাকবে। এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার আশায়ই হয়েছে ছাত্র গণআন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান। এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের আগে ও পরে, বিশেষ করে আমেরিকার বিশেষ তৎপরতা লক্ষ করা গেছে সুসম্পর্ক গড়ার প্রত্যাশার ক্ষেত্রে, যা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে, প্রতিবেশী চীন প্রখর দৃষ্টি রাখছে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ওপর। প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার তারা বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে বসে আছে এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তারা জড়িয়ে আছে। তাই বাংলাদেশের পরিবর্তনের পথে তাদের তীক্ষ্ণ নজর থাকাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের ও তিনদিক থেকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও দৃষ্টি রয়েছে। অন্যদিকে, সদ্য পদ হারানো শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত তাই কিছুটা বিব্রতকর অবস্থানেই আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মাত্রাটা ঠিক কী অবস্থায় হবে, এখনো তারা তা স্থির করতে পারেনি। ভারত নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও দ্বিধায় আছে। উপদেষ্টাদের এক অংশের ধারণা, অর্থনৈতিক স্বার্থেই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই গর্ব করেছে। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশের নোবেলবিজয়ী। তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে পেয়ে বেশির ভাগ মানুষই সন্তুষ্ট। অন্যান্য উপদেষ্টাদেরও তারা গ্রহণ করে নিয়েছে; যেহেতু এ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন, দীর্ঘদিন থাকার ম্যান্ডেট তাদের নেই। তবে তারা যে কতদিন থাকবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ফলে রাজনৈতিক মহলে একটি প্রশ্ন বেশ জোরালো হচ্ছে-রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক সংস্কার প্রয়োজন; তবে সেই সংস্কারগুলো কার হাত দিয়ে হবে-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত দিয়ে, নাকি পরবর্তী নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে ছয়টি বিশেষ ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করার স্বার্থে সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত কমিশনও আছে। সেই কমিশনের প্রধান ইতঃপূর্বে (কমিশনে যোগদানের আগেই) সংবিধান সংশোধন নয়, বরং পুনর্লিখনের প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কাজেই এ সংস্কার কমিটি সংবিধান পুনর্লিখনের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাদের মতামত দিতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে সংবিধান পুনর্লিখন কিংবা সংশোধন কাজটি অতি ব্যাপক এবং তা অবশ্যই সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ-সদস্যের অনুমতিসাপেক্ষ একটি বিষয় হবে। অন্যদিকে, সংস্কার কমিটি করা হয়েছে বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্যও। বিচারব্যবস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা ও প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। আর তা করতে হলে সেই সংসদই হবে শেষ ভরসা। এসব প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে পাওয়া যায়নি। তবে এরই মধ্যে রয়টার্সের সঙ্গে ভোট নিয়ে কথা বলেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি জানিয়েছেন, আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এর আগে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি এ-ও বলেন, এ সরকারের সেই কাজে সমর্থন থাকবে সেনাবাহিনীর।

গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের সংবিধান সমুন্নত রেখেই গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে স্বপদে বহাল রেখে তার হাত দিয়ে সাংবিধানিক সুযোগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সংবিধানের ৯৩ ধারার বিধানমতেই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার সুযোগ করে দিয়েছেন। ৯৩ ধারার শর্ত হিসাবে এ অধ্যাদেশগুলো পরবর্তী সংসদের প্রথম কার্যদিবসে উপস্থাপন করতে হবে এবং ত্রিশ দিনের মধ্যে তা সংসদ কর্তৃক বাতিল কিংবা গৃহীত না হলে অধ্যাদেশটির কার্যকারিতা বাতিল হবে। সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুসারে সংবিধানের সংস্কার করার পরামর্শ ছাড়া প্রকৃত অর্থে বর্তমান সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের কোনো সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই। তা শুধু সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমেই করা সম্ভব। সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩ ধারা সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে। মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন, এ সময়ের মধ্যে দৈবদুর্বিপাকের কারণে নির্ধারিত ৯০ দিন মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তবে আরও ৯০ দিন হাতে পাওয়া যাবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের জন্য। ১২৩ ধারা অনুযায়ী, এটি হয়তো বলা যায়, বর্তমান ইউনূস সরকারের হাতে ১৮০ দিন সময় আছে এবং এর মধ্যেই রাষ্ট্রপতিকে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে ১৮০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কোনো কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেনি, বরং রাষ্ট্র মেরামতে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন বলে জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপতি সংবিধান স্থগিত করেননি এবং সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই এ অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। প্রশ্ন হলো, ১৮০ দিন পর তাদের বৈধতার প্রশ্নটি সামনে আসবে কিনা! অন্যদিকে, বর্তমান সংবিধানে ৭(ক) অনুচ্ছেদে সংবিধান স্থগিত করার উপায়ও বাতিল করে দিয়েছে। ৭(ক)-তে বলা আছে-‘এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বর্তমান সংবিধান স্থগিত করারও সুযোগ নেই; আবার সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৮০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিক কোন পথে এগোয়, এখন তা-ই দেখার পালা। ইতোমধ্যেই বিএনপি অতি শিগ্গির নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক দলও শিগ্গিরই রাজনৈতিক সরকার চাচ্ছে এবং রাষ্ট্র ও সংবিধানের সংস্কার রাজনৈতিক সরকারের হাতেই অর্পণ করার পরামর্শ দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কেননা, সংবিধান-আইন সবার জন্য প্রযোজ্য এবং শেষ কথা। যেহেতু সংবিধান এখনো বলবৎ আছে, তাকে পাশ কাটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক-দেড় বছর কিংবা তারও বেশি কীভাবে ক্ষমতায় থাকবে-তার উপায় বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে এবং তা জানার অধিকারও জনগণের রয়েছে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক

ceo@ilcb.net

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম