সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সর্বস্তরের বিচারকদের উদ্দেশে প্রথমবার দেওয়া অভিভাষণে আদালতের কার্যক্রম সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে কিছু যৌক্তিক পরামর্শ উপস্থাপন করেছেন। তার বক্তব্য সুধীমহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জাতির দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসাবে পৃথক সচিবালয় করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তাছাড়া সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। বিচার বিভাগে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান, জেলা জজ ও বিচারকদের দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা তাদের পেশাগত অযোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হবে। বিচারকাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিচারের গতি ও মানকে ত্বরান্বিত করতে দ্রুত ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি। তিনি মামলাজটকে বিচার বিভাগের বড় সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করেন। মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতাকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি।
গত ২১ সেপ্টেম্বর দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এছাড়া আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক-গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ-স্থায়ীকরণ-উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা এবং প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলিপ্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো, যা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব।’
তিনি আরও বলেছেন, শুধু বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না। সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোয় সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগও প্রণিধানযোগ্য। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে, সেজন্য তিনি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগের কিছু সংস্কার কার্যকারিতায় সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তার মতে, এ সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রমতে, এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে হয় না। নানা অজুহাতে লোকজন জমায়েত হয়ে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবুও কয়েকটি আইনবহির্ভূত নৃশংস ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা প্রচণ্ড পীড়াদায়ক। মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করার কারণ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন সব মানুষের প্রাণরক্ষা করল (সূরা মায়েদা, আয়াত ৩২)।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় লাভ, আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। গত ২২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৫ জনের বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগের ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৩৩ জন নিহত হন গণপিটুনিতে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৬ ও ৫১। বিজ্ঞজনদের মতে, আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর পরিস্থিতি, আইনের শাসনের অভাব এবং বিচারব্যবস্থায় নানা দুর্বলতার কারণে ঘটছে একের পর এক মব জাস্টিস। শুধু তাই নয়, মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি এবং মনোজগতে এক ধরনের সহিংসতার প্রতিফলনও ঘটছে এসব ঘটনায়।
ইতোমধ্যে শান্তিতে নোবেলজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে এ সরকারের গৃহীত উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদদের পরিবার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অসংখ্য মামলা রুজু হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলো পরিচালনার জন্য প্রসিকিউটর নিয়োগও দৃশ্যমান। আশা করা যায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিচার কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালিত হবে। দেশবাসী মনে করেন, যে কোনো সরকারের আমলে যারাই নানামুখী অপরাধে জড়িত, তাদের বিচার অনস্বীকার্য। যথাযথ যাচাই-বাছাই ও তদন্তসাপেক্ষে সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। হয়রানি বা ফাঁসিয়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায়ে নয়; অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির বিধান আইনের শাসনকে শক্তিশালী করবে। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতায় বশীভূত হয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশে কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযোগগুলো যথাযথ নিরপেক্ষ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণে ব্যর্থ হলে অভিযোগকারীদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি।
লক্ষণীয়, বিগত সরকারের সময়ে নামে-বেনামে বহু ধরনের গায়েবি মামলা আদালতে উত্থাপিত হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত ও বিচারকার্য পরিচালনায় আদালতকে এখনো হিমশিম খেতে হচ্ছে। আদালতের জনবল কাঠামো, পর্যাপ্ত তদন্তে বিলম্বের কারণে অসংখ্য নির্দোষ ব্যক্তি দীর্ঘ সময় কারা অভ্যন্তরে রয়েছে। পক্ষান্তরে অর্থ ও ক্ষমতাবান কথিত প্রভাবশালীদের আধিপত্যে দাগি অপরাধীরা কারামুক্ত হয়ে আবারও একই ধরনের অপরাধে যুক্ত হয়েছে। হত্যা-চুরি-রাহাজানি-দখল-অত্যাচার-অনাচারের এসব দৃষ্টান্ত আইনের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে থাকে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতকে অবশ্যই ঘুস-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে।
সুখের বিষয়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অফিস আদেশে জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি বর্ণনায় বলা হয়, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চার্জশিটের সার্টিফাইড কপি দাখিল করতে হবে। আবেদনপ্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন। আবেদনপ্রাপ্তির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর তার মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহের পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন। জেলা কমিটির কাছে যদি প্রতীয়মান হয়, মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে, তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই সুপারিশ মামলার এজাহার, চার্জশিটসহ আবেদনপ্রাপ্তির ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্যাদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনকে সর্বাধিক বিবেচনায় আনতে হবে। অপরাধীর যথোপযুক্ত শাস্তি একান্তই কাম্য। তবে নির্দোষ ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলায় জড়ানো আইনি ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সচেতন মহলের সেদিকে দৃষ্টি থাকবে, এটাই বাঞ্ছনীয়।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়