গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠন অগ্রাধিকার পাক
মুহাম্মাদ আনিছুর রহমান
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অনুকূল আবহাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা এ দেশের বৃহত্তম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জীবিকা ও কর্মসংস্থানের প্রধান উপায় হিসাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। ফলে ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গ্রামে বসবাস করে, যাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি কৃষি। সরকারি হিসাবমতে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। এসবের মধ্যে রয়েছে নানাবিধ অর্থকরী ফসল উৎপাদন, ফলের বাগান, মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগির খামার ও গবাদিপশু পালন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বস্তুত, এ গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, পুরো জাতির খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরাসরি কৃষি খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ের আরও অনেক সেক্টরে গ্রামীণ অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মূল্যবান অবদানের দাবিদার, যেমন কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাঁচামাল সরবরাহ করা তাদের মধ্যে অন্যতম একটি।
জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। একে তো নিকট অতীতে করোনা মহামারির ধকলে বৈশ্বিক মন্দার রেশ এখনো কাটেনি, তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে বাস্তবিক অর্থে এক অগ্নিপরীক্ষার দিকে ধাবিত করেছে। ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ধনী-গরিবের বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা অঞ্চলের একটি গ্রামের উদাহরণ দেওয়া যায়। কয়েক বছর আগে আমি জরিপ করে দেখেছি, সেখানে প্রায় তিনশ পরিবার রয়েছে, যাদের আয়ের মূল উৎস বৈদেশিক মুদ্রা। কারণ, সেখানে হাতেগোনা দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ সদস্য বিদেশে থাকে। অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র আয়ের উৎস হিসাবে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য রোজগারের মধ্যে যেমন কজন অধিবাসী অটোরিকশা চালানো ও নিকটবর্তী বাজারে ছোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখানে কৃষি কাজ বলতে বেশকিছু পরিবার শুধু নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ধানচাষ করে থাকে। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাশাপাশি অল্পসংখ্যক হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন করে, তবে সে সংখ্যাটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
এ প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামগ্রিক উন্নয়নে এক বিশেষ পরিবর্তন লক্ষণীয়; তাহলো-অর্থনীতিক উৎস কৃষিনির্ভর থেকে পর্যায়ক্রমে বের হয়ে বহুলাংশে বৈদেশিক মুদ্রানির্ভর হয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব গ্রামীণ অবকাঠামোসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, গ্রামীণ ক্রমবিকাশের এই যে ধারা, তা কি সামগ্রিক দিক বিবেচনায় মঙ্গলজনক? বিশেষ করে টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠিতে? এক কথায় জবাব হবে ‘না’। বরং এ অব্যাহত ধারা সামগ্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের অন্তরায় হিসাবে গণ্য হবে!
সংক্ষেপে এর কয়েকটি কারণ বলছি। বৈদেশিক মুদ্রা হচ্ছে একটি সাময়িক আয়ের উৎস ও সমাধান মাত্র। এটি গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে দীর্ঘমেয়াদে তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে না। প্রবাসীরা দেশে যে আয় পাঠায়, তা মূলত তাদের দৈনন্দিন পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে চলে যায়। অতিরিক্ত কারও কিছু জমা হলে, সেটি কোনো অনুৎপাদনশীল খাত বিশেষ করে বাড়িঘর নির্মাণের কাজে বিনিয়োগ করে ফেলে। ফলে প্রবাসীরা দেশে ফিরলে অনেকের জন্য পুনরায় বেকারত্ব ও নির্ভরশীলতার জীবনের ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আজকাল বিদেশে সুবিধা করতে না পেরে কেউ কেউ শূন্য হাতে ফিরে আসছে।
বিদেশনির্ভর অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিরূপ প্রভাব হলো, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্ভরশীলতা ও বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ দু-একজনের আয়ের ওপর নির্ভর করে একটি পরিবারের বাকিরা কর্মহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের যে একটি ঐতিহ্যগত অবদান ছিল, সেটি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। তাছাড়া প্রবাসীদের সঞ্চয় দিয়ে যত্রতত্র কৃষিজমি ভরাট করে আবাসন নির্মাণ করার ফলে একদিকে যেমন কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে অপরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যও ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। আর এ চিত্র শুধু একটি গ্রামেরই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা আশপাশে আরও অনেক গ্রামজুড়েই দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে চলতে থাকলে এটি যে এক সময় গ্রামীণ বাংলার সাধারণ চিত্র হয়ে উঠবে না, তা কি বলা যায়?
তবে কেন প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এ বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাতকে আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারছি না, কী সে বাধা? বলা বাহুল্য, সরকারি-বেসরকারি উভয়পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতার কমতি নেই। উন্নত বীজ, প্রশিক্ষণ, দিকনির্দেশনা ও আর্থিক সাহায্যসহ অন্যান্য যা যা দরকার সবই করে যাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এসব প্রচেষ্টার অনেক সুফলও অবশ্য আমরা দেখতে পাই। বর্তমানে এ খাতের বিপুল সম্ভাবনা অনুধাবন করে বহু শিক্ষিত ও উদ্যমী বেকার তরুণ-তরুণী এগিয়ে আসছেন। তারা বিনিয়োগ করছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প; যেমন-ডেইরি, পোলট্রি, মৎস্য, ফল ও ফুলের বাগান, নার্সারি, কুটির শিল্প ও কাছাকাছি আরও অনেক নিত্যনতুন খাতে। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা তাদের অনেক সফলতার গল্প শুনতে পাই।
তারপরও বলব, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও সম্ভাবনাময় এ খাতটির উন্নতি কিন্তু সামগ্রিকভাবে আশানুরূপ নয়। তার প্রমাণ তরুণদের গণহারে বিদেশমুখিতা ও সেই সঙ্গে জাতীয় আয়ে কৃষি খাতের নিম্নগামী অবদান। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বিগত কয়েক বছরের তথ্যানুসারে, এ বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বছরে গড়ে ১০ লাখেরও বেশি। অন্যদিকে, সরকারি এক হিসাবে বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ, অথচ সেটি এক সময় ৬০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
অতএব, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, আজকে স্বাধীনতা-উত্তর অর্ধশতাব্দী বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রামীণ অর্থনীতির এ অপার সম্ভাবনাকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো যায়নি। অথচ বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি এ খাত থেকে অভাবনীয় সাফল্য আদায় করছে। এ খাতের ওপর তাদের আকর্ষণীয় ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কিত জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালাতে বিশেষ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব কর্মপরিকল্পনাতে এককেন্দ্রিক কৃষি উৎপাদনকে মূলত প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের বাকি মানদণ্ডগুলো প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নি; যেমন মানবসম্পদের উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানোন্নয়ন, পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। ফলে স্টেকহোল্ডারদের মাঝে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ও আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি।
পরিশেষে বলতে চাই, গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও নবোদ্যমে জাগিয়ে তুলতে হলে বিদ্যমান কৃষি খাত ও গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। সেটা করতে হলে এককেন্দ্রিক উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে ও সামঞ্জস্য বিধান রেখে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন সময়ের দাবি।
এ মাস্টারপ্ল্যান আগে গৃহীত সব ধরনের প্রচেষ্টাকে সমন্বয় করে একটি টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা প্রদান করবে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মতো অন্যান্য আরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন, তথা কৃষি খাত সম্পর্কিত বিভাগগুলো ও সহায়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এক ছাতার নিচে সমন্বিতভাবে কাজ করার নীতিমালার ওপরও বেশ জোর পদক্ষেপ থাকবে।
মুহাম্মাদ আনিছুর রহমান : পরিকল্পনাবিদ ও উন্নয়নবিষয়ক গবেষক; সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা, কিং ফাহাদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
anis.crp@gmail.com