ক্যাম্পাস কেন জুলুমের রাজত্বে পরিণত হয়
ড. মোহাম্মদ কামরুজ জামান ভূঁইয়া
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। সেশনজটই এ দীর্ঘসূত্রতার কারণ। এরপর ২০০২ সাল থেকে শিক্ষকতায় আছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময়ের মধ্যে দেখেছি অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব স্বচক্ষে দেখার সুযোগ বা দুর্ভাগ্য হয়েছে বহুবার বহু প্রেক্ষাপটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চাই।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রধানত চারটি দল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে : আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি আর জামায়াতে ইসলামী। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থাকা এবং বর্তমানে দেশের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ চার দলের রাজনৈতিক প্রভাব এবং তাদের ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরাসরি দেখেছি এবং দেখছি। এ দলগুলোর মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একমাত্র জাতীয় পার্টি। কারণ, এ দলের প্রধান মরহুম রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চাননি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে। ফলে জাতীয় পার্টির শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্য যে কোনো দলের শাসনামলের চেয়ে বিশৃঙ্খলা, ছাত্র আন্দোলন, মারামারি ও হতাহতের ঘটনা কম ছিল। এর সুফল তখনকার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই পেয়েছেন।
কিন্তু অন্য দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চেয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে। আর এর জন্য ছাত্রদের দেওয়া হয়েছে অনৈতিক অনেক সুযোগ-সুবিধা। ফলে ছাত্রনেতারা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগ এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ছাত্রনেতাদের ছিল এবং আছে অযাচিত হস্তক্ষেপ। হলগুলো যেন হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একেকটি ‘ক্যান্টনমেন্ট’। এখানে ছাত্রদের কথায় আইন চলে, উপাচার্য চলেন, বাকিদের কথা নাইবা বললাম। ফলে যুগ যুগ ধরে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চলে আসছে নৃশংস সব হত্যা, নির্যাতন, জোর-জুলুমের রাজত্ব। আর এ ছাত্ররাই পরবর্তীকালে রাজনৈতিক প্রভাবে চাকরি পাচ্ছে প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে; হচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি। ফলে অন্যায় আর জুলুমের ক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হয়েছে বহুগুণে।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, এ অনাচারের পেছনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেকাংশে দায়ী, যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। কারণ, ছাত্রজীবন থেকে অদ্যাবধি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখে এসেছি, বিভিন্ন পদ-পদবির জন্য সম্মানিত শিক্ষকরা ছাত্রদের দ্বারস্থ হয়েছেন, ছাত্রদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেছেন। ফলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তারা প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা, আমি যার অনুগ্রহ গ্রহণ করব, তার ওপর তো আমার নীতিকথা ও কর্তৃত্ব চলে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে ছাত্ররা হয়েছে বেপরোয়া। ওরা যেমনটি চায়, যেভাবে চায়, সেভাবেই চলে বিশ্ববিদ্যালয়। এর একটি উদাহরণ দেই। কোনো একসময়ে একটি হলের প্রভোস্টকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার হল কেমন চলছে?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘হল চলতে দিলে চলে, চালাতে গেলে চলে না।’ আবার একাধিক উপাচার্য দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ছাত্রনেতাদের দুর্ব্যবহারের কারণে ইচ্ছা হয় এক্ষুনি ওই চেয়ার ছেড়ে চলে আসি, কিন্তু পারি না!’
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ছাত্ররা এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে পড়ে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিও ক্ষমতার চেয়ারে থেকে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পরিবহণ হিসাবে অধিকাংশ শিক্ষকের নিত্যবাহন হয় অটোরিকশা, সেখানে কী করে তারই ছাত্রনেতা তার সামনে নিত্যনতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি হাঁকায়! আর সাম্প্রতিক কিছু ছাত্র নৃশংসতার ঘটনা আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে, কাঁদিয়েছে। এ নির্মম নিষ্ঠুরতা আজ নতুন নয়, ছাত্রজীবন থেকেই দেখছি।
এসব অনাচার থেকে মুক্তি কোথায়? আমার মতে, এ অনাচারের অধিকাংশের মুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেই লুকিয়ে আছে। অতীতে যদি কোনো শিক্ষক কোনো পদ-পদবির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদী না করতেন, কোনো ছাত্রনেতার দ্বারস্থ না হতেন, কোনো ছাত্রনেতার অনুকম্পা গ্রহণ না করতেন, তাহলে পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত না। আর এখনো যদি অতীতের মতোই করা হয়, তাহলে মিছেই আন্দোলন, মিছেই পটপরিবর্তন। যে লাউ, সেই কদুই থাকবে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার কী প্রয়োজন একটি পদের জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তি আর ছাত্রদের দ্বারস্থ হওয়ার? আমার কীসের এত খায়েশ, কীসের এত অভাব? আর যদি প্রশাসনিক দায়িত্ব পেয়ে তা যথাযথভাবে পালনে পদে পদে অনৈতিক বাধাগ্রস্ত হতে হয়, তাহলে কেন আমি শিক্ষক হিসাবে প্রতিবাদী হতে পারি না? কেন আমি সেই অপমান আর লাঞ্ছনার পদ ছেড়ে আসতে পারি না? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ন্যায় ও নীতির পথে অটল-অবিচল থাকলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে যুগে যুগে এত মেধাবী মুখের করুণ মৃত্যু হয়তো হতো না। এত পৈশাচিক ঘটনা, এত নিষ্ঠুরতা, এত জুলুম হয়তো হতো না।
আরও দুঃখজনক, এযাবৎকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত শিক্ষার্থী হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই গ্রামের নিতান্ত গরিব পরিবারের অসহায় সন্তান। কোনো শিক্ষকের সন্তান, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সন্তান এসব নির্মমতার শিকার হয়েছে, এমন ঘটনা একেবারেই নগণ্য। তাই হয়তো সেসব শিক্ষক আর রাজনীতিকদের হৃদয় এসব হৃদয়বিদারক ঘটনায় কাঁদে না! তাদের মন বা বিবেক এর প্রতিকারের জন্য প্রতিবাদীও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির দুষ্ট প্রভাব না থাকলে সমাজে শান্তি, ন্যায়, ইনসাফ কায়েম করা অনেক সহজ হতো। কেননা, তাতে করে কোনো ছাত্র অনৈতিক সুযোগ পেয়ে অমানুষ হতো না, অবাঞ্ছিত ক্ষমতা আর অনৈতিকভাবে অঢেল টাকার মালিক হতো না। আর আদর্শ ছাত্র চাকরি পেয়ে, জনপ্রতিনিধি হয়ে, ব্যবসায়ী হয়ে অনৈতিক কাজে জড়িত হতো না।
তাই বলতে চাই, বন্ধ হোক এ অনাচার, জাগ্রত হোক জাতির বিবেক শিক্ষকসমাজ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও আদর্শ চর্চার সঠিক পরিবেশ ফেরাতে চলুন সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব অনিয়ম-অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। বর্জন করি সব তোষামোদী, পরিত্যাগ করি অনিয়মের শৃঙ্খলাবদ্ধ সব পদ-পদবি। আমার মেধা যেন অপব্যবহার না হয়। আমার প্রতিজ্ঞা হোক, আমি শিক্ষক হিসাবে নিজে কোনো অনৈতিক, অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেব না এবং অন্য কাউকেও নিতে দেব না।
ড. মোহাম্মদ কামরুজ জামান ভূঁইয়া : প্রফেসর, কৃষি ও ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ