Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আরও যা করা প্রয়োজন

Icon

ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আরও যা করা প্রয়োজন

আমি আমার আগের লেখায় উপজেলা হাসপাতালের উন্নয়নকল্পে কিছু দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেছি। এবার উপজেলার হাসপাতালগুলোর একটি চিত্র বর্ণনা করছি।

১. উপজেলার মেডিকেল অফিসারের সংকট প্রবল। ৩৯ ও ৪২ জনের মতো একবারে অনেক ডাক্তার নিয়োগ না দিয়ে প্রতি বিসিএসে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। ২. উপজেলা হাসপাতালে এমনিতেই মেডিকেল অফিসার সংকট। তার ওপর দেখা যায়, অনেকে বিভিন্ন উপজেলা থেকে জেলায় সিভিল সার্জন অফিসে লোকাল অর্ডারে কাজ করেন। এতে উপজেলায় ডাক্তার সংকট আরও বেড়ে যায়। ৩. হাসপাতালে পর্যাপ্তসংখ্যক স্যাকমো, নার্সিং স্টাফ, ওয়ার্ডবয় ও ক্লিনার নেই। ৪. উপজেলা হাসপাতালে রোগীরা আসে ওষুধ নিতে। অনেক সময় একই দিনে ৪/৫টি টিকিট কেটে বারবার আসে অথবা হাসপাতালের আশপাশে বাসা হলে প্রতিদিনই আসে। ওষুধপ্রার্থীদের ভিড়ের কারণে যারা আসলেই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসে, সেসব রোগীকে ঠিকমতো সময় দেওয়া যায় না। ৫. হাসপাতাল কোয়ার্টারগুলো বসবাসের অযোগ্য। ৬. হাসপাতাল প্রাঙ্গণ এবং হাসপাতাল কোয়ার্টারে নিরাপত্তার অভাব। ৬. অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নিয়মিত পাওয়া যায় না। হয় অ্যাম্বুলেন্স নেই অথবা অ্যাম্বুলেন্সটি আউট অব অর্ডার অথবা ড্রাইভার থাকে না।

জেলা হাসপাতাল

১. বর্তমানে জেলা হাসপাতালগুলোয় ২৫০টি বেড রয়েছে। এই বেডসংখ্যা ২৫০ থেকে ৫০০-তে উন্নীত করা উচিত। ২. একটি আদর্শ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যে গঠন, এর ওপর ভিত্তি করে কিছুটা বড় পরিসরে জেলা হাসপাতালগুলোকে পুনর্গঠন করা উচিত। ৩. অতিরিক্ত আরও কিছু সেবার প্রয়োজন : ডায়ালাইসিস ইউনিট, অত্যাধুনিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার, প্রতিটি জেলা হাসপাতালে একটি নার্সিং সেন্টার, একটি কেয়ার গিভার সেন্টার, একটি ডে-কেয়ার সেন্টার, কাউন্সিলিং সেন্টার, ব্লাড ব্যাংক এবং ২৪ ঘণ্টা ইনভেস্টিগেশন সেন্টার।

বিভাগীয় শহরে জেনারেল হাসপাতাল তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন-ঢাকা সিটি : মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, ডেমরা। সিলেট সিটি : দক্ষিণ সুরমা, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জাংশান পয়েন্ট। চট্টগ্রাম : পাহাড়তলি ,পতেঙ্গা-ডবলমুরিং থানা, বায়েজিদ বোস্তামি-অক্সিজেন ইত্যাদি।

মেডিকেল কলেজ

১. মেডিকেল কলেজগুলো জনসাধারণের আশানুরূপ সার্ভিস দিতে পারছে না। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে যেসব বিষয়ের আধুনিকায়ন করতে হবে : ১. অত্যাধুনিক ২৪ ঘণ্টা ইনভেস্টিগেশন সেন্টার। ২. ২৫ শতাংশ বেড সংখ্যা বাড়ানো, ৩. মেডিসিন বিভাগের পরিসর আরও বাড়াতে হবে। ৪. মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে একটি এইচডিইউ, আইসিইউ করতে হবে। ৫. মেডিসিন বিভাগে জেরিয়াট্রিক ইউনিট করতে হবে। ৬. মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, ইকো, এন্ডোস্কপি ইত্যাদি টেকনিক্যাল ইউনিটগুলো থাকতে হবে। ৭. ইমার্জেন্সি বিভাগের পরিসর বাড়িয়ে ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সে পরিণত করতে হবে। ৮. ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের সঙ্গে একিউট মেডিসিন ওয়ার্ড করতে হবে। ৯. মেডিকেল কলেজের সঙ্গে শিক্ষক ও কনসালটেন্টদের আবাসন করতে হবে।

ইনস্টিটিউট

ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনাল মেডিসিন এখন সময়ের দাবি। দেশে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর ওপর আলাদা আলাদা ইনস্টিটিউট হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এগুলো গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি ইনস্টিটিউটের রোগীদের চিকিৎসা করতে অনেক সময় মেডিসিন এক্সপার্টের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ওইসব ইনস্টিটিউটে মেডিসিন অধ্যাপক নেই, এমনকি কনসালটেন্টও নেই। তাই প্রতিটি ইউনিটে একটি মেডিসিন ওয়ার্ড, সেই সঙ্গে মেডিসিনের অধ্যাপক ও কনসালটেন্টসহ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। সবশেষে বলি, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশে এত মেডিসিনের রোগী অথচ একটি ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট নেই। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বয়স্ক মানুষ এবং বয়স্ক রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। একই মানুষ বিভিন্ন অঙ্গের রোগে ভুগছে। পেন্ডেমিক সিচুয়েশনগুলো লেগেই আছে। এতকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনাল মেডিসিন এবং রিসার্স এখন সময়ের দাবি।

ডাক্তারদের মূল্যায়ন

ক. বিসিএস পাশ করার পর নতুন পোস্টিংয়ের আগে ডাক্তারদের কমপক্ষে দুই মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। তারা জীবনভর লেখাপড়া করেছেন, এখন বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ শুরু। তাকে গ্রামেগঞ্জে রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। রোগীকে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হাসপাতাল স্টাফদের সঙ্গে চলতে হবে। জনপ্রতিনিধি যেমন-ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সঙ্গে চলতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সর্বোপরি উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে চলতে হবে। সীমিত সুবিধার মাঝে রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে আস্থাশীল সিদ্ধান্ত দিতে হবে। তাই তাদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার আগে একটি ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন।

খ. বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ডাক্তারদের ট্রান্সফার ও পোস্টিংয়ের কার্যকর কোনো বিধিমালা নেই। যেটি আছে সেটিও পালন করা হয় না। ডাক্তাররা মূল্যায়িত হন না। উপজেলায় পোস্টিং হওয়ার পরে তারা যদি নিজ উদ্যোগে বদলি না হন, তাহলে সারা জীবন একই উপজেলায় কাটাতে হয়। অথবা সরকার যদি নিজ থেকে বদলি করে, তাহলে দেখা যায় এর চেয়ে নিুস্তরের কম সুবিধাজনক স্থানে বদলি করা হয়। এটা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। উপজেলা থেকে কোনো ডাক্তার এফসিপিএস বা এমডি পার্ট-১ পাশ করার পরও তাদের ট্রেনিং পোস্টে আনা হয় না। এসব কারণে ডাক্তাররা হতাশায় নিমজ্জিত হন।

গ. চাকরির সময়কাল যত বাড়বে, ডাক্তারদের পোস্টিং ততই কেন্দ্রমুখী হওয়া উচিত। শহর থেকে দূরতম উপজেলা থেকে শহরের নিকটতম উপজেলা, সেখান থেকে জেলা শহর বা বিভাগীয় শহর। সর্বশেষ মেডিকেল কলেজ বা কোনো ইনস্টিটিউটে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এ ধরনের স্টেপ-আপ প্যাটার্নের পোস্টিংয়ের কোনো রোডম্যাপ আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নেই।

ঘ. পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার পর সময়মতো প্রমোশন হয় না। যারা অধ্যাপক হলেন, তাদেরকে প্রথম বা দ্বিতীয় গ্রেড দেওয়া হয় না। এভাবে স্বাস্থ্য সার্ভিসের অনেকে বঞ্চনার শিকার হন।

ঙ. চাকরির দুই বছর পার হওয়ার পর ডাক্তারদের একটি অপশন ব্যবস্থা থাকা দরকার। সেখানে তারা তাদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনার কথা বলবেন।

চ. চাকরির দুই বছর পর ৩০-৪০ শতাংশ ডাক্তারকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করার সুবিধা দিতে হবে।

ডাক্তারদের নিরাপত্তা

ডাক্তাররা সব সময় একটা নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করেন। তাই মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন সাবসেন্টার পর্যন্ত সব জায়গায় ডাক্তারদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এই নিরাপত্তাব্যবস্থা হবে: ১. Well structured, ২. প্রতিটি হাসপাতালে রোস্টার করে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে হবে। ৩. প্রতি রোস্টারে প্লাটুন পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দিতে হবে। ৪. হাসপাতালের ভেতরে আনসার বাহিনী দিতে হবে। ৫. ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সব জায়গায় এই নিরাপত্তা দিতে হবে। ৬. ডাক্তাররা নিরাপত্তা পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত ও লেজিসলেটিভ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হলে তাও নিতে হবে। ৭. কেবল রোগী এবং রোগীর অ্যাটেনডেন্টের কথার ওপর ভিত্তি করে কোনোভাবে ডাক্তারদের পুলিশি ব্যবস্থায় দেওয়া যাবে না।

অধ্যাপক ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী : সাবেক ইউনিট প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম