সাধারণ মানুষের ভাবনা বিবেচনায় রাখুন
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
স্বৈরাচার আবিষ্কার, সরকার পতনের একদফা-এসব ইস্যু শুরু থেকে ছাত্রদের বিবেচনায় ছিল না। বিবেচনায় ছিল সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার সংস্কার করে বৈষম্যমুক্ত অবস্থা তৈরি করা। পুরোনো দাবিই নতুন করে উপস্থাপিত হয়েছিলমাত্র। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ সরকার আলোচনা করে, দাবি মেনে আন্দোলনের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরাতে পারত। কিন্তু স্বৈরাচারী মনোভাবে সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করার কারণে শেষে সব লেজেগোবরে হয়ে যায়। দিনে দিনে সামগ্রিকভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এর শেষ পরিণতি তো আমরা দেখলামই।
কিন্তু আমি মনে করি, এদেশের মানুষের শেষ পরিণতি দেখার এখনো অনেকটা বাকি আছে। শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত অনেকের মধ্যে সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যেই নানা কারণে হতাশা দেখা দিচ্ছে। দুদিন আগে আমাকে চিন্তিত করে তুলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ুয়া এক ছাত্রের হতাশ প্রতিক্রিয়া। ছেলেটি আমার সঙ্গে ফেসবুকে আছে। আমার বই ওদের রেফারেন্স হিসাবে পড়তে হয়। এসব নানা কারণেই আমার প্রতি হয়তো একটু বাড়তি শ্রদ্ধাবোধ ওর রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেটি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ওর সরব পদচারণা। আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিল। ছাত্রলীগের হাতে নিগৃহীত হয়েছে কয়েকবার। আন্দোলনের সময় টেলিফোনে মাঝেমধ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। সেসময় আমার অনেক কলাম নাকি ওদের সাহস জুগিয়েছিল।
ওর ভাষায়, আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররাই কোটার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন করতে পেরেছে। অন্য কোনো পক্ষের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সর্বত্র বৈষম্য নিরসনের যে আকাক্সক্ষা ছিল, এক মাস বয়সি অন্তবর্তীকালীন সরকার সে আশা পূরণের পথে হাঁটছে বলে ওর মনে হচ্ছে না। সরকারি আচরণে এখনো বৈষম্য পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এমন অবস্থা থাকলে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয় গতি পাবে কেমন করে! বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। শুরু থেকে ঘোষণা শুনেছিলাম-বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলতেন-কোনো দলীয় বলে চিহ্নিত কাউকে এসব পদে পদায়ন করা হবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বেশ কয়েকটি পদ পূরণ করা হলো। ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তাদের অনেকেই হয় বিএনপি, নয়তো জামায়াত রাজনীতি ঘরানার মানুষ। বৈষম্যের শিকার হলেন দলনিরপেক্ষ অনেক গুণী মানুষ, যারা যথেষ্ট যোগ্য ও সৎ হওয়ার পরও দলীয় সরকারগুলোর আমলে কোনো মূল্যায়ন পাননি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও তারা উপেক্ষিত হচ্ছেন। এভাবে কি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায়?
সরকার কোন পথে হাঁটছে বোঝা যাচ্ছে না। আমরা শিক্ষক। আমরা আমাদের নীতিতেই কথা বলতে ভালোবাসি। গণ-আন্দোলন পরিকল্পনা করে হয় না। সময়ের বাস্তবতা একে নিয়ন্ত্রণ করে বা এগিয়ে দেয়। যেভাবেই হোক, মৃত্যুঞ্জয়ী শিক্ষার্থী ও জনগণ গণ-আন্দোলন সফল করেছে। সরকারের পতন ঘটেছে। এরই পরবর্তী বাস্তবতায় অন্তবর্তীকালীন সরকারও গঠিত হয়েছে। এরপর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাদের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো। কিন্তু যেভাবে জেলায় জেলায় মতবিনিময়ের নামে শিক্ষার্থী নেতারা ছুটছেন, সেটি এ সময়ে শিক্ষার্থীদের কাজ বলে মনে হয় না। সংকট সামনে এলে এদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যে জেগে ওঠে, তা তো অতিসম্প্রতি আমরা প্রত্যক্ষই করলাম। তাহলে কী প্রয়োজন ক্লাস-পরীক্ষা ফেলে এসব জনসংযোগের জন্য ছোটাছুটি করা? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, এ বেলা ছাত্রদের দিয়ে নাকি কোনো পক্ষ নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে আমরা বলব, এর ফল খুব ভালো হবে না। মাথায় রাখতে হবে, সমন্বয়ক-যাদের মুখ বেশি পরিচিত-তারা সবার কাছে অবিসংবাদিত নেতা নন। ঢাকা ছাড়াও নানা অঞ্চলে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমন্বয়ক রয়েছেন। আন্দোলনে তাদেরও অবদান কম নয়। ফলে অনেকেই জিরো হয়ে যেতে চাইবেন না। কিন্তু আমরা চাই না কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে এ ঐক্যবদ্ধ ছাত্রশক্তির মধ্যে ফাটল ধরুক।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্য, এখনো সমাজের নানা ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। মানছি, বিপ্লবের আবেগ-উচ্ছ্বাস, কষ্ট উত্তেজিত করে তুলেছিল শিক্ষার্থীদের। ওরা অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু বলে থাকেন, তার নিয়োগকর্তা শিক্ষার্থীরা; সুতরাং তারই দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক আচরণে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এক্ষেত্রে যৌক্তিক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাজনীতি করা শিক্ষকদের অনেকে শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছেন কোনো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে তাদের অনেককে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের ইতিহাস চেতনার অভাব রয়েছে, তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগকে এক করে ফেলছেন। এমন হলে তা হবে ইতিহাসের প্রতি অন্যায় করা। ইতিহাসকে আমরা নিজেদের প্রয়োজনে অনেক কাটাছেঁড়া করি। কিন্তু সাময়িক সংকটে পড়লেও যথাসময়ে ইতিহাস তার নিজের জায়গায় ঠিকই দাঁড়াবে। শেখ হাসিনার অন্যায় বা ভুলে যদি আওয়ামী লীগকে সাইড লাইনে দেওয়ার চিন্তা থাকে, তাহলে বর্তমান বিএনপির মূল্য থাকে কোথায়? কারণ জিয়াউর রহমান নিজ গড়া বিএনপি সরকারে শাহ আজিজের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ক্ষমতাকালে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর নেতাদের। পূর্বসূরিদের এমন অপরাধে এ সময়ের বিএনপি ও বিএনপি নেতাদের কি আমরা অস্বীকার করব? মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের দোসর ছিল। তাই বলে কি বর্তমানের জামায়েতে ইসলামী ও তাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দাঁড়াব? তারা কি বক্তব্য-আচরণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন?
সম্প্রতি যুগান্তরে প্রকাশিত একটি লেখায় জানলাম, স্কুল-কলেজে সরকারি বেসরকারি, এমপিওভুক্ত ও এমপিওভুক্ত নয় এমনসব ইস্যুতে শিক্ষকদের মধ্যে নানা বৈষম্য বিদ্যমান। অতীতের কোনো সরকারই এ সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেনি। বর্তমান সরকারও যদি নীরব থাকে, তবে এ ধারার বৈষম্য থেকে কেমন করে রক্ষা মিলবে?
আওয়ামী লীগ আমলে আমরা অনেক লেখাতেই সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করতাম। লিখতাম, কল্পতরুর মগডালে বসে নিজেদের মূল্যায়ন করবেন না। অচলায়তন ভেঙে নেমে আসুন। পথে-ঘাটে, বাজারে, চায়ের দোকানে বসে সাধারণ মানুষের কথা শুনুন। দেখুন আপনাদের জনপ্রিয়তা কতটা নেমে গেছে। ১০ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত আমার লেখায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখার অনুরোধ ছিল। সেখানে সরাসরি বলেছিলাম, সরকারের এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার সূচক এখন নিম্নমুখী। কিন্তু অর্বাচীনদের লেখাকে কে কবে গুরুত্ব দিল!
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মাত্র এক মাস অতিবাহিত করেছে। এখনই সরকারের কাছ থেকে সবকিছু আশা করা বাতুলতা হবে। কিন্তু তবুও চোখ-কান খোলা রাখা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ ধাপে সাধারণ মানুষ যে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, তা বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি শেখ হাসিনা সরকার। দুটি ভয়ংকর জালিয়াতির সাধারণ নির্বাচন, কঠোর দলীয়করণ, অভ্রভেদী দুর্নীতি আর নিত্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। আমরা আমাদের লেখায় বহুবার সরকার পরিচালকদের বলেছি, সাধারণ মানুষের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন। কিন্তু যে সরকারের নিয়ন্ত্রকদের পা মাটিতে থাকে না, তারা এসব পরামর্শের মূল্য দেবেন কেন!
আমরা চাই না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের চারপাশে অচলায়তন তৈরি করুক। অচলায়তন ভেঙে সাধারণ মানুষের ভাবনাকে বিবেচনায় রাখুন। সরকার গঠনের দুসপ্তাহ পর টেলিভিশনের খবরে কাঁচাবাজারের হালচাল দেখাচ্ছিল। বাজারে যথারীতি সবকিছুরই দাম বেড়েছে। একজন নিম্ন-আয়ের মাঝবয়সি ক্রেতার মন্তব্য ছিল, ‘দুর্নীতি করে সব নষ্ট করে ফেলেছিল হাসিনার আমলে। এখন একটু কষ্ট হলেও নতুন সরকারকে সময় দিতে হবে।’ ভালো লাগল মানুষের সহনশীলতা ও বাস্তব অবস্থাকে মেনে নেওয়ার শক্তি দেখে। এবার নতুন সরকারের এক মাস পার হওয়ার পর টিভি চ্যানেলে প্রতিক্রিয়া ঘুরে যেতে দেখলাম। কাঁচাবাজারে মন্তব্য নেওয়া হলো এক মহিলা ক্রেতার। পোশাকে কথায় তেমন সচ্ছল মনে হলো না। তার মন্তব্য, ‘সবকিছুরই তো দাম চড়া। তাইলে দেশ স্বাধীন হইয়া কী লাভ হইল! যেই লাউ সেই কদু।’ সাধারণ মানুষ কিন্তু সাধারণ চোখেই দেখে। রাজনীতি ও অর্থনীতির মারপ্যাঁচ তারা বোঝে না। এক মাস চোখে পড়ার মতো ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য খুবই কম সময়। কিন্তু জীবন-জীবিকার সংকটে কষ্টে থাকা মানুষ এসব গুনতে যায় না। তবে মানতে হবে, তাদের মন্তব্যে জনচিন্তার প্রকাশ থাকে।
এ সরকার যে রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে না-এ বিবেচনা বিপুলসংখ্যক মানুষের আছে। কিন্তু দীর্ঘকাল এদেশের মানুষকে বেশি কষ্ট দিয়েছে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সব ক্ষেত্রে দলীয়করণের বাড়াবাড়ি। এ কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে দলনিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি পাবে বলে ভেবে নিয়েছিল মানুষ। তেমন আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল তাদের। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা তা দেখছি?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com