পুলিশ যখন নিষ্ক্রিয়ভাবে উপস্থিত
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে, তার এক ধরনের মূল্যায়নের প্রয়াস দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে। এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রেক্ষাপট বিচারে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি সম্ভব, সে বিবেচনাও কম পরিলক্ষিত নয়। যে কোনো বড় পরিবর্তনের পর স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে একটা যৌক্তিক সময় লাগে বৈকি। কোন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে, সেটাও বিবেচ্য। জুলাইয়ের মধ্যভাগ থেকে আগস্টের শুরু পর্যন্ত যেসব ঘটনার ভেতর দিয়ে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা তো নতুন অভিজ্ঞতা। এ অঞ্চলের ইতিহাসে এমনি ধারার আন্দোলন এবং নিষ্ঠুরভাবে সেটা দমনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা সম্ভবত আর নেই। এটা গবেষণারও বিষয় বৈকি। এর মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণকারীরাও নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। এটা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, সেটা তারাও বোধহয় ক্রমে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। এ অবস্থায় মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তাদের কাজের মূল্যায়ন করে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যাওয়া সংগত নয়।
১৫ বছরেরও বেশি সময় টানা দেশ পরিচালনাকারী সরকার, প্রশাসন ও দল এখন পলাতক কিংবা কোণঠাসা। প্রশাসনের কথা অবশ্য আলাদা করে বলতে হয়। তাদের সবাই তো আর চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন না। সবাই দলবাজ হয়ে গিয়েছিলেন কিংবা অপরাধে লিপ্ত ছিলেন, তাও নয়। তবে তাদের এমন একটা ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যা খুবই গণবিরোধী। বিশেষ করে পুলিশকে অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া হয়েছিল। কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এত বড় ক্ষতি দুনিয়ার আর কোথায় হয়েছিল, সেটা গবেষণা করে দেখার বিষয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তাদের ব্যবহৃত হওয়ার ধরন দেখে সেটা যে কেউ সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারবে। এ ব্যাপারে ভিন্নমত জানানোর সুযোগ খুব কম। এ অবস্থায় পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার তরফ থেকে ভয়াবহ কিছু হামলারও শিকার হয়েছে। সিংহভাগ থানা হয়েছে আক্রান্ত। আগ্নেয়াস্ত্র লুট, গাড়িসহ নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আগ্নেয়াস্ত্র হয়তো উদ্ধার করা যাবে; কিন্তু নথিপত্র? গাড়িসহ বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি মেরামত ও প্রতিস্থাপনে ব্যয় বাড়বে রাষ্ট্রের। পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের পরিকল্পনাও রয়েছে। বিডিআরে বিদ্রোহের পরও তার পোশাক বদলানো হয়েছিল। তাতে একত্রে অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনাও ছিল নজিরবিহীন। এরপর একই সরকারের আমলে পুলিশের ভাবমূর্তির ক্ষতিটাও ভয়াবহ। কীভাবে এই ক্ষতি পূরণ করা হবে, সে প্রক্রিয়া কিন্তু এখনো স্থির হয়নি। সব পুলিশকে কাজে ফেরানো যায়নি এক মাস চলে যাওয়ার পরও। সাম্প্রতিককালের ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের অবশ্য কাজে ফিরতেও দেওয়া হবে না। তাদেরকে বিচারে সোপর্দ করা হবে। সে প্রক্রিয়া চলমান। আর পুলিশে রদবদল হচ্ছে এখনো। এ অবস্থায় তাদের কাজে মন নেই। মনে অস্থিরতা। পুলিশ সদস্যদের অসংখ্য পরিবারে বিরাজ করছে অস্বস্তি। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে ন্যূনতম সেবাটুকুও মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে। মাঠে তাদের উপস্থিতি কম। সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করতে নিরাপদও বোধ করছে না তারা। এমনকি রাত ১০টার পর অনেক স্থানে দায়িত্বরত দেখা যাচ্ছে না ট্রাফিক পুলিশকে। এতে যানজট পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, বিশেষত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে।
পুলিশের কথাটা আলাদা করে তুললাম এজন্য যে, বিগত সরকারের আমলে প্রশাসনের মধ্যে পুলিশই হয়েছে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কাজ তৃণমূল পর্যন্ত সরাসরি দেখতে পায় মানুষ এবং পুলিশের ভূমিকাটা তারা পায় সরাসরি। পুলিশ একটা চলনসই সেবা দিলেও জনসাধারণের বড় অংশই ভাবে-‘দেশ তো খারাপ চলছে না’! দুর্ভাগ্যবশত এমন পরিস্থিতি এদেশের মানুষ কখনো সেভাবে পায়নি। ১৯৯০ সালের পর থেকে যখন নিয়ম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসত, তখন দু-তিন মাস পুলিশকে মোটামুটি দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করতে দেখা যেত। তারপর পুরোনো ধারায় ফিরে যাওয়া। বাকি জনপ্রশাসনের বেলায়ও একথা কমবেশি প্রযোজ্য। তবে বিগত সরকারের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন দল, সরকার ও প্রশাসন পরস্পরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। তাই এমন প্রশ্নও উঠছে, এই পুলিশ আর প্রশাসন দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা একটি সরকার চাইলেও সুশাসন দেবে কীভাবে? পুলিশকে দিয়ে যে ন্যূনতম কাজটাও করানো যাচ্ছে না, সেটা তো এরই মধ্যে স্পষ্ট। অভিযুক্ত নয়, এমন পুলিশ সদস্যও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারছে না। অনেকে ইচ্ছা করেও করছে না। তারা হয়তো ভাবছে, এত বড় একটা বাহিনীকে তো আর বিলুপ্ত করে দেবে না সরকার। ‘অঙ্গীভূত আনসার’ সদস্যদের একাংশ সচিবালয়ে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করলেও তাদের বিরুদ্ধে বড় ও কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। পুলিশে এরও প্রভাব পড়েছে মনে হয়। তাদের অনেক নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে সেনাসদস্যদের। তাদের আবার বিতর্ক এড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। মিডিয়ায় সব খবর সরাসরি না এলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তো সব পক্ষই সক্রিয়। সেখানে এমন কিছু ‘খবর’ দ্রুত এসে যাচ্ছে, যা একটি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের জন্য বিব্রতকর। খুলনা ও রাজশাহীতে দুটি গণপিটুনিতে একজন গুরুতর আহত হওয়া ও অপরজনের মৃত্যুর খবরে বিবেকবান মানুষমাত্রই বিচলিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময়ের সময়ও বিষয়টি এসেছে। সেটাই স্বাভাবিক। এটাও স্বাভাবিক যে, ‘উত্তেজিত জনতার হাতে’ এভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সরকার কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তবে এটা বলাই যথেষ্ট নয়; এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের নামে হত্যাকাণ্ড চালানোর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পাশাপাশি এদেরও বিচার হওয়া দরকার। বিশেষত একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ঘটা যে কোনো অপরাধমূলক ঘটনার বিচার দেরিতে হলেও হতে হবে। কোনো কোনো অপঘটনার বিচার আবার দ্রুততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। কেননা এর সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি জড়িত। কোনো কোনো ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচকভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। দেশেও সব মহলে যত দ্রুত সম্ভব এ আস্থা জাগানো প্রয়োজন যে, সরকার যথাযথ তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। আর এ কাজে পুলিশের ভূমিকা জরুরি বলেই এ বাহিনী নিয়ে বলতে হচ্ছে এত কথা।
এমন পরিস্থিতি অবশ্য অনেকটাই এড়ানো যেত, যদি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা প্রক্রিয়ায় যেত বিগত সরকার। বছরের শুরুতে ‘ডামি নির্বাচন’ আয়োজনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কতভাবেই না তাকে বলা হয়েছিল এক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে! দেশের ভেতর থেকেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবাই এতে জোর দিয়েছিলেন। ২০১৮-এর নির্বাচনেও একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একপ্রকার সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলার, যাতে ভবিষ্যতে অন্তত ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে যাওয়া যায়। সে সুযোগও হারিয়েছিলেন প্রতাপশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এমন এক ট্রেনে তারা চড়ে বসেছিলেন, যেটা কোনো স্বাভাবিক গন্তব্যে পৌঁছাবে না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দ্রুততার সঙ্গে পতন ও পলায়ন সম্ভবত সেই গন্তব্য। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী বোন পলায়ন করলেও তাদের লাগাতার সহায়তা জুগিয়ে যাওয়া প্রশাসন তো পালাতে পারেনি। বিশেষ করে পুলিশ পড়েছে তোপের মুখে। এটা এমন এক বাহিনী হয়ে উঠেছিল যে, সরকার পতনের দিনও সন্ধ্যা পর্যন্ত এরা ব্যস্ত থাকে জনতার সঙ্গে সংঘাতে। অথচ মাঠে উপস্থিত সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিল ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার পক্ষে। সাবেক সেনাসদস্যদের পরিবার নেমে এসেছে জনতার বিক্ষোভে। আর দুই সাবেক সেনাপ্রধানসহ তাদের সহকর্মীদের একাংশ রাজধানীতে একসঙ্গে বসে দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বার্তা। সেনাবাহিনীকেও কি কম বিতর্কিত করেছিল বিগত সরকার? এর একাংশকে বিতর্কিত কাজে ব্যবহার করেনি? তা সত্ত্বেও দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে সময়মতো সঠিকভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়নি সেনাবাহিনী। তারা এখন ভেতর থেকে গভীরভাবে সহায়তা জোগাচ্ছেন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা সরকারকে। আর চরমভাবে বিতর্কিত পুলিশকে ক্ষেত্রবিশেষে এখনো পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। এককভাবে কম অভিযানই পরিচালনা করতে পারছে পুলিশ। পোশাক খুলে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে তাদের! এর চূড়ান্ত দায় অবশ্য নিতে হবে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার টিমকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের একটা পর্যায়েও যদি তারা শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারতেন, তাহলেও বোধহয় পুলিশ এতটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়ত না।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিশোধের পাশাপাশি গোষ্ঠী ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে স্বভাবতই। সরকার পতনের পরপরই এক আলোচিত নারী আইনজীবীর ওপর হামলার খবর পাওয়া গেল দেরিতে। তিনি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সরকার পক্ষের আইনজীবী ছিলেন। পরে এক বিতর্কিত ঘটনায় তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। তারপরও তিনি গোষ্ঠীবিশেষের হামলা থেকে রেহাই পেলেন না। সত্যি বলতে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটলেও বোধহয় অবাক হওয়া যেত না। শেখ হাসিনা তো তার বিভিন্ন পর্যায়ের অনুগামীদের কোনো বার্তাও দিতে পারেননি পদত্যাগ করে প্রস্থানের সময়। নানাভাবে অভিযুক্ত অনেকেই তাই দেশ ছাড়তে পারেননি। পালিয়েও থাকতে পারছেন না। আবার অনেকে হয়তো ভাবছেন, ‘আমি তো তেমন কিছু করিনি’! এরাও আক্রান্ত হচ্ছেন এখন। রাজশাহীতে নিহত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এরই মধ্যে হয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী। তিনি ওষুধ কিনতে গিয়ে আক্রান্ত হন মর্মান্তিকভাবে। এর অনেক আগে একবার আক্রান্ত হয়ে পায়ের একাংশ হারান তিনি। এবার হারালেন জীবনটাই। মাত্র ক’দিন আগে জন্ম নিয়েছে তার কন্যাশিশু। এসব খবর পড়া যায় না। এ ধরনের ঘটনা গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়।
ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, বিচার ও খালাসের আগে ‘রিকনসিলিয়েশন’ নয়। এ অবস্থায় বিচারবহির্ভূত সব কর্মকাণ্ডও প্রতিরোধ করতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল শামিল হয়েছিল, তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে পালটা সবরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে যার যার জায়গা থেকে এগুলো বরং প্রতিরোধ করা। জনগণ কিন্তু সবই লক্ষ করছে। আর এতে অন্তর্বর্তী সরকারকেও তার কাজে সহায়তা করা হবে। সবাইকে এটা বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে যে, পুলিশ এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক