Logo
Logo
×

বাতায়ন

সংস্কার টেকসই হতে হবে

Icon

ড. এএইচএম সাদেক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার টেকসই হতে হবে

স্বাধীনতা ও বিজয় রক্ষা করা বিজয় অর্জনের চেয়ে কঠিন। যেমন, স্বৈরশাসকরা কেবল মুকুট পরতে জানে, কিন্তু তারা মুকুট ছাড়ার পথ জানে না বা চেনে না। চাটুকারবেষ্টিত চরম কর্তৃত্ববাদী ও স্বেচ্ছাচারীদের ধ্বংস ও বিনাশের চাবি কোন বাতিঘরে লুকানো থাকে, তা তারা আন্দাজ করতে পারে না। বিশ্বের সব স্বৈরাচারীর রীতিনীতি ও মূলমন্ত্র প্রায় এক ও অভিন্ন। তারা অনেকটাই নেশার ঘোরে চলে। হুঁশ ও জোশের তাল-লয়ে ঘাটতি থাকে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হঠাৎ কোনো ছোট্ট ঝড়ের কবলে পড়ে স্বৈরাচারদের সুরক্ষিত নিরাপদ নিবাস তছনছ হয়ে যায়। অথচ বৃহৎ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল প্যারামিটার (অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তি), প্রচুর রক্তপাত, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, জন-অসন্তোষের প্রতিধ্বনির পারদ চরমে উঠলেও গদির বিনাশ হয় না। অথচ ক্ষুদ্র কারণে মসনদের পতন হয়। এর বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশ।

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্বরাজনীতির পাঠচক্রে এক আর্কষণীয় অধ্যায় হিসাবে থাকবে। এর প্রয়োজনীয়তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহসাই ফুরিয়ে যাবে না, বরং এর আবেদনটা থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এটি একটি থিম গেম। উত্থান-পতন।

খেয়াল করলে দেখা যায়, যে স্বাধীনতাবিরোধী বা ‘রাজাকার’ শব্দের চটকদার স্টিগমা বা সুকৌশল ব্যবহারে পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ও জয়যাত্রা, সেই একই শব্দের (রাজাকার) অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের মধ্যে তার পতন নিশ্চিত হলো। বিধির কী খেলা!

বস্তুত যখন কোনো সরকার বা প্রশাসন অবজেক্টিভলি দূরাচার হয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের বাহক হয় এবং তার চারপাশ হয় তোষামোদকারী বা চাটুকার পরিবেষ্টিত, তখন তারা কর্ণকুহরে কেবল কোকিলের গানই শুনতে পায়, শুনতে পায় না জনগণের হাহাকার ধ্বনি ও নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের গোঙানি।

এ গোঙানির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েই সমাজ বা জনগণের ভেতরে তৈরি হয় স্পার্টাকাস, গ্ল্যাডিয়েটর। এ স্পার্টাকাস, গ্ল্যাডিয়েটরা তখন তক্ত-মসনদের শেকড়কে তুলার মতো উড়িয়ে দেয়, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।

সবকিছু মজবুত, সব ঠিক আছে, উন্নয়নের বুলি বারবার জাতির সামনে সগৌরবে আওড়ানোর পরও এমন অপমানজনক ও অসম্মানজনক পতন কেন হলো? এ পতনের উত্তর জনগণ জানে। পতিত শাসকগোষ্ঠীও জেনেছিল ও বুঝেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো-মানেনি, মানতে চায়নি। ওই যে আমিত্ববোধ, আমিই সব। এখানেই সব আটকে ছিল, যার ফল বড্ড তেতো হলো।

রাষ্ট্রযন্ত্রে সরকার ও দল এক ও সমান্তরাল নয়। সরকার ও সরকারি দলকে একাকার করে ফেলা মানে শাসনযন্ত্র, সরকার ও সরকারি দলের ধ্বংস ত্বরান্বিত করা। কারণ সবাই তখন সরকার ও সরকারি দল হয়ে যাওয়ার চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আর এর খেসারত বহন করতে হয় পুরো জাতিকে। বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস এর জ্বলন্ত প্রমাণ। রাষ্ট্রকাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

হাসিনা সরকার রাষ্ট্রকাঠামোর এমন কোনো অঙ্গ নেই, যেখানে হাত দেয়নি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের সামাজিক ধাপেও (সোশ্যাল বন্ডিং) এর প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অর্গান-আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল। শাসনযন্ত্র নিপুণ ও সুচারুভাবে চালানোর অন্যতম হাতিয়ার হলো পুলিশ বিভাগ। এটিকে কেবল দলীয়করণই করা হয়নি, বরং আতঙ্ক বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জনগণ পুলিশকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও আস্থার প্রতীক মনে করে।

শিক্ষাঙ্গনে চলেছে চরম নৈরাজ্য। মানহীন ও সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে মেধাশূন্য ও হতাশায় গ্রাস করেছে। প্রাইমারি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত চলেছে এক বীভৎস ও লেজেগোবরে অবস্থা। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দিশেহারা। তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত। অন্যদিকে শিক্ষায় বাণিজ্যকরণ, অস্বচ্ছ নিয়োগ, চাকরি বাণিজ্যকরণ, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও নানা অসংগতির কারণে মেধাবীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক তথা ব্রেন ড্রেইন (মেধা পাচার) জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।

অর্থনীতির বেহাল দশা। রাজকোষ ফোকলা। ঋণনির্ভর উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন, লুটপাট, নানা অর্থনৈতিক কেলেংকারি, সর্বোপরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা-এ সবকিছুর সংশোধনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও পদ্ধতিগত উন্নয়ন করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।

পরিবহণ তথা যোগাযোগ খাতে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অরাজকতা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাঙ্ক্ষিত চাহিদার পরিপন্থি। অথচ এটি জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যতম প্রধান খাত ও সেবা খাত। উন্নত বিশ্বের জনগণ এ খাতটিকে খুব গুরুত্ব দেয় ও মূল্যায়ন করে। এসব খাতে কার্যকর ও টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন করে জনগণের ভোগান্তি ও কষ্ট লাঘবে মনোযোগী হতে হবে।

ব্যুরোক্রেসি তথা আমলাতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনস্বার্থে টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।

নাজুক ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা খাতকে প্রকৃত সেবামূলক খাতে পরিণত করা, লুটপাট ও দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করে যুগোপযোগী সেবাদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ঘুস-দুর্নীতি প্রতিরোধ, সরকারি প্রকল্পের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বছরে ন্যূনতম একটি ‘জাতীয় সংলাপ সেশন বা অধিবেশনে’র ব্যবস্থা করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ ও সদ্ভাব বজায় রাখার স্বার্থে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা হবে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার প্রয়াস। জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো এক ও অভিন্ন থাকবে এবং দেশবিরোধী চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও চুক্তি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলার ব্যবস্থা অর্থাৎ একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঘোষণাপত্র রচনা করা প্রয়োজন।

এ বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একদিকে যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার ও মেরামতের জন্য একটি যৌক্তিক সময় দিতে হবে, তেমনি ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও ন্যাশনাল রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। এতে সন্দেহ ও আস্থার সংকট কমে যাবে এবং জাতি একটি বার্তা পাবে যে, এ সরকার সামগ্রিক জনগণের কল্যাণে কাজ করছে এবং এ সরকার আমাদের সবার সরকার।

একটি কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জায়গা অনেক বেশি। এটি জাতি সত্যিকার অর্থে ডিজার্ভ করে। ছাত্র-জনতার এ বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জঞ্জালমুক্ত ও পদ্ধতিগত টেকসই পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন এক বাংলাদেশ উপহার দেবে, যা নয়া (নতুন) বাংলাদেশ-নয়া বাতাস নামে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হবে। সেই আস্থা ও বিশ্বাস দেশবাসী রাখতে চায়।

ড. এএইচএম সাদেক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, একাডেমিক সেকশন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম