রাষ্ট্র সংস্কার : নির্বাচন পদ্ধতি ও স্থানীয় সরকার
কর্নেল মো. ইলিয়াস হোসেন (অব.)
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৮ আগস্ট বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর নতুন সরকারের কাছে সবারই প্রত্যাশা, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সব জঞ্জাল দূর করে দুর্নীতিমুক্ত বৈষম্যহীন একটা সমাজ গঠনের মধ্য দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা হবে।
এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে রাষ্ট্রকাঠামোয় আমূল সংস্কার করে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হবে। সেক্ষেত্রে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে নির্বাচন পদ্ধতিতে নতুন ধারণা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এক কথায়, দেশের সার্বিক সংস্কার করতে হবে। অতঃপর স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে সর্বজনের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আমরা আস্থা রাখতে চাই, এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার ওপর বর্তিত এ গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্ষম হবে। মনে রাখতে হবে, বিগত সরকারের প্রেতাত্মারা এখনো সক্রিয় রয়েছে, সামনে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে, তাই সাবধানে পথ চলতে হবে।
এবার আসা যাক রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে। দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে একটিই কথা, তা হলো রাষ্ট্র সংস্কার। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ শব্দটি অনেক ছোট হলেও এর ব্যাপকতা অনেক বেশি। দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, লেখক, গবেষক এবং সুশীল সমাজসহ অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা নিশ্চয়ই রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে তাদের মতামত দেবেন। তবে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই, আমি অতি সাধারণ একজন ব্যক্তি। আমি মনে করি,
সরকার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে নির্বাচনব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে একেবারে রুট লেভেল থেকে শুরু করতে হবে। যেমন-গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, এর পরে জেলা এবং জাতীয় নির্বাচন। স্বাধীনতা-পরবর্তী গতানুগতিক পদ্ধতি পরিহার করে গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নতুন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে নির্বাচন-পরবর্তী ফলাফলকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার সুযোগ না থাকে। এমন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারলে সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য ও দুর্নীতি, রোহিত হবে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
আমাদের ছোটবেলায় গ্রাম সরকার পদ্ধতি চালু হয়েছিল। পরবর্তীকালে উপজেলা পদ্ধতি চালু হয়। কিন্তু সরকারের নীতির ধারাবাহিকতার অভাবে সেটি কার্যকর হতে পারেনি। আমাদের দেশে যে নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তাতে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, উপজেলা থেকে জেলা, এমনকি জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের ক্ষমতা (পেশি শক্তি) ও অর্থ লেনদেনের প্রভাবমুক্ত রাখা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন-সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক অর্থ লেনদেন হয়, যা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি ওই অর্থ উত্তোলনের প্রয়োজনে দুর্নীতি করতে বাধ্য হয়। তাই এ ধরনের নির্বাচনব্যবস্থাকে পরিহার করে একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমার ধারণা, এতে একক ক্ষমতার অবসান হবে। শুধু তাই নয়, এতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। আসলে আমাদের শুরু করতে হবে গ্রাম পর্যায় থেকে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার পদ্ধতি এবং নির্বাচনব্যবস্থা নিম্নরূপে সংশোধন করা যেতে পারে :
প্রতিটি গ্রামে ‘গ্রাম পরিষদ সরকার’ নামে একটি সরকারব্যবস্থা থাকবে, যার প্রধান হিসাবে থাকবে একজন ‘গ্রাম সরকারপ্রধান’। ওই গ্রাম সরকারপ্রধানের অধীনে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। এ কমিটির সব সদস্যকেই স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হবে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো : শিক্ষা সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সম্পাদক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক সম্পাদক, বন ও পরিবেশ সম্পাদক, অর্থ ও বাজেট সম্পাদক, ধর্ম সম্পাদক, কৃষি সম্পাদক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, যোগাযোগ সম্পাদক, পানি সম্পাদক, আইন ও বিচার সম্পাদক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক-১ (প্রথম সদস্য সচিব), নির্বাহী সম্পাদক-২ (দ্বিতীয় সদস্য সচিব)।
গ্রাম সরকারের অনুরূপ ইউনিয়ন পরিষদ সরকার, উপজেলা পরিষদ সরকার এবং জেলা পরিষদ সরকার থাকবে। প্রতিটি সরকারের গঠনতন্ত্রে একই সংখ্যক সদস্য থাকবে। প্রতিটি সরকারে একজন প্রধান ব্যক্তি থাকবে, যার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের আদলে স্ব স্ব গ্রাম/ইউনিয়ন/উপজেলা/জেলার সার্বিক উন্নয়নে নিজ নিজ বিভাগের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নসহ সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রত্যেক সম্পাদকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে কমে যাবে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনে তাদের বিশেষ ভোটিং ক্ষমতা থাকবে। যেমন-গ্রাম সরকারের ভোটিং ক্ষমতা ১৫, অন্যান্য সম্পাদকের ক্ষমতা ১০। ইউনিয়ন পরিষদ সরকারের অধীনে ১৬ জন সম্পাদক থাকবে, যাদের ভোটিং ক্ষমতা ইউনিয়ন সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে ২০ এবং সম্পাদকদের ক্ষেত্রে ১৫ হতে পারে। একইভাবে উপজেলা সরকারপ্রধানের ভোটিং ক্ষমতা ২৫ এবং তার সম্পাদকদের (১৬ জন) ভোটিং ক্ষমতা ২০ করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের প্রধানের ভোটিং ক্ষমতা ৩০ এবং সম্পাদকদের ২৫ করা যেতে পারে।
এ ভোটিং ক্ষমতা জাতীয় নির্বাচনের ভোটের সঙ্গে সন্নিবেশ করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন, বিশেষ করে সংসদ নির্বাচন জনগণের ভোটের মাধ্যমে হতে হবে। তবে ভোট গণনার ক্ষেত্রে জনগণের ভোটের ফলাফলকে ৭৫ শতাংশের মাধ্যমে গণনা করতে হবে এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ ভোট সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার সব গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা/জেলা পরিষদ সরকার এবং তাদের সম্পাদকদের ভোটের ফলাফলের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করতে হবে। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জনপ্রতিনিধিদের একক ক্ষমতা, দম্ভ ও প্রভাব কিছুটা হলেও খর্ব হবে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার উপায় তৈরি হবে বলে মনে করি। স্থানীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ সরকার চালু করার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে উপজেলা এবং পরবর্তীকালে জেলা পরিষদ সরকার নির্বাচন করে একটি সর্বজনীন সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। যদিও স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় এ ধরনের সংস্কার একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। ফলে এতে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ ও বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোকপাত করা হলো :
ক. প্রশাসনিক দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি : গ্রাম বা ইউনিয়ন পরিষদ সরকার চালু করার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা সরাসরি পৌঁছে যাবে, যা স্থানীয় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে সহায়ক হতে পারে।
খ. স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন : এ ধরনের সরকারব্যবস্থা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করবে এবং তাদের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।
গ. জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা : স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি স্তরে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হলে সরকারের ওপর তাদের বিশ্বাস ও আস্থা বাড়বে।
ঘ. অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জ : এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে হলে সরকারি বাজেটে বড় পরিবর্তন আনতে হবে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
চ. আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন : এমন পরিবর্তন আনতে হলে প্রচলিত আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এজন্য জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা, সহমত ও সমর্থন প্রয়োজন।
এছাড়া সরকার গঠন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন পদ্ধতির ওপর প্রভাব ফেলে এমন বেশকিছু বিষয়; যেমন-ভোটার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া, নির্বাচনি অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণে ভারসাম্য বজায় রাখা, প্রার্থীদের যোগ্যতা এবং নির্বাচন ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ, নির্বাচনি প্রচারণা ও মিডিয়া ব্যবহারের নিয়ম-কানুন প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম নেওয়া, যাতে সব প্রার্থী সমান সুযোগ পায় এবং জনমত গঠনের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
এ ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার একটি জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং জনগণের আস্থা অর্জন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক পরিকল্পনা, আইনগত সংশোধন এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক সমর্থন। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের একটি ধাপ হিসাবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও জনবান্ধব করতে দেশের নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবেন, এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
কর্নেল মো. ইলিয়াস হোসেন, পিএসসি, পিইঞ্জ (অব.) : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
hmelias@yahoo.com