Logo
Logo
×

বাতায়ন

সাক্ষাৎকার

সরকারের কাজের পরিধির ওপর নির্ভর করবে এর মেয়াদ: সলিমুল্লাহ খান

Icon

জাকির হোসেন সরকার

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারের কাজের পরিধির ওপর নির্ভর করবে এর মেয়াদ: সলিমুল্লাহ খান

সলিমুল্লাহ খান/ফাইল ছবি

সলিমুল্লাহ খান ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক। বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হিসাবে তার খ্যাতি রয়েছে। বেশকিছু চিন্তা উদ্রেককারী গ্রন্থ রয়েছে তার। তিনি সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : জাকির হোসেন সরকার

যুগান্তর : ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের পট পরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সলিমুল্লাহ খান : বহু আগেই এ পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল। আমি এটিকে বিলম্বিত চিকিৎসা হিসাবে দেখি। এ চিকিৎসাটা হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, এ কথা সত্য। তবে সেটা নিয়েও বহু প্রশ্ন ছিল। ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনে তিনি যে আসলে পরাজিত হয়েছিলেন, তা সবাই জানেন। তিনি জানতেন পরাজিত হবেন। এ পরাজয় ঢাকার জন্যই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল করেন, নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে একজন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবকে (সুজাতা সিং) ডেকে এনে কোনো এক পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেন। এভাবে জয়ী হওয়ার চেয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজিত হওয়া ভালো ছিল। অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পরাজিত হলেও আওয়ামী লীগ হয়তো আরেকবার ফিরে আসতে পারত। প্রশ্ন হলো, অনির্বাচিত একটি সরকার কীভাবে এতদিন ইচ্ছামতো দেশ ধ্বংস করল আর দেশের মানুষও এই অন্যায় ১৫ বছর ধরে মেনে নিল? আমি তাই এ পরিবর্তন খুবই অপরিহার্য ছিল মনে করি।

যুগান্তর : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য?

সলিমুল্লাহ খান : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুই সরকারের মাঝখানের সরকার। আগের সরকারের অবস্থা আমরা দেখেছি। তারা ২০০৯ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগে জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটার বাস্তবায়ন করেনি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা জনগণকে কি তখন বলেছিলেন, আমরা নির্বাচিত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করব? না, বলেননি। আমাদের মতো প্রজাতন্ত্রে সরকার জনগণের অনুমতিপ্রাপ্ত কি না, এর একমাত্র প্রমাণ অবাধ নির্বাচন। কিন্তু কোনো সরকার যদি নির্বাচনে কারচুপি করে, তাহলে মানুষ মানবে না। আগের সরকার যা করেছিল, তা রীতিমতো একটা চৌর্যবৃত্তি, একটা সংবিধানবিরোধী অভ্যুত্থান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বসেছে ওই সমস্যার সমাধান হিসাবে। আর একটি অভ্যুত্থানের দৌলতে গঠিত হয়েছে এ সরকার। এতেই বোঝা যায়, কোনো দেশের সরকার যদি নিজে থেকেই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান বৈধ হয়ে যায়। এদেশে এবার সেটাই হয়েছে।

এ সরকারের বৈধতা কতদিন স্থায়ী হবে আমরা জানি না। এটি কোনো মেয়াদ নিয়ে বৈধতা লাভ করেনি। একটি কর্তব্য নিয়ে এসেছে। মানুষ আশা করেছে, বিগত সরকারের আমলে যেসব অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, এ সরকার তার পুনরাবৃত্তি করবে না। বিগত সরকার এবং নতুন সরকারের মাঝামাঝি টানাপোড়েনের সময়টা মোকাবিলা করেই এ সরকারকে এগোতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক কাজ, যেটা আগের সরকারের কাজের পুনরাবৃত্তি মনে হতে পারে। আগের সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, ক্রসফায়ার হয়েছে। এ সরকারকে এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। অবশ্য এ সময়ে কিছুদিন যাবৎ ক্রসফায়ার বন্ধ আছে। তা যে ফিরে আসবে না, কীভাবে বলি?

বিগত সরকারের শেষ ২০-২২ দিনে দেশে যে পরিমাণ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এখনো তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায়নি। নিহতের সংখ্যা হাজারের বেশি বলে অনুমান। এ গুম, খুন, হত্যা বন্ধ করা এ সরকারের প্রধান কাজ। র‌্যাব এবং বিবিধ গোয়েন্দা সংস্থা মানুষকে যেভাবে ধরে নিয়ে যেত এবং বিনা বিচারে গুম করত, সেটা বন্ধ করতে হবে। মানুষকে অবাধে তার মত-দ্বিমত, পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করার অধিকার দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলীয় সরকার নয়। ছাত্র আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছেন তাদের সরকার। এ সরকার যদি জনগণের ম্যান্ডেট পালন না করেন, তার বিরুদ্ধেও মানুষ আবার রুখে দাঁড়াবে।

জনগণই সব ক্ষমতার উৎস-শুধু কথার কথা নয়, ২০২৪ সালে মানুষ বাস্তবেও তা প্রমাণ করেছে। আবার সেই মুক্তিযুদ্ধের আবহাওয়া ফিরে এসেছে। এজন্য বলব, মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিশ্রুতি থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব সরকার সরে গিয়েছিল, মানুষ সে অধিকার আবার ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে। আগেও মানুষ আন্দোলন করেছে, কিন্তু এবার তারা সফল হয়েছে। বিপদ কিন্তু কেটে যায়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবায়ন করা হবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না।

যুগান্তর : বর্তমান সরকার কি নির্বিঘ্নে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান : একটু আগেই বললাম, সরকারের অনেক বিঘ্ন আছে। একটা বিঘ্ন ভেতর থেকে। আরেকটা বিঘ্ন বাইরে থেকে। আগে বাইরেরটা বলি। বিগত সরকার পরাজিত হয়েছে সে সরকারের সমর্থকরা এখনো পরাজিত হয়নি। তারা দেশের সব জায়গায় আছে। তাদের কিছু লোক দেশের সামরিক বাহিনীতে আছে, পুলিশের মধ্যে আছে।

বিগত সরকার গত ১৫ বছরে দেশে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটা দুর্বৃত্ত-ধনিক শ্রেণি তৈরি করেছে। বলতে গেলে দেশে তোষামোদকারী, পা-চাটা, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, একটা জঘন্য পুঁজিপতি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাদের হাতে বিপুল অর্থসম্পদ। তাদের দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। এদের নিয়েই বিপদের আশঙ্কা। এটা এক নম্বর বিপদ। তারা যে কোনো সময়ই জনগণের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। তারা মনে করে, তাদের পরাজয়টা সাময়িক। কেউ কেউ বলছেন, ‘গতবার আওয়ামী লীগের ফিরতে ২১ বছর লেগেছিল, এবার ২১ মাসও লাগবে না।’

দ্বিতীয় বিপদ, প্রতিবেশী ভারতকে নিয়ে। বিগত সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করেছিল; কিন্তু বাস্তবে কোনো বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়নি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য ভারত নানা কার্যক্রম চালাতে পারে। কেউ কেউ এ দেশে সামরিক অভিযান চালানোর উসকানি দিচ্ছে। ‘নর্থ-ইস্ট নিউজ’ বলে তাদের একটা নিউজ আউটলেট আছে, সেখানে জয়দীপ সাইকিয়া নামক এক ভদ্রলোক লিখেছেন, ভারতের উচিত সামরিক অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেই সংবাদের শিরোনাম, ‘লেট আস রিটার্ন টু ঢাকা।’ এমন পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের সামনে বাধার পরিমাণটা কী হতে পারে। অন্যান্য বাধা তো আছেই।

যুগান্তর : বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে কি?

সলিমুল্লাহ খান : সামরিকভাবে বাংলাদেশ ছোট দেশ। এ দেশে কলকে পেতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশই অতি আগ্রহী। এসব শক্তির টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে একটি ক্ষুদ্র দেশকে এগিয়ে যেতে অনেক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের যুগসঞ্চিত পরীক্ষিত নীতি জোটনিরপেক্ষতা। বর্তমান সরকার জোটনিরপেক্ষতার এ নীতি ধরে রাখতে পারবে কি না, নাকি কোনো বিশেষ বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়বে, তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

যুগান্তর : দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এ সরকারের কী কী ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান : গত সরকার দেশের অর্থনীতিকে একেবারে ছারখার করে দিয়ে গেছে। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। দেশে বেকারত্ব বেড়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। অর্থনীতি যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে, সেটি বোঝা যায় টাকার মান কমে যাওয়া থেকে। একই সঙ্গে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। এখান থেকে দেশকে টেনে তুলতে হলে শুধু বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে হবে না। ৫-৭ বিলিয়ন, এমনকি ৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সাহায্য দিয়েও হবে না, যদি না দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনরুজ্জীবন হয়। কিন্তু এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে যেসব প্রতিষ্ঠানে, সেগুলোর প্রতিটিকেই ধ্বংস করেছে বিগত সরকার। যেমন ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠানের মতো বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান তলাশূন্য হয়ে গেছে। আর সরকারি যত সংস্থা আছে, কোনোটাতেই কোনো কাজ হয়নি। এতগুলো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশকে আবার নিজের পথে ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সরকারকে এগোতে হবে। ‘সংস্কার’ নামক শব্দ দিয়ে যে কথা বলা হচ্ছে, সেই কাজ না করলে, প্রকৃত প্রস্তাবে সংবিধান সংস্কার না করলে নির্বাচন করেও কিছু করা যাবে না।

যুগান্তর : এ সংস্কার করতে কত সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান : কত সময় লাগবে, তা নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়। তা নির্ভর করবে কাজের মাত্রার ওপর। কাজ যত বড় হবে, সময় তত বেশি লাগবে। বিগত সরকার ১৫ বছর ধরে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি দেয়নি। অনেককে চাকরিচ্যুত করেছে অকারণে। শিক্ষা খাতকে চরম অবহেলা করেছে। শিক্ষকদের যথোপযুক্ত বেতন-ভাতা দেয়নি। শিক্ষকদের ব্যাপারে কোনো বেতন কমিশন গঠন করা হয়নি। বিশেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আর উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে তারা একের পর এক ধ্বংসসাধনই করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা সন্ত্রাসের আখড়া বানিয়েছে। শনির আখড়া বানিয়েছে সবগুলো।

এতখানি জঞ্জাল সরানো অতি বেশি জনপ্রিয় না হলে কোনো সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের পেছনে আপাতত সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। জনগণের এ সমর্থন তিন মাসও লাগবে না বদলে যেতে। যদি দেখা যায়, এ সরকারও দমন-পীড়নে বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, তাহলে মানুষ তার বিরুদ্ধে খেপে যাবে এবং রুখে দাঁড়াবে। বিভিন্ন বাধাবিঘ্ন বর্তমান সরকার অতিক্রম করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে আমার হাতে কোনো রাশিচক্র বা হরোস্কোপ নেই। আমি জ্যোতিষী নই। আশা করতে পারি, সরকার যদি শুরু থেকেই সচেতন থাকে এবং যে জায়গায় আগের সরকার সঠিক পথ থেকে সরে গিয়েছিল, সে জায়গাগুলো যদি তারা চিহ্নিত করে পাহারা বসায়, তাহলে অনেকদূর এগোতে পারবে।

২০২৪ সালে যারা বিজয় অর্জন করেছে, তাদের সক্রিয় সচেতনতার ওপরও ঘটনা অনেকটা নির্ভর করে। সেই রকম সংগঠিত শক্তি আমাদের দেশে নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান স্বতঃস্ফূর্ত একটা বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটা নাগরিক শক্তি। এ শক্তি কতটা সচল এবং সক্রিয় থাকবে, তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

যুগান্তর : ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে যে সংস্কারমূলক কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, এ সংস্কারগুলো কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান : শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের তিন রকমের কাজ রয়েছে। সংস্কার কাজ স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। আমি সংস্কারের প্রশ্নে দীর্ঘ মেয়াদের পক্ষে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক মৌলিক পরিবর্তন দরকার। যেমন: এ দেশে বহুরকমের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা, বাংলা মিডিয়াম শিক্ষা, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা। ইংলিশ মিডিয়ামে এখন জয়জয়কার, বিশেষ করে শহরে এবং উচ্চশ্রেণিতে। ইংলিশ ভার্সনেও লেখাপড়া হচ্ছে। একটা স্বাধীন দেশে প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার এত প্রকারভেদ থাকবে কেন?

উচ্চশিক্ষার নামে আমরা যা করছি, তা খুবই নিুমানের, অনুচিত শিক্ষা। দেশে এখন মূলত সাধারণ শিক্ষাকে অবহেলা করা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা পেছনে রেখে তথাকথিত কর্মমুখী বা ভোকেশনাল শিক্ষা নিয়ে দৌড়াচ্ছে সবাই। মানুষের মানুষ হওয়ার যে শিক্ষা, তা দিনদিন অবহেলিত হচ্ছে। এ শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী চলছে এ প্রবণতা। এ প্রবণতা আমরা একা রোধ করতে পারব না। তবে আমদের দিক থেকেও চেষ্টা করে যেতে হবে।

একটি বিষয় ভেবে দেখা দরকার, যেখানে মানুষের নৈতিক শিক্ষা, ভাষাশিক্ষা এবং বিজ্ঞানের ভিত্তিশিক্ষা প্রভৃতি বাদ দিয়ে শুধু কারিগর করে গড়ে তোলা হয়, তার দ্বারা অনেক অপকর্ম হতে পারে। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এমনটাই হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার নৈতিক ভিত্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন শিক্ষাক্ষেত্রে মানুষ হওয়ার শিক্ষাকে ক্রমশ কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ কাজটা দীর্ঘমেয়াদি সংশোধনের ব্যাপার। স্বল্পমেয়াদি এবং মধ্যমেয়াদি যে বিষয়, তার মধ্যে আছে শিক্ষায় বিনিয়োগ বা ব্যয়ের বিষয়টি। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের ব্যয়-বরাদ্দ এত কম যে, সেটি কল্পনাকেও হার মানায়। জাতীয় মোট যে আয়, যেটাকে আমরা জিডিপি বলি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত প্রস্তাবে তার ২ শতাংশেরও কম খরচ করা হয়। শিক্ষার এ ব্যয়-বরাদ্দ গত বাজেটে শতকরা ১.৭ ভাগে নেমে এসেছে। এ দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উপরে টেনে তোলা আদৌ সম্ভব নয়।

যুগান্তর : নিরক্ষরতা দূরীকরণে এ সরকারের কী কী ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান : স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এবং ব্রিটিশ শাসকরা চলে যাওয়ার ৭৮ বছর পরও এখানে কেন এত মানুষ নিরক্ষর থাকবে? এটাই বড় প্রশ্ন। দেশে একজন নিরক্ষর থাকাও তো অন্যায়। এদেশে সরকারি হিসাবে শতকরা ২৬ জন এখনো নিরক্ষর। মতান্তরে প্রকৃত নিরক্ষরতার হার ৯০ শতাংশ। আমাদের দেশে কয়জন পত্রিকা পড়তে পারে? সেই হিসাবে এই দেশে শিক্ষার বিস্তার আদৌ সর্বজনীন হয়নি। বাইরের অনেক দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, শুধু আমরাই পিছিয়ে আছি।

দেশে শিক্ষার গুণগত মানেরও অবনতি হয়েছে। টাকা দিলেই শিক্ষা হয় না। আর টাকা ছাড়াও শিক্ষা হয় না। আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিচে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সবচেয়ে নিচে। তাহলে শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নতি হবে কীভাবে? শিক্ষকদের জীবন মানের যদি উন্নতি না হয়, শিক্ষকতার চাকরি যদি আকর্ষণীয় না হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশায় তো কেউ আসবে না। মানুষ বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগ দিতে চায় কেন, কারণ ক্যাডার কর্মকর্তার ঢের সুযোগ-সুবিধা। বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তাদের যে সুবিধা দেওয়া হয়, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদেরও সেই সুবিধা দেওয়া উচিত। তাহলেই শিক্ষার মান ভালো হবে।

শিক্ষা তো বীজধান, আপনি যেমন বীজ রোপণ করবেন, তেমন ফসল পাবেন। আজ যে ছাত্র, আগামী ১৫ বছর পর সেই তো বিসিএসের কীর্তিমান। এ ছেলেমেয়েদের যদি আপনি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা এগোবে কীভাবে? এটা তো দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রের বিনিয়োগের প্রধান ক্ষেত্র হওয়া উচিত। এখানে তা হচ্ছে না। আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত মাধ্যমিক শিক্ষা অর্থাৎ হাইস্কুল। আমাদের দেশে ৯৭ শতাংশ হাইস্কুলই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে। এটি পরিবর্তন করে শতভাগই সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলা উচিত।

শিক্ষকদের জন্য একটা পৃথক বেতন কমিশন গঠিত হওয়া উচিত। যে কমিশন সর্বক্ষণ শিক্ষকদের বেতন এবং সর্ববিধ সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি দেখবে। শিক্ষকদের প্রতি তিন বছরে এক বছর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদ্যা তো নিত্য পরিবর্তিত হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ না পেলে শিক্ষার মান উন্নত হবে না। প্রশিক্ষণ না পেলে সে শিক্ষকের পদোন্নতি হবে না। শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় প্রতি উপজেলায় গড়ে তোলা কর্তব্য। ছাত্রছাত্রীদের জাতীয় সম্পদ বিবেচনা করলে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে না করে প্রাথমিক স্কুল থেকেই করা উচিত।

দেশে যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদি উন্নতিসাধন করতে চান, তাহলে দেশে লৌহ ও ইস্পাতশিল্প গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে আপনি ‘মেশিন তৈরির মেশিন’ বানাতে পারবেন না, অর্থাৎ স্বনির্ভর শিল্প গড়তে পারবেন না। কারণ, লোহা ও ইস্পাত মৌলিক শিল্প। শিক্ষা সেই মৌলিক শিল্প, যা দিয়ে আপনি মানবশক্তি গড়ে তুলতে পারবেন, তাকে কাজে লাগাতে পারবেন। তারা ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হবে, তারা শিক্ষক হবে, দেশের হাল ধরবে।

যুগান্তর : প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সরকারের মেয়াদকাল স্পষ্ট করা হয়নি। আপনি এ সরকারের সময়সীমা কীভাবে নির্ধারণ করতে চান?

সলিমুল্লাহ খান : আগের এক প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট বলেছি, সরকার কতদিন থাকবে তা সরকারের কাজের পরিধির ওপর নির্ভর করে, নির্ভর করে কাজের গভীরতার ওপর। আমরা দেখলাম, এ সরকারের কাজের পরিধি অনেক বড় এবং গভীরতাও ঢের বেশি। সুতরাং একটু বেশি সময় লাগাই স্বাভাবিক। আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে যা বোঝানো হতো, তার একটা সংজ্ঞা ছিল সংবিধানে। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। সংবিধানে উল্লেখ করা আছে, পার্লামেন্ট ভেঙে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের পরিবর্তন সেভাবে হয়নি। এ পরিবর্তনটি ‘সাংবিধানিকভাবে’ হয়নি। হয়েছে সংবিধানের অপব্যবহারের ফলে প্রক্রিয়াস্বরূপ। সংবিধান যারা অকার্যকর করে ফেলেছে, দায়টা তাদেরই বহন করতে হবে।

সংবিধান যেহেতু অকার্যকর, কার্যক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরেই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন সংবিধানের দোহাই দিয়ে এটাকে তিন মাস সীমিত করে রাখা যাবে না। তিন মাসে বাংলাদেশে কিছুই করা যাবে না। আমাদের সরকার চালাতে ৪০-৫০ জন মন্ত্রী লাগে। বর্তমান সরকার মাত্র ২১ জন উপদেষ্টা নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। এ সরকার এখন মায়ের পেটের ভ্রূণ মাত্র, পুরোপুরি পরিপক্ব হয়নি। এ সরকারের মেয়াদ জনগণের দাবি এবং সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। জনগণ যদি না চায়, তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ যদি তাদের চলে যেতে বলে, তারা চলে যাবেন। উনি আরও বলেছেন, কোন কাজগুলো তারা শেষ করে যাবেন এবং কোন কাজগুলো তারা সূচনা করে যাবেন, তা জনগণকেই বলতে হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।

সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পটভূমি তৈরি করা। সত্যিকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, আমাদের মতো দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে যেটুকু সম্ভব, সেটুকুই করে যেতে হবে। ভোট দিতে যাওয়ার আগে প্রার্থীদের সঙ্গে জনগণকে পরিচিত হতে হবে। তাদের সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। আমাদের এ সমাজে প্রার্থী কারা হয়? যার অনেক টাকাপয়সা আছে, তারাই মনোনয়ন পান। নির্বাচনে এ ধরনের টাকাপয়সার প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কী করে অনেকটা মিতব্যয়িতার মধ্যে নির্বাচন করা যায়, তা সরকার যদি করে দিতে পারে, তাহলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন আশা করতে পারি।

যুগান্তর : রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সংস্কার কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে বলে মনে করেন কি?

সলিমুল্লাহ খান : বলা কঠিন। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল, বিএনপিও রাজনৈতিক দল। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, বর্তমান সরকার কোনো দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। জামায়াতের ওপর গত সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তারা সেটি তুলে নিয়েছেন এবং গতবার ক্ষমতায় যে দল (আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী ১৪ দল) ছিল, তাদেরও নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। নিষিদ্ধ করতে হবে তাদেরই, যারা অপরাধ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলো যে কারণে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলেছে, রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলেছে, সেই কারণগুলো দূর করতে হবে। প্রতিটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নিশ্চিত করা গেলে গণতান্ত্রিক সরকার আশা করতে পারি। যেমন আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট বলেন, রিপাবলিকান বলেন, প্রত্যেকের ভেতরেই দলীয় গণতন্ত্র আছে। এ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা পার্টির প্রার্থী মনোনীত করেন। এরকম কিছু একটা আমাদেরও করতে হবে।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

সলিমুল্লাহ খান : ধন্যবাদ।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম