আইন কার্যকর নয় বলেই নব্য জমিদারদের উদ্ভব
এ টি এম মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ (The State Acquisition And Tenancy Act, 1950)-এর মাধ্যমে খাজনাগ্রহীতা, রায়তি কৃষক, অধীনস্থ রায়তি কৃষক এবং অকৃষি প্রজার পরিবারপিছু জমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭৫ বিঘা। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাঠ পর্যায়ে সেটি কার্যকর করা হয়, যা ‘এসএ অপারেশন’ নামে সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এ আইনটি মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করার মাধ্যমে উপর্যুক্ত শ্রেণির লোকদের কাছ থেকে ৩৭৫ বিঘার অতিরিক্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, যা প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অনেকে এটাকে জমিদারি উচ্ছেদ আইন বলেও অভিহিত করে থাকেন। ১৯৮০-এর দশকে ভূমিহীন কৃষকের মাঝে খাস কৃষিজমি বণ্টনের যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তাতেও ওই আইনের আওতায় অধিগ্রহণকৃত ৮ নং রেজিস্টারভুক্ত খাস কৃষিভূমি বণ্টনের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ৮নং রেজিস্টারভুক্ত খাস কৃষিভূমি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বণ্টন করে ১৯৯০-এর দশকে নিঃশেষ হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০০-পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসন কর্তৃক ভূমিহীন কৃষকের মাঝে কোন্ খাসজমি বণ্টন, বিতরণ করা কিংবা বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কালবিলম্ব না করে মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূল আদর্শ ও নীতিমালার সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবারপিছু জমির সর্বোচ্চ সিলিং ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে Bangladesh Land Holding (Limitation) Order,1972-এর মাধ্যমে ১০০ বিঘা নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার স্বল্পকালীন শাসনামলে ওই আইন মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করে যেতে পারেননি। ১৯৭৫-পরবর্তী কোনো সরকার অদ্যাবধি ওই আইন মাঠ পর্যায়ে কার্যকরকরণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর নিজ দল আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ ২০ বছরের বেশিকাল ধরে বাংলার মসনদে আসীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০ বছরের বেশিকাল দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু Bangladesh Land Holding (Limitation) Order, 1972 মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তিনি কখনো গ্রহণ করেননি। ১৯৭৩ সাল থেকে যত ভূমিমন্ত্রী ও ভূমি সচিব ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তারা কেন ওই আইন মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ কখনো গ্রহণ করেননি, সেই রহস্য উদ্ঘাটন করা অত্যাবশ্যক। ওই আইন কার্যকর করা হলে যাদের ৩৭৫ বিঘা জমি রয়েছে, তাদের (৩৭৫-১০০) ২৭৫ বিঘা জমি সারেন্ডার করতে হতো। আমার জানামতে, কোনো কোনো ব্যবসায়ী এবং সাবেক সংসদ সদস্যদের কারও কারও ১ হাজার একরের বেশি পরিমাণ সম্পত্তির মালিকানাও রয়েছে। তাদেরও ১০০ বিঘা রেখে বাকি জমি সারেন্ডার করতে হতো। এতে করে লাখ লাখ একর জমি প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব হতো। কিন্তু ওই আইন অকার্যকর থাকায় বিত্তশালী ও প্রভাবশালী লোকজন জমির মালিকানা অর্জন অব্যাহত রেখেছেন। বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে তাদের চাহিদা অনুযায়ী জমি বিক্রি করে দিয়ে নিরীহ কৃষক ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিতে পরিণত হচ্ছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওপর কোনো জরিপ কাজ চালানো হয়নি। জরিপ করলে দেখা যাবে, ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ১০০ বিঘার বেশি পরিমাণ জমির মালিকের সংখ্যা অনেক বেশি সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি নির্বাহী কর্তৃপক্ষের গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার অবকাশ রয়েছে।
এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর মাধ্যমে পরিবারপিছু জমির পরিমাণ ১০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ৬০ বিঘা নির্ধারণ করেছিলেন। ওই আইনটিও মাঠ পর্যায়ে এখনো কার্যকর করা হয়নি। ১০০ ও ৬০ বিঘা সিলিং কার্যকর করা হলে দেশে প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষির সংখ্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সূচিত হতো এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তখন ধনাঢ্য পরিবার, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে ৬০ বিঘার অতিরিক্ত জমির মালিকানা অর্জন করা সম্ভব হতো না। ভূমি প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো ওই আইন সম্পর্কে জানেন। কিন্তু ওই আইনের কার্যকারিতা না থাকায় সরকারি আইন-কানুনের প্রতি তারা অশ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছেন এবং সেটা দুর্নীতির প্রলুব্ধ ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে চলেছে। ৬০ বিঘার বেশি জমির মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে তারা কোনো প্রশ্ন করছেন না বরং সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
সুদীর্ঘ ৫০ বছরের অধিককাল ওই আইন দুটি অকার্যকর থাকায় ভূমি মন্ত্রণালয় এবং আইন প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ হয়তো ভুলেই গেছে যে, আইন দুটি এখনো মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়নি। তাই ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩-এর ধারা ২(৪)-এর (গ) উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে-খাস ভূমি বলতে Bangladesh Land Holding (Limitation) Order, 1972 (President's Order No. 98 of 1972)-এর section 3 অনুযায়ী, পরিবার বা সংস্থার মালিকানাধীন ১০০ বিঘার অতিরিক্ত সরকারের কাছে সমর্পিত বা সমর্পণযোগ্য ভূমি বোঝায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ১০০ বিঘা সিলিং যে ক্ষেত্রে এখনো মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে ১০০ বিঘার অতিরিক্ত সমর্পিত কিংবা সমর্পণযোগ্য ভূমির প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ওই আইনে ও পরিবারপিছু ভূমির সর্বোচ্চ সিলিং ৬০ বিঘাই বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু ওই আইনটি মাঠ পর্যায়ে কার্যকরকরণের কোনো উদ্যোগ এখনো ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নেওয়া হয়নি।
এখন দেখা যাক, বাংলাদেশের সংবিধানে এ বিষয়ে কী বিধান রয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৩ : ‘উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিগুলোর মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবে জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা নিুরূপ হইবে :
অনুচ্ছেদ ১৩(গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।
অনুচ্ছেদ ১৯(২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষমবণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’
ভূমির মালিকানা বিষয়ে সাংবিধানিক বিধান হচ্ছে, ভূমির মালিকানা নির্ধারিত হবে আইনের দ্বারা; সেই আইনের উদ্দেশ্য হবে সম্পদের সুষমবণ্টন নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে সেই কাজটি করতে হবে। কাজেই রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে নীরব থাকার কোনো অবকাশ নেই।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক শ বিঘা সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করেছেন। শুধু তিনিই নয়, সরকারের আরও বহু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আমলা, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের ৩য়/৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও দুর্নীতি করে শত শত বিঘা জমির মালিকানা অর্জন করেছেন। দেশে এখন ১৯৫০ সালের ৩৭৫ বিঘা, ১৯৭২ সালের ১০০ বিঘা এবং ১৯৮৪/২০২৩ সালের ৬০ বিঘা সিলিং-এ তিনটির কোনোটিই কার্যকর না থাকায় বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা ১৯৫০-পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক যুগে প্রত্যাবর্তন করেছে। সৃষ্টি হয়েছে ৩৭৫ বিঘার বেশি মালিকানার হাজার হাজার জমিদার। দেশে এখন আবার জমিদারি উচ্ছেদের আন্দোলন করার আবশ্যকতা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে নীরব অবস্থানের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের কি জমিদারি উচ্ছেদের আন্দোলনও করতে হবে?
উপর্যুক্ত অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই আইন দুটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের কাজ অবিলম্বে শুরু করতে হবে।
এ টি এম মোস্তফা কামাল : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব