প্রশাসনে বৈষম্য এবং রাষ্ট্র ও সমাজে এর প্রভাব
জেহসান ইসলাম
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি যুগান্তর
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এটি পৃথিবীর একটি অদ্ভুত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এ কারণে যে, রাষ্ট্রটির দুই অংশের মধ্যে শুধু ভৌগোলিক ব্যবধানই ছিল প্রায় হাজার মাইল, তার ওপর মৌলিক ব্যবধান ছিল ভাষা ও সংস্কৃতিতেও। অনেকে মনে করেন, দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কোনো মিল ছিল না।
আমার মতে, ইসলাম ধর্মের আচার-আচরণ ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যেও আদতে তেমন মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকেই বিশ্বাস করত না পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠী খাঁটি মুসলমান, যার প্রমাণ আমরা ১৯৭১ সালে পেয়েছি। তাদের কথাবার্তা খেয়াল করলে এখনো তা বোঝা যায়।
দিনে দিনে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনীতি, চাকরি, শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি অনেক বিষয়ে ব্যবধান ও বৈষম্য স্পষ্ট হতে ও বাড়তে থাকে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য হিসাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর সবার মধ্যে প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যগুলো দূরীকরণে রাষ্ট্র তথা সরকার যথাযথ উদ্যোগ নেবে।
আমাদের সংবিধানও সে আলোকেই রচিত হয়েছিল। আমরা স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেছি। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলে বিরাজমান বৈষম্যগুলো দূরীকরণে আমরা এগিয়েছি নাকি পিছিয়েছি, তা মূল্যায়ন করার।
সামগ্রিক বৈষম্যগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিদগ্ধজনেরা নানা গবেষণা করছেন এবং আরও করবেন। তারা তাদের মতামত তুলে ধরবেন। একজন অতিসাধারণ ও সচেতন নাগরিক হিসাবে সামান্য পর্যবেক্ষণ ছাড়া এসব জটিল বিষয়ে আমার কোনো মতামত দেওয়ার প্রশ্নই আসে না, সাধ্যও নেই।
তবে বেসামরিক প্রশাসনে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশকে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে বিরাজমান বেশকিছু ব্যাপক ও তীব্র বৈষম্য এবং রাষ্ট্র ও সমাজে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমার কিছু মতামত রাষ্ট্রের সম্মানিত নীতিনির্ধারক ও জনগণের অবগতির জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
বর্তমানে আমাদের বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থায় ২৭টি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। এর প্রতিটিতে নিয়োগ হয় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন ধাপে অনুষ্ঠিত উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। বিদ্যমান নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী এখানে কারও কোনোভাবেই দাবি করার উপায় নেই যে, কোনো একটি ক্যাডার অন্য আরেকটি ক্যাডারের ওপর শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
দীর্ঘদিন ধরে ক্যাডারগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এক অশুভ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। ক্যাডারগুলোর মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ বা নিুতম পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এবং সময়ে সময়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও হয়েছে। তবে সমস্যার তেমন কোনো সমাধান হয়নি। এখনো বহু ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যে জর্জরিত বেসামরিক প্রশাসন।
বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ লাভের পর প্রতিটি ক্যাডারের সদস্যরা যার যার ক্যাডারে চাকরি করতে থাকেন, সময়ের ব্যবধানে পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে ক্যাডারের শীর্ষে উঠতে থাকেন। মাঠ প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারের প্রশাসনের মূলকেন্দ্র সচিবালয়ের মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করার সুযোগ পান একমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা।
উপসচিব এবং তদূর্ধ্ব পদে কাজ করার জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) বিভিন্ন ক্যাডার থেকে কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে থাকেন। আর এ নিয়োগ তথা পদোন্নতি নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে যে তুঘলকি অবস্থা বিরাজ করছে, তা বর্তমানে রীতিমতো জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এক সরকারের আমলের যোগ্য কর্মকর্তারা আরেক সরকারের আমলে হয়ে যাচ্ছেন অযোগ্য। শুধু তাই নয়, একই সরকারের আমলেই কিছুদিন আগের অযোগ্য কর্মকর্তারা হঠাৎ করে কোন্ জাদুর বলে যেন আবার যোগ্যতা লাভ করে ফেলেন, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি না পাওয়াদের বলা হয় ‘বঞ্চিত’। দুই ধরনের বঞ্চিত আছেন। ১. স্থায়ী বঞ্চিত বা অযোগ্য (যদি না তাদের প্রত্যাশামতো সরকার বদল হয়)। ২. সাময়িক বঞ্চিত বা অযোগ্য। এখানে বলা আবশ্যক, এ সমস্যাটা কেবল প্রশাসন ক্যাডারের বেলায় প্রযোজ্য। প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তরা প্রশাসন ক্যাডারের মতে দু’ভাগে বিভক্ত। একটি প্রশাসন ক্যাডার, আরেকটি ‘আদার’ (ঙঃযবৎ) ক্যাডার (প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডার থেকে আগতরা)। ওই আদার ক্যাডারের সদস্যদের সাধারণত সরকার বদলের কারণে যোগ্য বা অযোগ্য হওয়ার সুযোগ খুব একটা নেই।
প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের সরকারের পক্ষের ও বিপক্ষের লোক হওয়ার কারণ দেখিয়ে পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রবল প্রবণতা সামগ্রিক বেসামরিক প্রশাসনকে অস্থির করে ফেলছে। এদিকে অন্য ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে আগতদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসন ক্যাডারের কয়েক ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে অন্য ক্যাডার থেকে আগতরা নানারকম হতাশায় ভোগেন এবং তারাও নিজেদের যৌক্তিকভাবে ‘বঞ্চিত’ গণ্য করেন।
উপসচিব থেকে উপরের দিকে সরকারের শীর্ষ পদগুলোতে পদোন্নতি নিয়ে যে নৈরাজ্য ও বৈষম্য বিরাজ করছে, তা প্রশাসন ক্যাডারের বেলায় একরকম এবং তথাকথিত আদার ক্যাডারের বেলায় আরেক রকম। আগেই বলা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে বঞ্চনা তৈরি হয় মূলত রাজনৈতিক কারণে।
গত তিন দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করে গুটিকয়েক কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন সরকারের এত আপন, বিশ্বস্ত ও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন যে তারা বাকিদের, এমনকি তাদেরই অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে যান। কারা পদোন্নতি পাবে, কারা পাবে না, কে কোথায় পোস্টিং পাবে ইত্যাদি প্রশাসনিক সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারাই সাধারণত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। অবাক লাগে, দেশে যখন তৃণমূল পর্যন্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হয় এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তখন কতিপয় স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা কী করে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনার মতো বিষয়ে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
সবাই দুঃখজনকভাবে লক্ষ করছে, এসএসবির মতো একটি শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও তাদের প্রভাবের বাইরে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অথচ এসএসবিতে যেসব সম্মানিত ব্যক্তি আছেন, তারা সবাই রাষ্ট্রের শীর্ষ ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে সিএজি মহোদয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতির কাছে এবং অন্যরা শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ, আর কারও কাছে নয়। তাহলে পদোন্নতির বিষয়ে তারা কেন স্বাধীনভাবে ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, এ প্রশ্ন সবার।
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বেসামরিক প্রশাসনে পদে পদে বৈষম্য থাকায় দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি আশানুরূপ হচ্ছে না। কম মেধার লোকেরা অধিকতর মেধাবীদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। যতই দেশপ্রেমের কথা বলা হোক, একজন হতাশাগ্রস্ত মেধাবীর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না, যখন মেধাহীনরা চালাকি ও ষড়যন্ত্র করে তাদের দমিয়ে রাখে এবং নিজেরা অন্যায্যভাবে রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
ফলে দেশের জনসাধারণ যে সেবা এখন পাচ্ছে, তার চেয়ে অধিকতর ভালো সেবাপ্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। উন্নয়নমূলক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে প্রতি বছর হিমশিম খেতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মেধার পরিস্ফুটন লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারকে দেশে-বিদেশে বদনাম কুড়াতে হচ্ছে এবং প্রায়ই অজনপ্রিয়তা ও বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, মূলত অদক্ষ আর দুর্নীতিবাজ একটি আমলাচক্রের কারণে। যদিও আমলাতন্ত্রের মধ্যেই যথেষ্টসংখ্যক মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন, কিন্তু তাদের মেধা প্রকাশের যথাযথ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও বিপ্লবের মুখে স্বৈরাচার হাসিনার সরকারে পতনের পর বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান সরকার দ্রুত বৈষম্যমূলক এ ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে, এটা এখন সময়ের দাবি এবং বিপ্লবের মূল কথা। এক্ষেত্রে অন্যতম পদক্ষেপ হতে হবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নিরপেক্ষ সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিদ্বান ও সিভিল প্রশাসন বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে সুপিরিয়র সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) পুনর্গঠন।
জেহসান ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব