ছবি সংগৃহীত
ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত দেশের ১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা। এছাড়া এ জেলাগুলোর ৫৮৪টি ইউনিয়নের মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশে এবারের বন্যায় সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্যায় ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুমিল্লা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার-এসব জেলা। অনেক এলাকার মানুষ যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টেলিফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেকের অবস্থা সম্পর্কে জানার উপায় নেই। খাবার ও পানির চরম সংকটে পড়েছে বন্যার্ত অনেকেই।
গণমাধ্যমের তথ্য মতে, ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে গবাদিপশু, আউশের জমি তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে আমনের বীজতলা। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খেতের শাকসবজি। কাঁচা ঘরবাড়ির চালা পর্যন্ত পানি। পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। অনেক হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্রেও ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। এখন পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও সংকট কাটতে সময় লাগবে।
সরকার সাধ্যমতো ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষও যুক্ত হয়েছে এ কাজে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা চালালেও এত বড় সংকট মোচন করা কঠিন। তাছাড়া অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছাও সহজ নয়। তেমন অঞ্চলগুলোতে সেনাবাহিনী খাদ্য ও পানি পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তাতে অনেকটা স্বস্তি এলেও সব বন্যার্তের কাছে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছে না।
ভরসার কথা, এ দেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই সংগ্রামী। তারা নানা বিপদেও মনোবল হারায় না। ঘুরে দাঁড়াত জানে। এ দেশের মানুষই তো আইলা-সিডরের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকে। নদীভাঙন সাত পুরুষের ভিটা গ্রাস করে। ফসলি জমি, হাট-বাজার তলিয়ে যায়। তার পরও নদী পারের মানুষজন আবার নতুন করে জীবন সাজায়। আমাদের আশার জায়গাটি এখানেই।
তবে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর তৎপরতায় এবার একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা আমাদের ভীষণভাবে আশাবাদী করে তুলেছে। মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বস্তরের তরুণের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেওয়ার জন্য যে উদ্দীপনা দেখেছি, তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বলেই আমার বিশ্বাস। একে আমার সদ্যসমাপ্ত গণবিপ্লবের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বলেই মনে হয়েছে।
সব সময়ই যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আর্তের পাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। এবার এ মাত্রাটি বহুগুণ বেশি। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে দেখেছি উপকূলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপন্ন মানুষদের জন্য রিলিফ টিম গঠিত হয়েছে। শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে শীতার্তদের কাছে ছুটে গেছে শিক্ষার্থীরা। বন্যার মতো নানা দুর্যোগে ওরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। তবে এবার ছাপিয়ে গেছে অতীতের সব অভিজ্ঞতা। আগে প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারেই ত্রাণ তৎপরতা চলত-এবার এর পরিধি অনেক বেড়ে গেছে।
শুধু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়-প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা যার যার বিভাগের ব্যানারে অর্থ সংগ্রহ করছে। শিক্ষকরা পাশে থেকে সহযোগিতা করছেন। শুধু ক্যাম্পাস নয়, পাড়ায়-মহল্লায়ও একই উদ্দীপনায় বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। খুব ভালো লাগল আমার পাড়ার মসজিদে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর মসজিদ কমিটির সভাপতি আহ্বান জানালেন বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য।
জানালেন তাদের টিম বাড়ি বাড়ি যাবে অর্থ সংগ্রহ করতে। সাভার বাজার, আশুলিয়ায় যেখানেই গিয়েছি দেখেছি দুদিন আগেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় ছিল স্কুল-কলেজের যে ছেলেমেয়েরা এখন বাক্স নিয়ে পথচারীদের কাছে যাচ্ছে বন্যার্তদের জন্য সাহায্য চাইতে। আমি লক্ষ করেছি অধিকাংশ মানুষই সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে।
এ দৃশ্যগুলো আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে এই ভেবে যে, যদি আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে এ তারুণ্যের চলা পথকে মসৃণ করে দিতে পারি, তাহলে এরাই অসাধ্য সাধন করতে পারবে। এ সাহসী ও প্রত্যয়ী ছেলেমেয়েরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের পথদিশারী হতে পারে। কলুষিত রাজনীতিকে শাসনে রাখতে পারবে। আমাদের পুরোনো বিশ্বাস এখন বাস্তব বলেই মানছি; দীর্ঘকাল ধরে বলে আসছি, লিখে আসছি সব দলের শাসনকালেই ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদের দলীয় ছাত্ররাজনীতি অকল্যাণের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে আসছে। তাই এ ধারার ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম।
কিন্তু এসব বললেই আমাদের রাজনীতির মহাত্মনরা রে রে করে তেড়ে আসতেন। বলতেন ছাত্র রাজনীতি না করলে ভবিষ্যতে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের হাল ধরবে কী করে? আমরা বিনীতভাবে বলতাম চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর অস্ত্রবাজির ট্রেনিং পাওয়া সরকারদলীয় ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতির হাল ধরলে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করলে তার হাল কী হবে তা তো বুঝতে অসুবিধা হয় না। আমরা বরাবর মনে করি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে সময়ই নেতৃত্ব তৈরি করে দেবে। আমরা কি এবারের গণআন্দোলনে তেমন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে দেখিনি?
এবার বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে হয়তো কোনোভাবে বন্যার্তদের কষ্ট নিবারণ করা যাবে। কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে, শুধু আপৎকালীন সংকট মোকাবিলাই শেষ কথা নয়, বন্যার পানি নেমে গেলে নতুন নতুন সংকট সামনে চলে আসবে। ঘরবাড়ি মেরামতের একটি বড় চাপ থাকবে।
বিশাল অর্থনৈতিক চাপ থাকবে রাস্তাঘাট সংস্কার ও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পুনর্নিমাণে। রোগবালাই মোকাবিলা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। এত বড় অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা সরকারের জন্য সহজ হবে না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এমনিতেই দেশের অর্থভান্ডারকে সংকটে ফেলে গেছে।
এমন বাস্তবতায় দুর্গতদের পাশে এসে সহজেই দাঁড়াতে পারেন বিগত সরকারের আশীর্বাদ পাওয়া দেশে থাকা বা দেশান্তরী হওয়া ধনসম্পদ গ্রাস করা মন্ত্রী, এমপি, আমলা, শত শত কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া পুলিশের বড় কর্তারা, আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীরা, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা। রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থেকে সবাই তো টাকার পাহাড় বানিয়েছে। তাদের তো তেমন গায়ে লাগার কথা নয়, অবৈধভাবে অর্জন করা টাকা থেকে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ বন্যার্তদের জন্য পাঠান হোক। এসব তো তাদের কষ্টের কামাই নয়। বরং বন্যার্তদের সাহায্য করে পাপমুক্তির সুযোগ নিতে পারেন।
গণমাধ্যমের রিপোর্টে পড়লাম, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকে রাশিয়ার কোম্পানি বিশাল অঙ্কের কমিশন দিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ভগ্নি, ভাগ্নি ও ছেলেকে। সেসব গচ্ছিত আছে বিদেশের ব্যাংকে। অবশ্য বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে গুজব বলে জানিয়েছেন। নানা সময় জনরব ছড়িয়েছে যে, শেখ রেহানা ও জয় কমিশন বাণিজ্যে নাকি যথেষ্ট সফল ছিলেন।
এসব শুধুই জনরব না সত্যি, তা বলতে পারব না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির যে উৎসব হয়েছে, তা নিয়ে আমরা নানা সময়ই লেখার চেষ্টা করেছি। প্রতিদিন এখন কেঁচো খুঁড়তে যে সাপ বেরোচ্ছে তাতে এসব সত্যকে আর চাপা দেওয়ার সুযোগ নেই।
এত দুর্নীতির তথ্য বেরোলেও আমাদের বিশ্বাস হয়নি বঙ্গবন্ধুর পরিবার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা এসবের ঊর্ধ্বে থাকবেন তেমন বিশ্বাসই ছিল। কিন্তু যখন বেনজীর-মতিউরদের মতো সমুদ্র চোরদের কথা প্রকাশ পেল এবং এদের নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো তখন থেকে আমাদের মনে ধোঁয়াশা তৈরি হতে লাগল। আবার যখন সালমান এফ রহমানের মতো বিশাল ঋণখেলাপি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসাবে বহালতবিয়তে রইলেন তখন বিষণ্নবোধ করতে থাকলাম।
আমরা এখনো জানি না, শেখ হাসিনা দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন কিনা। গণমাধ্যমের তথ্য সত্য হলে সব দুর্নীতিবাজকে বলব, দেশের সম্পদ ছিনতাই করে যে বড় পাপ করা হয়েছে তা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। আর এ মহতী কাজ শেখ পরিবার থেকে শুরু হলে অনুসারীরা উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে আসতে পারেন।
যারা ইতোমধ্যে বিদেশে দেশের টাকা পাচার করে ফেলেছেন, তারা গোপনে বেনামে হলেও টাকা পাঠাতে থাকেন। আর দেশে যারা ধরা পড়েছেন, যেমন সালমান এফ রহমানের মতো বড় ঋণখেলাপি বা সাবেক মন্ত্রী দীপু মনির মতো মানুষ যারা দুহাতে ঘুস ও কমিশন বাণিজ্য করে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তাদের টাকা আইনের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্যা ও বন্যাপরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি তহবিলে জমা করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
দল-মতের সংকীর্ণতায় না থাকা এ সময়ের বিপ্লবী তারুণ্যের প্রতি আমাদের আস্থা অনেক বেড়েছে। এদেশের সব সাধারণ মানুষও তাদের প্রতি আস্থা রাখছে। বন্যার ত্রাণ কর্মসূচিতে এরই প্রকাশ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা ত্রাণভান্ডারে নাগরিকদের অনেকেই রিকশায়, গাড়িতে নানাভাবে পোশাক, ওষুধ, খাবার পানি, শুকনা খাবার এনে জমা করছেন।
শিশু থেকে শুরু করে গৃহিণীরাও দান করছেন জমানো টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলাম দূরের কোনো মহল্লা থেকে টেম্পোতে করে ত্রাণ নিয়ে কয়েকজন এসেছেন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। ত্রাণের প্যাকেট-বস্তায় ভরে গেছে কলাভবনের নিচতলার বিশাল করিডোর। এসব অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ক্রমে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, যদি দুষ্টচক্রের কালো ছায়া না পড়ে তবে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে অবশ্যই এগিয়ে যেতে পারব।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com