লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ
ড. সনজিত পাল
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমী মহোৎসব। যুদ্ধে আক্রান্ত বিশ্বে অজস প্রাণহানি, অর্থনৈতিক হাহাকার ও বৈশ্বিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত পৃথিবী, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর দুষ্কৃতকারীদের হামলা-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট-এমন পরিস্থিতিতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে-এ প্রার্থনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় (৪/৭-৮) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই। সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’ ভগবানের অনেক রকম অবতার আছে, যেমন-পুরুষাবতার, গুণাবতার, লীলাবতার, শক্ত্যাবেশ অবতার, মন্বন্তর অবতার ও যুগাবতার। তারা নির্ধারিত সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবতরণ করেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের উৎস-আদিপুরুষ।
‘কৃষ্’ ধাতু আকর্ষণবাচক এবং ‘ণ’ পরমানন্দবাচক। অর্থাৎ যিনি জীবদের মায়ার বন্ধন থেকে আকর্ষণ করে নিজ নিত্য দাস্যে নিয়োগপূর্বক পরমানন্দ প্রদান করেন, তিনিই কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ নামের অর্থ হচ্ছে পরম আনন্দ। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সব আনন্দের উৎস, সব আনন্দের আধার। আমরা সবাই আনন্দের অভিলাষী। ভগবান সদানন্দময়, তিনি সব আনন্দের আধার, তাই জীব যখন ভগবান্মুখী হয়ে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবাপরায়ণ হয়ে তার সান্নিধ্যে আসে, তখন তার চিরবাঞ্ছিত দিব্য আনন্দ সে অনুভব করতে পারে।
পিতামহ ব্রহ্মা ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩০) বলেছেন, ‘ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।/অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্॥’ অর্থাৎ সচ্চিদানন্দময় শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান। তিনি সৎ, চিৎ ও আনন্দময় পুরুষ। তিনি সর্ব ইন্দ্রিয়ের দ্বারা একমাত্র সেবা প্রভু। তিনি-অনাদি, সবারই আদি এবং সব কারণের পরম কারণ। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় (১০/৮) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সখা অর্জুনকে বলেছেন, ‘অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে’ অর্থাৎ ‘আমি সমস্ত জড় এবং চেতন বিশ্বের সব কিছুর উৎস। সব কিছুই আমার থেকেই প্রবর্তিত’। ‘মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় (গীতা ৭/৭)’ অর্থাৎ ‘হে ধনঞ্জয়, আমার ঊর্ধ্বে কিঞ্চিৎ বস্তুও নেই। আমিই পরমতত্ত্ব।’
বিষ্ণুপুরাণে (৬/৫/৪৭) পরমেশ্বর ভগবানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ।/জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণ্নাং ভগ ইতীঙ্গনা॥’ অর্থাৎ সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র সৌন্দর্য, সমগ্র জ্ঞান ও সমগ্র বৈরাগ্য-এই ছয়টির সমাহারকে ‘ভগ’ বলে। এই ছয়টি অচিন্ত্য গুণ যার মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে পূর্ণরূপে রয়েছে, তিনিই ভগবান। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই এই ষড়ৈশ্বর্য পূর্ণরূপে বিরাজমান।
ভগবানের তিনটি প্রকাশ, ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি কথ্যতে। প্রথমত, ভগবানের অঙ্গজ্যোতি ব্রহ্ম সর্বত্রই অণু-পরমাণুতে বিরাজমান। দ্বিতীয়ত, পরমাত্মারূপে ভগবান সবার হৃদয়ে আছেন। তৃতীয়ত, স্বয়ংরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের সর্বোচ্চ লোক গোলোক ধামে আছেন। ভগবান সর্বত্র এবং সর্বপ্রাণীর হৃদয়ে থাকলেও, ভগবানের কোনো প্রিয়-অপ্রিয় না থাকলেও, ভগবান বলেছেন তাকে জানতে হলে ভক্তি অনুশীলন করতে হবে। ‘ভক্ত্যা মাম্ অভিজানাতি-ভক্তি দ্বারা আমাকে জানতে পারবে।’ ভক্তির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, হৃষীকেণ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে, অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাই ভক্তি।
পরমেশ্বর ভগবানের অন্তরঙ্গে যে শক্তি রয়েছে, সেই শক্তিকেই অন্তরঙ্গা বা পরাশক্তি বলা হয়। এ শক্তির মাধ্যমে ভগবান নিজ বৈকুণ্ঠাদি স্বরূপ বৈভব প্রকাশ করেন। পরাশক্তিকে ভগবানের স্বরূপ শক্তি বলা হয়। এ শক্তি তিন ভাগে ব্যাখ্যা করা হয়। সৎ-চিৎ-আনন্দ। সৎ বা নিত্যবর্তমান, অর্থাৎ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎকাল মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধীন নন। তিনি চির শাশ্বত নিত্য। চিৎ বা জ্ঞানময়, তিনি অদ্বয় স্বয়ংসম্পূর্ণ জ্ঞান সমন্বিত। আনন্দ বা আনন্দময় তিনি। ভগবানের নিত্য আনন্দময়ী শক্তিকে বলে হ্লাদিনী। আর বহিরঙ্গা শক্তির মাধ্যমে জড় মহাবিশ্ব প্রকাশ করেন।
পরমেশ্বর ভগবানের মধ্যে পরম নিয়ন্তা, নিয়ন্ত্রণাধীন জীবসকল, নিখিল জগৎ, মহাকাল ও কর্ম-এসব পূর্ণরূপে বিরাজমান। এমনকি নির্বিশেষ ব্রহ্মও হচ্ছে পূর্ণ পরম পুরুষের অধীন। নির্বিশেষে ব্রহ্ম হচ্ছে পুরুষোত্তম ভগবানের রশ্মিচ্ছটা। পুরুষোত্তম ভগবান হচ্ছেন নির্বিশেষ ব্রহ্ম ও পরমাত্মা উভয়েরই ঊর্ধ্বে পরমতত্ত্ব।
পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম চেতনার উৎস। জীব ঈশ্বরের অপরিহার্য অংশ, তাই সেও চেতন। জীব ও জরা প্রকৃতি উভয়কেই প্রকৃতি বা ভগবানের শক্তি বলা হয়। কিন্তু তার মধ্যে জীবই কেবল চেতন, জরা প্রকৃতি অচেতন। সেটিই হচ্ছে পার্থক্য। তাই জীব প্রকৃতিকে উৎকৃষ্টতর প্রকৃতি বলা হয়। কেননা জীব ভগবানের মতো চৈতন্যময়, তবে কোনো অবস্থাতেই জীব সব চেতনার উৎস হতে পারে না। পরম চৈতন্যময় পরমেশ্বর ভগবান ও জীব গুণগতভাবে এক। পরমেশ্বর ভগবান পরম চৈতন্য এবং জীবের অণুচৈতন্য, উভয়ই অপ্রাকৃত।
অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে করে যে, পরমতত্ত্ব হচ্ছেন নির্বিশেষ, তার কোনো রূপ নেই, কোনো আকার নেই, কিন্তু তাদের এ ধারণাটি ভুল। তিনি হচ্ছেন অপ্রাকৃত চিন্ময় পুরুষ, সব বৈদিক শাস্ত্রে এ কথা দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কঠ উপনিষদে (২/২/১৩) বলা হয়েছে, নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্। অর্থাৎ যেমন আমরা সবাই স্বতন্ত্র জীব এবং আমাদের ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য আছে, তেমনই পরম-তত্ত্বের সর্বোচ্চ স্তরে যিনি সর্বকারণের কারণ, তারও রূপ আছে। তিনি পুরুষ, তিনি ভগবান এবং প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত সব কিছুর উৎস হচ্ছেন তিনিই। তাকে উপলব্ধি করা হলে তার অপ্রাকৃত রূপের সব কিছুই উপলব্ধি করা হয়ে যায়। যিনি স্বয়ংপূর্ণ, তিনি কখনোই নির্বিশেষ হতে পারেন না।
শ্রীমদ্ভগবতমে (২/৯/৩৩) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘হে ব্রহ্মা! সমগ্র সৃষ্টির পূর্বে পরমেশ্বর আমিই একমাত্র বর্তমান ছিলাম এবং তখন আমি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। এমনকি এই সৃষ্টির কারণীভূত প্রকৃতি পর্যন্ত ছিল না। সৃষ্টির পরও একমাত্র আমিই আছি এবং প্রলয়ের পরও পরমেশ্বর একমাত্র আমিই অবশিষ্ট থাকব।’
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতিতে সব ধর্মের মানুষ সৌম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে বাস করে আসছে। প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় উৎসবে দেশের মানুষ সহযোগিতা করেছে, উৎসবে একাত্ম হয়ে আনন্দমুখর করে তুলেছে। আমরা আগামীতেও বাঙালি জাতির সেই ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখতে চাই। শান্তি ও উৎসবমুখরভাবে প্রতিটি ধর্মাবলম্বী যেন তাদের নিজ নিজ উৎসব পালন করতে পারেন-এমন পরিবেশ তৈরিতে সবার কার্যকর ভূমিকা আশা করি। লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমী মহোৎসব আমাদের সবার জন্য শুভ হোক। সবার জীবনে এ তিথি কল্যাণ বয়ে আনুক। এ তিথিতে ভগবান সবাইকে যেন আশীর্বাদ করেন। এ দিনের প্রার্থনায় যেন বিশ্ববাসীর ঘরে ঘরে শান্তি-সমৃদ্ধি আসে-এ কামনা করি।
ড. সনজিত পাল : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ; সাবেক সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়