রাষ্ট্রের চরিত্র বদলানোর সুযোগ এসেছে
আ স ম আবদুর রব
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
রক্তাক্ত জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং পরাক্রমশালী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের সশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থান বিশ্ব রাজনীতিতে এক অনন্য ঘটনা। এটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, অবিস্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা। স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী, ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট ও মধ্যযুগীয় বর্বর রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের দাবিতে রাজপথ দখল করে। আমাদের ছাত্রসমাজ অধিকারের দাবিতে মৃত্যুকে জয় করে মুক্তি ছিনিয়ে আনার যে মশাল প্রজ্বলিত করে দিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনকে প্রেরণা জোগাবে। ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে যখন রাজনৈতিক-সামাজিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়েছিল, অন্যায়-অবিচার ও বর্বর ব্যবস্থার কালো ফণার ছোবলে রাষ্ট্র ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, তখন তা থেকে একমাত্র মুক্তির পথ গণঅভ্যুত্থান, গণবিস্ফোরণ ও গণবিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, যা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থান বা এ মহাজাগরণ শিখিয়েছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়, কীভাবে ছাত্র-জনতা বিপ্লবের পথপ্রদর্শক হয়, কীভাবে রাষ্ট্রের প্রবল সশস্ত্র শক্তিকে নিরস্ত্র থেকেও রুখে দিতে হয়। এ গণজাগরণে শত-শত ছাত্র-জনতা খুন হয়েছেন, হাজার-হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আজীবনের জন্য। এমনকি ঘরের ভেতরেও গুলিতে নিহত হয়েছে শিশু-কিশোর। আন্দোলন-লড়াইয়ে যারা প্রাণ বলিদান করেছেন এবং বুলেটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়েছেন, তারা এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।
ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণবিস্ফোরণ ও গণবিদ্রোহ বাংলাদেশকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারভিত্তিক রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের অধিকতর সুযোগ এনে দিয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে রাষ্ট্র রূপান্তরের প্রাথমিক অবলম্বন হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
এই গণঅভ্যুত্থান নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করে জাতীয় মুক্তির সূচনা করেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের প্রশ্নটি দেশজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভিপ্রায় অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ায় অভ্যুত্থানের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। অবিচার, বৈষম্য ও অপশাসনের বিরুদ্ধে এক নতুন বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে এক নতুন জাগরণ ঘটেছে। ন্যায্যতার শাশ্বত বিধান লঙ্ঘন এবং সাংবিধানিক অধিকার তথা গণতন্ত্র থেকে জনগণকে বঞ্চিত করায় সমগ্র দেশজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের ‘গণজাগরণ’ সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রদের সংগ্রামের সঙ্গে শিক্ষক, জনতা, শ্রমিক, আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ সর্বস্তরের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা আত্মসাৎ করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই আজ ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’র রূপ লাভ করেছে। এ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে ৭১ ও ২৪-এর চেতনায় নির্মাণ করতে হবে। দেশে নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, দেশের সম্পদ সুরক্ষাসহ সবকিছুকে ঢেলে সাজানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারকে অপসারণের মাধ্যমে।
গণঅভ্যুত্থানে জালিম সরকারের পতনের পর দেশকে স্থিতিশীল করা অত্যন্ত জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্রুত করণীয় হচ্ছে :
১. পুলিশ বাহিনীকে দ্রুত পুনর্গঠন ও সক্রিয় করা। ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের প্রত্যাহার করা। মানবিক পুলিশ গঠনের জন্য পুলিশ কমিশন গঠন করা।
২. প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঢেলে সাজানো ও সংস্কার করা।
৩. বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানো, দুর্নীতিবাজ ও অন্ধ দলীয় আনুগত্যশীল বিচারকদের দ্রুত অপসারণ করা।
৪. প্রতিটি উপজেলাকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও সমাজশক্তিগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে ‘ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষণ’ কমিটি করা। যে কোনো অরাজকতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া।
৬. দেশব্যাপী পণ্যের অবাধ পরিবহণ ও বাজার মূল্য স্বাভাবিক রাখা।
৭. আয়নাঘর স্থায়ীভাবে বন্ধ করা। গুম ও ক্রসফায়ারে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা।
এ করণীয়গুলো সম্পাদন হলে তা রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে সহায়ক হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই সংস্কারের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারে সংবিধান, ক্ষমতা-কাঠামো, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করে জাতির সামনে রূপরেখা হাজির করতে হবে। বৈষম্যমূলক আইন-কানুন, বিধি-বিধান পরিবর্তন করতে হবে। গণজাগরণের বিজয়কে অর্থবহ করতে হলে পুরোনো ঘুণে ধরা রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন দেশের উপযোগী রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিনির্ধারণ করতে হবে। স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা সিরাজুল আলম খানের ১৪ দফা ও জেএসডির ১০ দফা প্রস্তাবনা হাজির করা হয়েছে।
দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিনির্মাণ করতে হলে শুধু শাসক নয়, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি। ঔপনিবেশিক ও দলীয় শাসনব্যবস্থার বিপরীতে সব শক্তির অংশীদারত্ব ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ও পরাধীন আমলের পুরোনো আইন-কানুন পরিবর্তন করে স্বাধীন দেশ উপযোগী আইন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সব স্তর থেকে প্রভু-মালিক-দাস-এই অপমানজনক সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে।
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র বিনির্মাণে আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে-১. এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থার বিপরীতে ফেডারেল পদ্ধতির কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে। ২. নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। উচ্চকক্ষ গঠিত হবে উৎপাদন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে জড়িত সমাজশক্তির প্রতিনিধি নিয়ে। এ উচ্চকক্ষ থেকে নির্বাচনের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। ৩. বাংলাদেশে নয়টি প্রদেশ স্থাপন। প্রতিটি প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদ ও প্রাদেশিক সরকার থাকবে। প্রতিটি প্রদেশে হাইকোর্ট থাকবে। ৪. স্বশাসিত স্থানীয় সরকার থাকবে। ৫. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে। ৬. সাংবিধানিক আদালত গঠন করতে হবে। ৭. ভূ-রাজনীতির বাস্তবতা বিবেচনা করে জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রত্যেক কর্মক্ষম যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৮. জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করতে হবে। ৯. উপজেলাভিত্তিক শিল্পাঞ্চল গঠন করতে হবে। সামাজিক ব্যবসা চালু করতে হবে। ১০. সার্ককে পুনর্গঠন করতে হবে। সার্কের আওতায় উপাঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে হবে।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে কোনোক্রমেই ভূলুণ্ঠিত করা যাবে না। রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য ছাত্র, যুবসমাজ, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, শ্রমিক, কৃষক ও সমাজ-অভ্যন্তরে বিভিন্ন শ্রমকর্ম পেশার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শক্তিগুলোকে নিয়ে নতুন ‘গণশক্তি’ গড়ে তুলতে হবে। এ গণমুখী গণশক্তিই যাবতীয় অপশক্তির ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলা করে প্রজাতন্ত্র নির্মাণে এগিয়ে যেতে পারবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে, যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্রসহ সর্বস্তরের জনতা রাজপথে জীবন দান করেছে, লড়াই করেছে, তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। সর্বব্যাপী গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ ও জনগণের সম্মতি ও সমর্থন আবশ্যকীয় করতে হবে। গণতন্ত্র ও মানবতা বিকাশের এ যুগান্তকারী কালপর্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। পুরোনো সমাজকাঠামো ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চিরতরে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এবারের মহাজাগরণ পুরোনো শাসন পদ্ধতি বদল করে এক নবতর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
গত ১৫ বছরে একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছে। সমগ্র রাষ্ট্রকাঠামোতে বিশেষ সেই গোষ্ঠীর প্রাধান্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্র শাসক শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর আওয়ামী লীগের আধিপত্যকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়, রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষিত করতে সচেষ্ট হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্র পরিবর্তন বা অপসারণ করে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ও দুরূহ কাজ।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শক্তিকে নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটাতে হবে, যা হবে রাষ্ট্র রূপান্তরের মূল শক্তি। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করাই আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য এবং এটাই হবে আবু সাঈদ ও মুগ্ধদের প্রতি আমাদের নৈবেদ্য।
আ স ম আবদুর রব : সভাপতি, জেএসডি