Logo
Logo
×

বাতায়ন

সংস্কার: উপাচার্য নিয়োগ

Icon

ড. এম এল আর সরকার

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার: উপাচার্য নিয়োগ

বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র স্থান। উপাচার্য একটি সম্মানিত পদ। জ্ঞানে, গুণে, সততা ও সহনশীলতায় উপাচার্যদের হওয়া উচিত অতুলনীয়। কিন্তু নানা কারণে বিতর্কিত হচ্ছেন সম্মানিত উপাচার্যরা ও বিশ্ববিদ্যালয়। আজ অনেকদিন পর হয়তোবা শুরু হতে যাচ্ছে দিনবদলের পালা। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা চাইব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক।’ কথাগুলো খুবই আশা উদ্দীপক এবং দলনিরপেক্ষ একটি সরকারের জন্য এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ সত্যিই একটি অমূল্য সুযোগ।

তবে যোগ্যতাসম্পন্ন উপাচার্যের নিয়োগের কাজটি সত্যিই জটিল। কেন জটিল তা আমাদের শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে অজানা নয়। তারপরও এটুকু বলা প্রয়োজন যে, আমরা এমন একটি ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছি যেখানে ‘শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন’ লোক হয়তো পাওয়া যাবে; কিন্তু দলকানা রাজনীতিক-শিক্ষকদের ভিড়ে তেমন ব্যক্তিদের বেছে নেওয়া প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। যোগ্য শিক্ষকরা কোনোদিনই দলকানা হন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালগুলোয় বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা দেখলে মনে হয় কিছু শিক্ষক রাজনীতি করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন এবং তাদের ছাড়া অন্য কারও উপাচার্য হওয়ার যোগ্যতা নেই।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকরা উপাচার্য হওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। এখন উপাচার্য হওয়ার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো চেষ্টা করছেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকরা। তারা নানাভাবে তাদের নাম শিক্ষা উপদেষ্টা অথবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করছেন। এ রকম তদবির আগেও ছিল, তবে এবারের তদবির একটু ভিন্নতা পেয়েছে। কিছু শিক্ষক এবার ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে তদবির করতেও পিছপা হচ্ছেন না। এ তদবির বা অন্য কিছুর জোরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য হওয়ার জন্য ২০ বা ৩০ জন শিক্ষকের নাম শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে যেতে পারে। তাদের মধ্য থেকেই হয়তো কেউ উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পাবেন।

দেশবাসী এখনো বুঝতে পারছে না শেষ পর্যন্তু কারা উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পাবেন। অনেকেই ভাবছেন, হয়তো যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ শিক্ষকরা উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পাবেন। আবার অনেকে বলছেন, যত কথাই বলা হোক, শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াত ঘরানার শিক্ষকরাই উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পাবেন। তবে যারাই নিয়োগ পান না কেন, এ তদবির এবং নাম বাছাইয়ের সমস্যা হয়তো অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব, যদি বয়স, অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল, উচ্চতর ডিগ্রি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো শর্ত হিসাবে আরোপ করে উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করা যায়।

শর্ত ১ : একজন উপাচার্যকে অবশ্যই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। সেজন্য তার বয়স ৬০ বা এর বেশি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় অধিকতর কম বয়সি শিক্ষকরা উপাচার্য হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এ শিক্ষকরা মূলত রাজনীতিকে হাতিয়ার করেই উপাচার্য হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। তাদের ঠেকানোর উপায় হচ্ছে বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া।

শর্ত ২ : অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল, বিশেষ করে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারের শর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষকই আছেন, যারা নানাভাবে তদবির বা কায়দাকানুন করে প্রথম স্থান না পাওয়া সত্ত্বেও শিক্ষক হয়েছেন। এ শিক্ষকরা সুযোগসন্ধানী ও দলবাজ। দলবাজি করেই তারা একদিন শিক্ষক হয়েছেন এবং দলবাজি করেই তারা আজ উপাচার্যও হতে চান। যে কোনোভাবেই হোক না কেন, এ ধরনের শিক্ষকদের উপাচার্য পদে নিয়োগ বন্ধ করা প্রয়োজন।

শর্ত ৩ : একজন উপাচার্যকে অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে। এক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রিটি উপমহাদেশের বাইরের কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাদেরই অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে শ্রেয়। অনেক শিক্ষক আছেন, যারা রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। পদোন্নতির জন্য শেষ মুহূর্তে দেশেই বা আশপাশের কোনো দেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শুধু পদোন্নতির জন্য যারা যেনতেনভাবে পিএইচডি করেছেন, তাদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ না দেওয়াই হবে উত্তম কাজ। এ কাজটি করলে ভবিষ্যতে শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।

আমি শেষোক্ত শর্ত তথা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে বা লিখতে চাচ্ছি না। তবে উপাচার্য হতে আগ্রহী শিক্ষকরা প্রথম তিনটি শর্ত সঠিকভাবে পূরণ করছেন কি না, তা যাচাই-বাছাই করলেই দেখা যাবে, শুধু দলবাজি করে যারা উপাচার্য হতে ইচ্ছুক, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিতে হয়তো উপদেষ্টা মহোদয়ের কষ্ট কমই হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শুধু একজন যোগ্য শিক্ষককে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ প্রদান করাই যথেষ্ট নয়, উপাচার্যরা যাতে এ পদকে ইচ্ছাকৃত বা অনইচ্ছাকৃতভাবে কলুষিত করতে না পারেন, সেজন্য কিছু বিষয় অবশ্যই সংস্কার করা প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দল, শিক্ষক, ছাত্র, স্থানীয় প্রশাসন এবং নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি-সবাই উপাচার্যের কাছ থেকে ফায়দা হাসিলে সচেষ্ট হন। হ্যাঁ, উপাচার্য হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তবে দলবাজদের কাছে উপাচার্যরা হচ্ছেন ‘ঢাল-তলোয়ারবিহীন একজন সর্দার’। এ দলবাজ বা স্বার্থান্বেষী মহলের জন্যই শেষ পর্যন্ত একজন উপাচার্যকে অনিয়ম করতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়মের ক্ষেত্র খুব বেশি থাকে না। যে কাজগুলোতে অনিয়মের আশঙ্কা থাকে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-নিয়োগ, টেন্ডার ও রাজনীতি। মূলত নিয়োগ দিতে গিয়েই অনেক উপাচার্য নিয়োগ-বাণিজ্য বা নিয়োগ-রাজনীতি বা নিয়োগ-আত্মীয়তার জালে ফেঁসে যান। সমগ্র জাতির কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ধূলিসাৎ করেন, নিজের পদটিকে করেন কলঙ্কিত এবং পরিশেষে পদ হারান। সুতরাং, উপাচার্য নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান এবং উপাচার্য পদের কলঙ্কমোচনের জন্য সর্বাগ্রে যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, শিক্ষক এবং সহায়ক কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকটাই স্বচ্ছ, তবে আইনের ফাঁক দিয়ে প্রথম স্থান অধিকারীকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ প্রদানের নজির বিরল নয়। অনিয়ম দূর করার জন্য অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। ফলে প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীকে ক্ষেত্রবিশেষে আজও-১. দলীয় শিক্ষকদের পেছনে ঘুরতে হয়, ২. দল করার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, ৩. নিয়োগ-বাণিজ্য বা নিয়োগ-আত্মীয়তার ফাঁদে পড়তে হয়। এ অবস্থা থেকে অবশ্যই পরিত্রাণ পেতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য অলিখিত নীতিমালা আছে। নীতিমালার দুটি ক্ষেত্রে সংশোধন অতীব জরুরি। প্রথমে যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, অনার্স পরীক্ষার ফলাফল এবং ইংরেজি ভাষার দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন। এরূপ একটি নীতিমালা অনুসারে একজন প্রভাষক নিয়োগের জন্য মেধাতালিকা তৈরির ভিত্তি হতে পারে-১. অনার্স পরীক্ষার ফলাফল এবং মেধাতালিকায় অবস্থান ৫০ শতাংশ, ২. মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল ১৫ শতাংশ, ৩. IELTS-এর ফলাফল ১৫ শতাংশ, ৪. এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল ১০ শতাংশ, ৫. প্রকাশনা ৫ শতাংশ, এবং ৬. উপস্থাপনা ৫ শতাংশ।

দ্বিতীয় যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সংস্কার। বর্তমান নিয়মে উপাচার্য হচ্ছেন এ কমিটির প্রধান এবং বিশেষজ্ঞ সদস্যদের নিয়োগ প্রদান করা হয় প্রত্যেক বিভাগের ক্ষমতাসীন দলসমর্থিত শিক্ষকদের সুপারিশ অনুসারে। এর ফলেই হয় অনিয়ম ও দলবাজি। এটি বন্ধের জন্য নিয়োগ কমিটির কিছু সংশোধনী প্রয়োজন-ক. শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে উপাচার্য থাকা অনাবশ্যক। তবে উপাচার্য নিয়োগ অনুমোদন করবেন এবং কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তা বন্ধ করবেন, খ. নিয়োগ কমিটিতে থাকবেন ডিন, সভাপতি এবং বিশেষজ্ঞ সদস্যরা, গ. বিশেষজ্ঞ সদস্যদের অবশ্যই দলনিরপেক্ষ হতে হবে এবং বিভাগীয় একাডেমিক এবং প্ল্যানিং কমিটি তাদের নির্বাচিত করবে, ঘ. নিয়োগ কমিটি সর্বোচ্চ স্কোরপ্রাপ্তকে নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদনের জন্য উপাচার্যের কাছে প্রেরণ করবে।

সহায়ক কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে আরেকটি অনিয়মের ক্ষেত্র। আমি শুধু এটুকু বলতে চাচ্ছি যে, কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়াটি অনেকটাই অস্বচ্ছ। আত্মীয়তা এবং অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের ঘটনা প্রায়ই খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি বন্ধ করা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে কীভাবে এটি সংস্কার করা যায় সে বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য যেন আবারও নিয়োগ-বাণিজ্য বা নিয়োগ-আত্মীয়তে জড়িয়ে না পড়েন সে ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তিনি এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটি সবার কাম্য।

সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। এ রাজনীতির কুফল কী, তা আজ বর্ণনা করতে চাচ্ছি না। তবে বর্তমান অবস্থা এমন যে, একজন নতুন শিক্ষক যোগদান করলে তাকে ক্ষমতাসীন দলে বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করতে হয়। এ কাজটি নবীন শিক্ষকদের জন্য খুবই অবমাননাকর। কোনোভাবেই যেন এ কাজটি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য করতে না পারেন, সে ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতিই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় কোনো রাজনৈতিক নেতা বা স্থানীয় প্রশাসন যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং নতুন উপাচার্য যাতে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।

ড. এম এল আর সরকার : প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

lrsarker@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম