Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজার সিন্ডিকেট নির্মূল হোক প্রথম অগ্রাধিকার

Icon

সালেক উদ্দিন

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজার সিন্ডিকেট নির্মূল হোক প্রথম অগ্রাধিকার

ছবি সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন অনেক কাজ। যেমন : গণ-আন্দোলনের গণহত্যার বিচার, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতির বিচার, অর্থ পাচারের বিচার, সর্বজন গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি। এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেও যে কাজটিতে এ মুহূর্তে হাত না দিলেই নয় তা হলো, দীর্ঘদিনের দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা। বলার আর অপেক্ষা রাখে না, দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যে অবস্থা তা আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন থেকেই চলমান এবং এর মূল কারণ বাজার সিন্ডিকেটের দৃঢ় অবস্থান।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সর্বত্র সব খাতে সংঘবদ্ধ অপকর্মকারীরা জেঁকে বসে আছে। এসব অপরাধীদের সংঘবদ্ধ দলকেই আমরা সিন্ডিকেট বলে অভিহিত করে থাকি। এদের অবাধ বিচরণ কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সব ব্যবসা-বাণিজ্যে, জনশক্তি রপ্তানিতে, বন উজাড় করাসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে। দখলদার, বালুদস্যুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের লুটপাটে এ সিন্ডিকেট রাজত্ব করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বিশেষ করে গত ১৫-১৬ বছর ছিল তাদের স্বর্ণযুগ।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বত্রই সিন্ডিকেট কালচার দৃশ্যমান। কালচার বললে ভুল হবে, সম্ভবত এর সঠিক শব্দচয়ন হবে সিন্ডিকেট ক্যানসার। এ ক্যানসারের মূল উৎপাটন করে বাজারে দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এখন আপামর মানুষের দাবি। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে কোন সরকার এলো কোন সরকার গেল তা যতটা গুরুত্ব বহন করে, বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তার চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করে না।

দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রধান দাবি। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সহজলভ্যতা চায় এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দেখতে চায়। বিশেষ করে দ্বিতীয়বারের স্বাধীনতা অর্জনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার তারা পেয়েছে, তার কাছে তাদের দাবি আরও বেশি।

দেশে চাল, ডাল, তেল পেঁয়াজ রসুন চিনিসহ নিত্যপণ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে বড় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে দেশে উৎপাদিত দ্রব্য কমমূল্যে কিনে উচ্চমূল্যে বিক্রির বিষয়টি নির্ধারণ ও নিশ্চিত করছে এ সিন্ডিকেট। খুদে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসায়ীর কেউই এ বলয়ের বাইরে যেতে পারছে না। দীর্ঘদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে উচ্চমূল্য তা এ চক্রেরই কারসাজির ফল।

সিন্ডিকেটের সদস্যরা কম মূল্যে দ্রব্য কিনে অধিক মূল্যে বিক্রির বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়। ফলে প্রান্তিক চাষির যেমন খাবার জোটে না তেমনি সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিলাসিতার অন্ত থাকে না। এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের বাজার নিয়ন্ত্রক সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, সিটি করপোরেশন, মাঠ প্রশাসন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সবাই এতদিন ধরে চিনে এসেছে, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি।

ধারণা করা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যদি শুধু ঢাকা শহরের কারওয়ানবাজারের সিন্ডিকেটক নির্মূল করতে পারে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকার সব বাজারে বহু নিত্যপণ্যের মূল্য অর্ধেকে নেমে আসবে। এ তো শুধু রাজধানীর কথা বললাম। দেশে বড় বড় শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্টরা বিচরণ করছে। সেখানকার চিত্রও একই।

এবার আমদানির কথায় আসি। বাংলাদেশের আমদানিপণ্যও নিয়ন্ত্রণ করেছে একটি জোট বা সিন্ডিকেট। এ জোট দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে তাদের রয়েছে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। ব্যাংকের এলসিতেও সিন্ডিকেটের প্রভাবের কারণে পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখনো কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

বিষয়টি এতকাল বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা সংস্থা অদৃশ্য কারণে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বলতে শুনেছি, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এখন যাও পণ্য পাওয়া যাচ্ছে ভবিষ্যতে তাও পাওয়া যাবে না। যেন হীরক রাজার দেশের যোগ্য মন্ত্রী তিনি!

দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফুলেফেঁপে ঢোল হচ্ছে আর আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে ভোক্তারা। আমাদের দেশের খাদ্যদ্রব্যসহ আমদানি-রপ্তানি সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে এক ধরনের সিন্ডিকেট। এরা শেয়ারবাজারের মতো একেক সময় একেক পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়িয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে পান-সুপারি থেকে শুরু করে চাল-ডাল, পেঁয়াজ কিছুই বাদ যায়নি। তাদের প্রভাবে একদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে।

দীর্ঘদিনের অসততা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এতদিন এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায়নি। এতদিন বড় বড় সিন্ডিকেট চক্রের বাইরে থেকে কেউ আমদানি করতে এলসি খুলতে সাহস পেত না। ব্যাংক রাজি হতো না। এমনকি বাধা আসত কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দপ্তর থেকে। এত বাধা অতিক্রম করেও সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোনো পণ্য আমদানি করা হলে সেগুলো বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যেত না। এমনকি শ্রমিক গোষ্ঠীও এসব পণ্য খালাসে কাজ করতে আগ্রহী হতো না। সবার হাত-পা যেন সিন্ডিকেটের শক্তিশালী রশিতে বাঁধা ছিল। অর্থাৎ, এর সবই নিয়ন্ত্রণ করত এ চক্র। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা ও ঝুঁকিতে থাকত বাজার ব্যবস্থাপনা। এভাবেই বাজারের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি সবই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

বলতে দ্বিধা নেই, দেশের সবচেয়ে বড় অসাধু ব্যবসায়ী এবং এক সময়ের বড় ঋণখেলাপি যখন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর ব্যবসায়িক উপদেষ্টা পদে দীর্ঘদিন অধিষ্ঠিত থেকে দুর্নীতি চালিয়ে যান, তখন সেই দেশ হাজারও সিন্ডিকেটের অভয় রাজ্য হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে নিজেরা যেমন দেশের অর্থনীতিকে চুষে খেয়েছে, তেমনই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা কিছু ব্যবসায়ী পুঁজিপতিকে অন্যায়ভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জনসাধারণের সর্বনাশ করেছে।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভোক্তা বাজারে পণ্যে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না। দাম শুনে হা করে তাকিয়ে থাকছেন। কিছুই বলার নেই। একাই ক্ষোভ ঝাড়ছেন। এত কিছুর পরও ক্রেতাকে সুরক্ষা না দিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী সিন্ডিকেটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ভোক্তাদের মাঝে একধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়ে আছে।

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অপশাসনের অবসান হয়েছে। গণমানুষের পছন্দের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে যে গণহত্যা হয়েছে তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার, দীর্ঘদিনের দুর্নীতির মূল উৎপাটনের মতোই আপামর জনতার দাবি- বাজার সিন্ডিকেট ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করা হোক।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। এ জনপ্রিয়তাও ঘুণে ধরতে পারে যদি নিত্যপণ্যের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা না যায়। বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম মূলত সিন্ডিকেটের কারণে আকাশচুম্বী। বিগত সরকারের সময় তাদের আশীর্বাদে যেসব সিন্ডিকেট অবাধ বিচরণ করে মজুতদারি ব্যবসার কলকাটি নাড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে না, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। এদের এমন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যেন ভবিষ্যতে আর কেউ পণ্যের বাজার অস্থির করার মতো ঘৃণার কাজটি না করে এবং পুনরায় সিন্ডিকেট সৃষ্টি না হয়।

ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে সরকারকে বাজারের ওপর নজরদারি অবশ্যই বাড়াতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ কাজটি করতে হবে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের নজরদারি তোয়াক্কা করতে সবাই বাধ্য থাকে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের যেসব সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো পুনর্গঠিত করা। পুনর্গঠন বলতে বোঝাতে চাচ্ছি যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে এসব সংস্থা পুনর্জীবিত করা।

আমরা নিশ্চিত তারা একাগ্রচিত্তে কেঁচো খুঁড়তে শুরু করলে রাসেল ভাইপারের মতো বিষধর সাপ বেরিয়ে আসবে এবং এদের সমূলে বিনষ্ট করা সম্ভব হবে। তবেই বন্ধ হবে মজুতদারির মাধ্যমে কৃত্রিম পণ্য সংকট সৃষ্টির তৎপরতা। ধ্বংস হবে সিন্ডিকেটের সব কলকবজা। সফল হবে সরকার। এ দেশের মানুষের সেটাই প্রত্যাশা।

সালেক উদ্দিন : প্রাবন্ধিক; জীবনসদস্য, বাংলা একাডেমি

mdsalekuddin@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম