Logo
Logo
×

বাতায়ন

ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই

ছবি সংগৃহীত

একটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রের কথা বলছি। ভালো লাগার জায়গা থেকে সে শিল্প-সাহিত্যচর্চায় নিজেকে যুক্ত রাখে। মনে করি, ছেলেটির নাম শোভন (ওর অনুরোধেই নাম আড়াল করলাম)। ‘বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিষয়ক কোর্সে আমার ক্লাস করেছে।

এতে নাকি ওর দেশকে জানার আগ্রহ বেড়েছে। মাঝেমধ্যে অফিস আওয়ারে এসে নানা প্রশ্ন করে ওর জানার আগ্রহ মেটাতে চাইত। এবার কোটা সংস্কার এবং পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে রাজপথে থেকেছে। পুলিশের লাঠিচার্জে বাজেভাবে আহতও হয়েছে। চূড়ান্ত বিজয়ের পর ৫ আগস্ট রাতে শোভন টেলিফোন করে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। ১৫ আগস্ট রাতে আবার ফোন করে। গলাটা খুব ভারী। একটি অদ্ভুত কথা বলল, ওর ভাষায় নতুন করে দেশ মুক্ত করতে গিয়ে নাকি নিজে পরাধীন হয়ে গেছে। আন্দোলনে অসংখ্য তরুণ যারা জীবন দিল, তাদের আত্মা কি এমন ভুল প্রতিক্রিয়া দেখে বিষণ্ন হবে না! এরপর আরও কিছু কথা বলে ও বুকে চেপে থাকা পাথর সরাতে চাইল।

শোভন বলল, স্যার, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম। আপনি কাগজে লিখে আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। নানা জায়গা থেকেই আমরা সমর্থন পেয়েছি। আমরা রক্তমূল্যে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছি। এরপর এখন আমরা আমাদের আন্দোলনের অনেক সাথিকে ঠিক চিনতে পারছি না। শেখ হাসিনা নিজের অপকর্মের জন্য গণশত্রুতে পরিণত হয়েছেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অপরাধ কী? শোভন অকপটে বলল, আপনার ক্লাস করার সুবাদে ইতিহাসের অনেকটা গভীরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই পড়েছি। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য তার ত্যাগ জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। শেখ হাসিনাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন করা হবে কেন! তিনি তো জাতির পিতা। আজ যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে-অশ্রদ্ধা করছে, তাদের পরিচয় নিয়ে ভাবতে হবে।

শুধু বঙ্গবন্ধু কেন, ওরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুলসহ অনেকের ভাস্কর্য ভেঙেছে। পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালিবিরোধী আচরণের কারণে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের নানা ঘটনা জড়িয়ে আছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে। বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী। এ বাড়িটি তো এখন শেখ হাসিনার নয় যে, তার ওপর ক্ষোভের কারণে সেখানে আগুন দিতে হবে! ইতিহাসের সাক্ষী মূল্যবান জিনিসপত্রে সাজানো জাদুঘরটি ছাই করে দেওয়া হলো। এসব কারণে পৃথিবীর কাছে আমরা কি একটি অসভ্য জাতি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেলাম না! সংবেদনশীল মনের ছাত্র শোভন শেষ কষ্টটি প্রকাশ করল এভাবে।

বলল স্যার, ১৫ আগস্ট তো একটি কলঙ্কময় হত্যাকাণ্ড। স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু নয়! এ দিনটিকে কি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় আছে? আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কি শ্রদ্ধা জানাতে পারব না? ইচ্ছা ছিল আজ সকালে কিছু ফুল শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে নিবেদন করব বঙ্গবন্ধুর বেদিতে। কিন্তু সাহস হলো না। এ অপরাধে কে কখন আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। শেখ হাসিনা আমাদের এক রকম বন্দি করে রেখেছিলেন। এমন গৌরবময় বিজয়ের পর আবার যেন আমি আরেক ধরনের বন্দিত্ব অনুভব করলাম। সবচেয়ে কষ্ট লাগল ১৫ আগস্ট রাতে।

আগস্টের শোক তো শুধু আওয়ামী লীগের শোক নয়। একটি সভ্য জাতিরই শোক। অথচ আমাদের সতীর্থদের দেখলাম এ শোকাবহ রাতে উদ্দাম নৃত্য করছে। তা ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউবে। দুদিন আগের ভাই-বন্ধুদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শোকও যেন ভুলে গেছে। আমাদের একজন দায়িত্বশীল সমন্বয়ক একদিন পর জানালেন শ্রদ্ধা জানাতে কাউকে বাধা দেওয়া উচিত নয়। কাউকে অসম্মান করাও ছাত্রদের কাজ নয়। তিনি যদি এই ভালো কথাগুলো ১৫ আগস্টের আগে বলতেন, তাহলে হয়তো আমরা অনেক লজ্জা থেকে বাঁচতে পারতাম!

আমি শোভনকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, এমন বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের পর কিছু অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একে প্রশমিত করতে একটু সময় লাগে। এই যেমন দেখ ইউটিউবের কল্যাণে বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টার অনেক বছর আগের একটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর যথার্থ গুণকীর্তন করলেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের পুরোনো ভিডিও দেখলাম। সেখানে তিনি আবেগঘনভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তাই বলতে পারি আজ বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে অশ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে, তা তাদেরও নিশ্চয়ই আহত করেছে। কিন্তু পরিস্থিতির বাস্তবতায় তারা কোনো মন্তব্য করছেন না। সময়ে উত্তেজনা আরেকটু থিতিয়ে এলে এ মেধাবী সন্তানেরাই-যারা বিশাল আত্মত্যাগ করে এত বড় বিপ্লব সংঘটিত করেছে-সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে, তারা নিশ্চয়ই আত্মচৈতন্যে ফিরে আসবে।

তবে আমি বিশ্বাস করি, সারা দুনিয়ার সচেতন মেধাবী মানুষরাই মনে করে ইতিহাসচর্চা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দেশপ্রেমিক হতে পারে না। দেশোন্নয়নেও প্রয়োজন দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা খুঁজে নেওয়া। এ কারণে পৃথিবীর নানা দেশ, যারা শিক্ষায় এগিয়ে আছে, সেখানে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব জ্ঞানকাণ্ডেই নিজ দেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য হিসাবে বিবেচনা করে। আর নতুন প্রজন্ম যদি ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন অদূরদর্শিতা গ্রাস করবে তাদের।

একবার প্যারিসে আমার হোটেলের ফরাসি ম্যানেজারের সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলাম। আমরা জানি পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই ইংরেজি ব্যবহার প্রায় অচল। মিউজিয়ামের প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুর পরিচিতিও শুধু ফরাসি ভাষায় লেখা। ফলে ফরাসি ভাষা না জানা আমাদের খুব অসুবিধা হয়। আমি ফরাসি মঁসিয়েকে বললাম, ‘তোমরা এত কনজারভেটিভ কেন? পাশাপাশি তো ইংরেজিতেও লিখতে পারতে?’ মূল্যবান উত্তর পেলাম তার কাছ থেকে। বললেন, আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করি।

বিশ্বাস করি নিজ ভাষা ও ঐতিহ্যের শক্তিতেই আমরা আজ উন্নত বিশ্বের অংশ। আমরা চাই না ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন হয়ে আবার পিছিয়ে পড়তে। তবে আশঙ্কার সঙ্গে বললেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন খুব চিন্তিত। তাদের বিচারে বিশ্বায়নের কারণে বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস-ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফলে ফ্রান্সের অগ্রগতিতে এটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমি এর প্রমাণও পেলাম। ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত বাস্তিল দুর্গের নিদর্শন খুঁজতে আমি বাস্তিলে গিয়েছিলাম। শেইন নদীর দুপারেই শহর। কোনদিকে হতে পারে দুর্গ! নদী পারাপারে পায়ে হাঁটা অনেক ব্রিজ আছে। ব্রিজে রয়েছে অনেক ঝুল বারান্দা। সেখানে শিল্পীরা বসে তাদের আঁকা ছবি বিক্রি করেন। আবার পয়সার বিনিময়ে উপস্থিত পোট্রেটও এঁকে দেন। অনেকের কাছে প্রশ্ন করেও বাস্তিল দুর্গের খোঁজ পেলাম না।

অবশেষে টার্গেট করলাম একজন মাঝবয়সি শিল্পীকে। দুজন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-বয়সি ফরাসি তরুণ-তরুণীকেও পেলাম। ওরা পোট্রেট করতে এসেছে। বাস্তিলে বসে প্রশ্ন করে বিস্মিত হলাম, যেন বাস্তিল দুর্গ কথাটি প্রথম আমার কাছ থেকে শুনল। ফরাসি বিপ্লব বিষয়টিও যেন ওদের অচেনা। শিল্পী বললেন, বাস্তিল দুর্গ না চিনলেও তিনি ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে সামান্য জানেন। আমি অবশ্য পরে নিজেই খুঁজে বের করেছিলাম বাস্তিল দুর্গের স্মৃতিচিহ্ন।

এ অভিজ্ঞতার পর আমি নিজেদের কথা ভাবছিলাম। ফরাসিরা অনেকটা এগিয়ে যাওয়া জাতি। ওরা হয়তো এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যদি ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের এগিয়ে চলার পথ তো বন্ধ হয়ে যাবে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি অনেক বড়। এ সরকারের স্কুলশিক্ষায় নতুন নতুন কারিকুলাম তৈরির আগ্রহ ছিল বেশি। দলপ্রেমিক সরকার আওয়ামী বিশেষজ্ঞ দিয়ে এ গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনের চেষ্টা করেছে এবং বারবার হোঁচট খেয়েছে। আশঙ্কার সঙ্গে দেখছিলাম নিম্নমাধ্যমিক পর্যায় থেকে সিলেবাসে ইতিহাস পাঠ কমিয়ে ফেলা হচ্ছিল। কয়েক বছর আগে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সময়ে নতুন কারিকুলামে ইতিহাস আলাদা বিষয় না হয়ে অনেক বিষয়ের মিশ্রণে একফোঁটা ইতিহাস জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মাত্র। তাতে বাংলার গৌরবের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার সুযোগ আর তেমনভাবে থাকল না।

আমরা ইতিহাসের পেশাজীবী সংগঠনের কর্মকর্তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আলাপে বুঝলাম ইতিহাস-ঐতিহ্যচর্চার গুরুত্ব তার কাছে স্পষ্ট নয়। নির্বিকারভাবে বললেন, সবাই ইতিহাসের মতো নিজ নিজ বিষয়ে আলাদা বই চাইবে। তা তো দেওয়া যাবে না। আমরা বিস্মিত হলাম। ডাক্তার শিক্ষামন্ত্রীকে ইতিহাস-ঐতিহ্যচর্চার গুরুত্বই বোঝাতে পারলাম না যেন!

আজকের এ মেধাবী তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ কী! ওরা তো এমন শিক্ষাক্রমের সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার সুযোগ তেমন করে পায়নি। কিন্তু ওরা দেশপ্রেমবোধহীন প্রজন্ম নয়। দেশপ্রেমের শক্তি দিয়েই স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।

এমন একটি অভ্যুত্থানের পর উত্তেজনা প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত কিছুটা অস্থিতিশীলতা থাকে। নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, সে ক্ষোভের আগুনে আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সবকিছু পুড়ছে। এ সময় ন্যায়-অন্যায় খোঁজা নিরর্থক। গণ-অভ্যুত্থানের পর যত অনাচার হয়েছে এবং হচ্ছে, তার জন্য একদিন সংশ্লিষ্ট সবাই অনুতপ্ত হবে।

এসবের পেছনে কোনো কালো শক্তি আছে কি না, তা এ বিপ্লবী তরুণরাই আবিষ্কার করবে। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, কারণ যখন দেখলাম দেশপ্রেমের শক্তিতে কিশোর-তরুণরা ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতি বুঝতেই দেয়নি। চাঁদাবাজদের ওপর চড়াও হচ্ছে। বাজার মনিটরিংয়ে সক্রিয় থাকছে। এমন প্রজন্ম নিয়ে তো একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন বোনাই যায়!

তবে আমাদের দায়িত্বশীলদের বিবেচনায় রাখতে হবে, এ বিপ্লবী প্রজন্ম যাতে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন না হয়। এমনটি হলে অশুভ চক্রের চাতুর্যে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে জাতি।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@Gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম