Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশায় বুক বেঁধেছি

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আশায় বুক বেঁধেছি

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা ছাত্রজনতার দাবির মুখে, অনেক নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে দেশজুড়ে লাখো মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু সুযোগ সন্ধানী সন্ত্রাসী রাস্তাঘাট, যানবাহন, অবকাঠামো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে আগুন দেওয়া হয়। দেশের জনগণ তথা ছাত্রসমাজ তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করতেই পারে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার; কিন্তু আন্দোলন সংগ্রামের সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ আন্দোলনে অনেক নিরীহ প্রাণ ঝরে গেছে, কত মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনেছি। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে যেভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে, স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পুলিশ বাহিনীর হাতে এমন নির্মমভাবে হত্যা গোটা জাতিকে বিস্মিত করেছে। এ ধরনের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অপরাধী যে দলের হোক, সে শাস্তি পাক, এটা সবাই চায়। আবারও নতুন ইতিহাস গড়লেন এদেশের ছাত্রসমাজ। আমাদের অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ছাত্রদের দাবির মুখে কখনো কোনো আন্দোলনই বৃথা যায়নি।

আমরা এ দেশের সাধারণ মানুষ এমন এক বিশৃঙ্খল ও অরাজকতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ এমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই, যেখানে অরাজকতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, তার ওপর এ অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা ও দুর্ভোগ জীবনকে প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছিল। বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও জীবনধারণের সর্বনিম্ন উপকরণটুকু মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। প্রতি মুহূর্তে ভোগ করতে হয়েছে অন্তহীন দুর্ভোগ। ব্যাংক, বিমা, হাসপাতাল, গণপরিবহণ, অফিস-আদালতসহ এমন কোনো খাত বা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ঘুস, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, হয়রানি বা জনদুর্ভোগের শিকার হতে হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি জবাবদিহিতার অভাব। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলে সাধারণ মানুষকে এতটা দুর্ভোগের শিকার হতে হতো না। এসব বিষয় নিয়ে টকশো, গণমাধ্যম, পত্রিকায় লেখালেখি করেও কোনো লাভ হয়নি। বিগত সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জনদুর্ভোগের বিষয়গুলো কখনো আমলে নেয়নি বা নিতে চায়নি। কারণ তাদের এসব দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়নি। বিলাসবহুল জীবনে মানুষের দুঃখকষ্ট বোঝার মতো অবস্থা বা মানসিকতা থাকার কথা নয়। এ দেশের রাজনীতিবিদরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসে বিলাসবহুল জীবনের স্বাদ পেয়ে জনগণের কথা ভুলে যায়। সরকার পতনের পর দেশের মানুষ দেখছে মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের দৃশ্য। গত কয়েক দিন ধরে ছাত্ররা মাঠে নেমে এতদিনের জমানো জঞ্জাল সরিয়ে দেশকে নতুন করে সাজাতে চেষ্টা করছে। তাদের অক্লান্ত চেষ্টা আর পরিশ্রমের ফলে আমরা দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন একটা সোনার বাংলা পাব বলে আশায় বুক বেঁধেছি। জানি না আমাদের সে আশা কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে।

এ দেশের রাজনীতির প্রতি অধিকাংশ মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মেছে। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি সরকার এসেছে। এদের কেউই সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণে তেমনভাবে কাজ করেনি। কমবেশি সবাই নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসার অভাব ছিল। আর তাই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশেহারা মানুষের কান্না হিমশীতল ঘর অবধি পৌঁছাতে পারে না। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দলবাজি করে দেশের অর্থসম্পদ লুট করাতেই ব্যস্ত থাকে দলবাজরা। আমরা হাওয়া ভবন দেখেছি, এবার আয়না ঘর দেখলাম। মানুষকে গুম, খুন করার কথা শুনলাম, দেখলাম আমাদের দেশপ্রেমিকদের আসল চেহারা। সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

ছাত্র নেতাদের পরামর্শে গত ৯ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃতে নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। দেশকে পুনর্গঠনের কাজে মাঠে নেমে পড়েছে শিক্ষার্থীরা, দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমাদের সন্তানরা যারা দিনরাত মোবাইল আর ইন্টারনেটে ব্যস্ত সময় পার করে, তারাই আজ দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রবীণদের মেধা, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নবীনরা সোনার বাংলা গড়তে পারবে, এটা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি। কোনো অপশক্তির কাছে যেন তারা মাথা নত না করে। কোনো লোভ লালসা যেন তাদেরকে স্পর্শ না করে। অর্থলোভী, ক্ষমতালোভী দলবাজ, চাঁদাবাজ টেন্ডারবাজরা চাইবে তাদের এ অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে। তাই তাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে, পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে। কোনো অপশক্তির কাছে যেন তারা মাথা নত না করে। এত বছরের জঞ্জাল সারাতে সময় লাগবে। প্রতিটি খাতের দুর্নীতির লাগাম অত্যন্ত শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে, যাতে দুর্নীতি জিরো টলারেন্স পর্যায়ে না গেলেও অন্তত জিরোর কাছাকাছি আনা সম্ভব হয়। এতে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। হাসপাতালগুলোতে নজরদারি করতে হবে, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের বিল নির্ধারণসহ ডাক্তারদের ভিজিট ফি ঠিক করতে হবে। দ্রব্যমূল্যসহ ওষুধ কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট ভেঙে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে মানুষ যথাযথ সেবা পায়, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি দিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করার পদক্ষেপ নিতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে এসব বিষয় অবগত থাকার পরও বিগত সরকার শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। পাসপোর্ট অফিসসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দালালদের দৌরাত্ম্য আর দুর্নীতির কথা সর্বজনবিদিত। বহুল আলোচিত অর্থপাচার রোধ ও ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আয়কর দেই; কিন্তু নাগরিক সুবিধাদি তেমনভাবে পাই না। নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট ব্যবহারের অনুপযোগী, এগুলো চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে। যানজটের কবলে পড়ে সময়, অর্থ, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসবের পেছনে কারণ কী, তা আমরা সবাই জানি। নগরীর যানজট কমানোর জন্য সরকার এত বছর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও আমাদের সন্তানরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করে নগরীর যানজট কমানোর কাজ করেছে। এসব দেখে গর্বে বুক ভরে যায়। আসলে সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। এক কথায় সর্বত্র জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। এ অবক্ষয় রোধ ও জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য ভালো কাজে পুরস্কার ও খারাপ কাজের জন্য তিরস্কার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুততার সঙ্গে ভেঙে পড়া খাতগুলো সংস্কারে উদ্যোগী হলে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দ্রুত ফিরে আসবে। ছাত্রছাত্রীদেরও লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে হবে। দেশ গড়ার পাশাপাশি তাদের লেখাপড়াও সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে হবে। কারণ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম