Logo
Logo
×

বাতায়ন

উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটলেও উদ্বেগ কাটেনি

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটলেও উদ্বেগ কাটেনি

প্রধানত নদ-নদী, হাওড় ও খাল-বিলবেষ্টিত আমাদের দেশে আকৃতি-ওজন, দাম ও স্বাদ বিবেচনায় ‘পাঙাশ মাছ’ সবার কাছে একসময় ছিল খুবই আকর্ষণীয়। বড় প্রজাতির মাছ চিতল, আইড়, রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস প্রভৃতির মধ্যে গভীর জলের পাঙাশ মাছের কদর যেন ভিন্ন। দেখতে বেশ সুদৃশ্য। আহারে, খাবারের পাতে বড় পাঙাশ মাছের একটি টুকরো, মনে হলে এখনো জিভে পানি এসে যায়!

আক্ষেপের কথা হলো, নদীতে জন্ম নেওয়া ও গভীর জলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শখের সুস্বাদু পাঙাশ মাছ দিনে দিনে সাধারণ মানুষের কেবল নাগাল নয়, অনেকটা যেন ধারণারও বাইরে চলে গেছে। বহুল পরিচিত এ মাছটির স্বাদের কথা সহজে কল্পনাও করা যায় না। সাধারণ হাটবাজার তো দূরের কথা, মাছের ভান্ডার বলে পরিচিত বড় বড় হাওড়েও সে পাঙাশ ধরা পড়তে খুব একটা দেখা বা শোনা যায় না। ফলে এ এক বিস্মৃত অধ্যায়; পাঙাশ নিয়ে আজকাল বলতে গেলে গালগল্পই সার! এর বিপরীতে চারদিকে অন্য মাছের মতোই পাঙাশ মাছ চাষের ছড়াছড়ি। ছোট ছোট ডোবা-নালা কিংবা পুকুরে পাঙাশের চাষ এতই বেড়ে গেছে এবং সহজলভ্য হয়েছে যে, মিঠাপানির দেশি প্রজাতির মাছের অপ্রতুলতায় প্রাত্যহিক জীবনে পাঙাশই যেন ভরসা। সুলভ খাবার খেয়ে দ্রুত ও সহজে বেড়ে ওঠায় এখন অন্যসব মাছের তুলনায় পাঙাশের দাম খুব কম। স্বাদ যেমনই হোক, দিনান্তে কম আয়ের শ্রমিক শ্রেণির লোকরাও হাতে গোটা পাঙাশ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন। তুলনামূলকভাবে এটি এমন সহজলভ্য হয়েছে, ছোট আর বড় যেমনই হোক, এমন কোনো হাটবাজার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পাঙাশ মাছের সরবরাহ নেই।

২.

আমাদের কালে ১৯৭৭-১৯৭৮ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১১টি কলেজে অনার্স পড়ার ব্যবস্থা ছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে (ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর) একমাত্র আনন্দমোহন কলেজ ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। আর ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সারা দেশে অনার্স পাঠদানোপযোগী কলেজের মোট সংখ্যাটি ছিল ২৬। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১১টি কলেজ থেকে অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে আমরা মোট তিন হাজার ২০০ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করি (তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৬টি কলেজ মিলে)।

কিরাটন গ্রামের তৌহিদুল হক (তৌহিদ ভাই) ও নেয়ামতপুরের রুহুল আমীন (রুহুল ভাই) অর্থনীতি ও জাটিয়াপাড়া গ্রামের জয়ন্ত সরকার (জয়ন্ত দা) রসায়ন বিভাগে পড়তেন। তারা তিনজনই আমার সিনিয়র। তারা ছাড়া আমাদের করিমগঞ্জ উপজেলার (কিশোরগঞ্জ) আর কেউ সে সময় আনন্দমোহন কলেজে অনার্স পড়তেন বলে আমার জানা নেই। আর কেবল করিমগঞ্জ উপজেলা নয়, কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ‘১৩টি থানার (বর্তমানে উপজেলা) মধ্যে’ আনন্দমোহন কলেজে আমার ব্যাচে (১৯৭৭-১৯৭৮) ইতিহাস বিভাগে আর কোনো শিক্ষার্থীর দেখা আমি পাইনি। অনার্স তো অনেক দূরের কথা, ডিগ্রি পাসকোর্স পড়াটাও ছিল অনেক সাধনার বিষয়; চার কিংবা ছয়টি উপজেলায় খোঁজ নিলে তবেই একটি ডিগ্রি স্তরে পাঠদানোপযোগী একটি কলেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর মাস্টার্স (অনার্সের কথা আগেই কিছুটা উল্লেখ করা হয়েছে); সে তো অলীক কল্পনা। বিভাগীয় শহর ছাড়া মাস্টার্স পড়ার সুযোগ কোথায়?

৩.

কালপরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক বিষয়েই অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে; বিশেষ করে গত তিন দশকে। এ এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে নানাবিধ, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশে বর্তমানে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি আছে ১১৩টি। দুই হাজার ২৫০ কলেজে পাসকোর্স ও ৮৮২টি কলেজে অনার্স এবং ৭০টি কলেজে মাস্টার্স পড়ার বন্দোবস্ত। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৮টি; বেসরকারি ৭১টি। বিভাগীয় পাঁচ শহরে রয়েছে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় গোটা জাতিকে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ-বাহান্ন বছরের মাথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে।

ঘর থেকে বের হয়ে দুই পা ফেললেই এখন কলেজ। ডিগ্রি পাশ ও অনার্স এবং মাস্টার্স পড়তে এখন কোনো বেগ পেতে হয় না। উচ্চশিক্ষার সুযোগ যেন এসে ধরা দিয়েছে গোটা জাতির কাছে। আজকাল গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, পথে পথে সনদধারীর দেখা মেলে। কিন্তু এসব সনদের মান? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী শিখে বের হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা? কীসব শেখানো হচ্ছে ওদের? কেবল সনদ পাওয়াটাই কি সব? উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে দিনে দিনে চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের মিছিল কেবল দীর্ঘতর হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে এবং শুনলে মনে হতাশা এসে ভর করে, যখন পাঁচ-সাত বছরে হাতে পাওয়া ওইসব সনদধারীকে পুকুরে চাষ করা সস্তা দামের পাঙাশ মাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কেবল সঠিক পরিকল্পনা ও উপযুক্ত দেখভালের অভাব ও লাগামহীন দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে। এখনো দৃষ্টি দিতে না পারলে হবে-সকলই গড়ল ভেল।

বিমল সরকার : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম