প্রতিটি ঘরে একজন ন্যায়পরায়ণ ‘মা’ প্রয়োজন
ফাতিমা পারভীন
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী চিত্র
আর দশজনের মতো আমি শহরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠিনি। উপকূলীয় এলাকায় আমার জন্ম। আমার মা অতি শিক্ষিত ছিলেন না, নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন, আমার নানা ভাইয়ের কারণে। এরপর একাধিক সন্তান লালনপালনের মহান দায়িত্ব পালন করেন আমার মা। যদিও আমার মায়ের মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। তখনকার সময়ে পণ দিয়ে বিয়ে হতো। আমার মায়েরও পণে বিয়ে হয়। তখনকার সময়ে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের বিয়েগুলো এমন করে সম্পাদন হতো। মেয়েদের পণ (নগদ অর্থ কিংবা সম্পদ সম্পত্তি) দিয়ে বিয়ে করতে হতো।
আমার মায়ের জ্ঞান ও বিচক্ষণতার সঙ্গে যার পরিচয় হয়নি, তাকে বোঝাতে পারব না আমার মা সম্পর্কে। মেয়েশিশু হয়ে পৃথিবীতে আসার পর এক অন্যরকম উদাসীনতার মধ্যে বড় হতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রতি নেতিবাচকতা, নিষ্ঠুরতা, শঠতা আর প্রতারণা আমাকে খুব বেশি আড়াল করেও রাখতে পারেনি। বরং এসবের আড়ালে আশ্রয়গ্রহণ করে মানুষ হতে চেষ্টা করেছি। চাইলেই জীবনের কিছু বাস্তবতা ও নিয়তির নির্মমতা উপেক্ষা করা যায় না। শিশুকাল থেকেই ডিপ্রেশনে ভুগতাম। বড় হয়ে আকাশে উড়ব এ চেতনায় উজ্জীবিত ছিলাম। উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না, চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা কিংবা গাড়ি ছিল না। জেলা, বিভাগ, রাজধানীতে যেতে ছোট একটি লঞ্চ ছিল। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এতটুকু বুঝতাম; কিন্তু যাওয়ার পথ জানতাম না, অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া নারী জনগোষ্ঠীর একদম পেছনের সারির শেষ মানুষটি ছিলাম আমি।
এ কথা ভেবে আজ দুঃসময়গুলোর কথা মনে করে হতবাক হই। বিষখালি নদী ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে, মনে পড়ে একাকী নদীর তীরে বসে কত জোয়ার-ভাটার জল দেখেছি, কত ঢেউ গুনেছি। ওই নদী আমাকে অনেক উদার হতে শিখিয়েছে চারপাশের কার্পণ্য ও কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। নদীতীরে ঢেউয়ে ভিজতাম, ভালো লাগত। জমে থাকা বালু দিয়ে হরেকরকম ঘরবাড়ি তৈরি করতাম। বালু দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতাম নীরবে। ভালোলাগা ছিল বেশ। নিজের হাতে তৈরি করা ঘরগুলো যখন নদীর ঢেউয়ের পানিতে ভেঙে ফেলত, তখন মন খারাপের দেশে চলে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম জীবনটাও ঠিক এমনই, গড়ে আবার ভাঙে; ভাঙে আর সহজে গড়ে ওঠে না। জীবন সত্যিই রহস্যাবৃত।
হয়তো আজও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, তাই বলে যে একদম অমানুষ হয়ে যায়নি, তা-ও খুব বুঝতে পারছি। দশ বছর একাধারে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিলাম। হাজারও নারীর ঘর বেঁধে দিয়েছি, শত শত মানুষকে মামলামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এসবের পেছনে একজন মানুষের খুব সহযোগিতা ছিল, তিনি আমাকে শাসনে-ভাষণে রাখতেন ছোটবেলায়, তিনি হলেন আমার মা।
মেয়েশিশুদের কালেভাদ্রেই পরিবারে অধিকার আসে। আদর-যত্ন বলতে একালের মেয়েশিশু যা পায়, এরকম নয়। পরিবারে একমাত্র ভাইয়ের খুব কদর দেখে মনে মনে চাইতাম ঘুম থেকে উঠেই যেন ছেলেশিশু হয়ে যাই। প্রতিদিন সকালে নিজেকে খুব অসহায় লাগত। মনে হতো মা ভাইকে বেশি ভালোবাসেন। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম, তাই সবার প্রতি খেয়াল রাখা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথাটা সহজে বুঝতে চাইতাম না। সেদিনের মায়ের প্রতি সেই অভিমান থেকে আজ বেশ বুঝতে পারছি মায়ের কতখানি চেষ্টা ছিল আমাদের মানুষ করতে। আর তা বোঝার একমাত্র কারণ হলো আজ আমিও একজন ‘মা’।
চারপাশে নিষ্ঠুরতা দেখে যুদ্ধ করতে শিখেছিলাম। আমার ভালোলাগা, সবাইকে সমান ভালোবেসে বেঁচে থাকা, আর আমার সফলতা-যা-ই বলি না কেন, সবকিছুই যেন আমার পাশে বহমান বিষখালী নদীর চারপাশের অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশ এবং মায়ের কঠোর শাসন দেখেই শেখা।
আমাদের বাড়িতে একটা বড়সড় জবাবদিহিতা ছিল খাবার টেবিলে। আমরা বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। প্রতিবেশীরা একে অপরের সহায়ক ছিলেন। সন্ধ্যা হলেই নীড়ের পাখিরা ঘরে ফিরত। আমরাও ফিরতাম। মাগরিবের আজান মানে বাইরের জগৎ বন্ধ, নামাজ আদায় করে লেখাপড়া করতে হবে। ওই সময়ে ছেলে আর মেয়ে মস্ত এক বিভেদ ছিল। মার্বেল খেলা, রিং ঘোরানো, দাঁড়িয়াবান্ধা, সাইকেল চালানো এগুলোর অধিকারী ছেলেরা। আমার সেজো বোন আমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল খেলত, সাইকেল চালাত। আমিও বঞ্চিত হইনি।
মনে পড়ে, তখন সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, একদিন আমরা তিন বোন মিলে গভীর রাতে খেজুর রস চুরি করলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। মানে আমার বড় বোনদের বন্ধুরা। এখনো তাদের নাম ভুলিনি। আমি ছিলাম সবার ছোট। ছোট বলে বেশিরভাগ সময় আমাকে কেউই সঙ্গে নিত না। মনে পড়ে জেসমিন আপু ও তার ভাই মাসুম ভাইয়া দুজনে মিলে নারকেল নিয়ে আসেন। লিনা, লুনা ও রুমা আন্টি তিন বোন মিলে পাতিল আর চাল। আমরা তিন বোন খড়ি ও খেজুর রসের ব্যবস্থা করব। সবাই মিলে আগের দিন বিকাল বেলা ঠিক করা হলো রাত ৩টায় একত্র হবো সবাই। তারা সবাই আমাদের বাসার সামনে এসে টিনের চালে ঢিল মারলেই আমরা বাসা থেকে বের হবো। যে কথা, সেই কাজ।
ছোটবেলায় আমি একটু ঘুম-কাতুরে ছিলাম, সেজো বোন আমাকে চিমটি কেটে ঘুম থেকে ওঠাল। আমাকে চিমটে কাটার সময় হয়তো শব্দ করেছিলাম, তাই মায়ের ঘুম ভেঙে যায়; কিন্তু আমরা টের পাইনি। মা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তিনিও চুপিচুপি উঠেছেন, কী করবে গভীর রাতে তার দস্যি মেয়েরা দেখার জন্য। মহাযজ্ঞটি সমাপ্ত করতে উদ্যত হলাম আমাদের তিন বোনের ওপরে অর্পিত দায়িত্বের ব্যবস্থা করতে। আমাদের বোনদের কাণ্ডটি মা দূর থেকে দেখেছিলেন আর রাগে জ্বলছিলেন। মা ইচ্ছা করলেই আমরা যখন রান্নাঘর থেকে খড়ি আর খেজুর গাছের রস নামাচ্ছিলাম, তখনই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি শেষ না দেখে ছাড়বেন না। পাঁচটি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেছিল দুই বোন, আমি ছিলাম পাহারায়, রস দেখে হেসেছিলাম আনন্দে। আমার হাসার জন্য চড় খেতে হয়েছিল বোনের হাতে।
আনন্দের পরে যা হওয়ার তা-ই হলো। অভিমানী আমি নালিশের জন্য রওনা হতেই আমাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে মায়ের শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয় অন্য বোন। অনেক কষ্ট করে তিন বোন মিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসের একটি ভাঙা রুমের মধ্যে খড়ি, খেজুর রস নিয়ে গেলাম। রসের পরিমাণ দেখে সবার চোখ মাথায়, যেন ডাকাতি করে ফিরেছি। রস পাতিলে রাখতেই ধড়াম করে আমাদের পিঠে কে যেন লাঠি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করলেন। প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি, পরে মায়ের দরাজ কণ্ঠ ও বকুনিতে আমরা তিন বোন ছাড়া সবাই লাপাত্তা। অবশেষে বুঝলাম এতক্ষণে সুশাসন কর্তা জননী আমার শীতের এ রাতে তার দস্যু কন্যাদের দেখার জন্য কত অধ্যবসায় চালিয়েছেন।
ওই রাতে মা শুধু আমাদের শাসনই করলেন না, সকালে খেজুর রসের মালিকের কাছে রস ফেরতসহ আমাদের ক্ষমা চাওয়ালেন। ক্ষমা চাইতে গিয়ে আমরা সেদিন অনেক লজ্জিত ছিলাম; কিন্তু মায়ের সেদিনের আবেদনময়ী বর্ণনা জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারব না আমি। মা এমন করুণ আবেদনময়ী বর্ণনা করেছিলেন আবদুর রশিদ চাচার কাছে, তা আজও ভুলতে পারিনি। মনে হয়েছিল, আমাদের তিনি মানুষ করতে পারেননি। আমরা পুরোপুরি অমানুষ হয়ে উঠেছি। আমাদের তিন বোনের কাণ্ডটি মায়ের মুখে শুনে চাচা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার মা কিছুতেই সহজ করে বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না; এমনকি চাচাকে খেজুর রস গ্রহণ করাতে বাধ্য করেছিলেন। সেদিন আমরা অনেক লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। মায়ের প্রতি আমাদের গোপন অভিযোগগুলো বুকের গহিনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারবার। দুপুরে খাবার টেবিলে মা আমাদের নমনীয় হয়েই আদর করে খাবার তুলে দিয়ে বোঝালেন আমরা অনেক অন্যায় করেছি। অন্যের কোনোকিছু না বলে গ্রহণ করা অপরাধ।
সেই ঘটনা আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা না দিলেও আজ বুঝতে পারি, সেদিনের মায়ের শাসন আমাকে কতটা শিক্ষা দিয়েছিল। অন্তরে মানবিকতার হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত করেছিল। পাপ-পুণ্য ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছিলেন সেদিন আমার ন্যায়পরায়ণ মা।
ফাতিমা পারভীন : নারী ও শিশু অধিকারকর্মী
fatimaparvin2013@gmail