Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষকদের শেষ পর্যন্ত মাঠে নামতেই হলো

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষকদের শেষ পর্যন্ত মাঠে নামতেই হলো

এগারো শতকের মাঝপর্বে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক থেকে বাংলায় এসেছিল ব্রাহ্মণ সেন বংশীয় যোদ্ধারা। তারা বাঙালি পাল রাজাদের সৈন্য বাহিনীতে চাকরি নেয়। এরপর গোপনে শক্তি সঞ্চয় করে তারা। পাল রাজবংশের অন্তিম সময় তখন। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাংলার সিংহাসন কেড়ে নেয় তারা। ক্ষমতায় বসেই মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভুগছিল সেন রাজারা। তারা জানতে পেরেছে, বাঙালি অন্যায় শাসন মানেনি কখনো; সহস্র বছর আগেও বহিরাগত আর্য আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছিল।

আরও অনেক পরে উত্তর বাংলায় দিব্যকের নেতৃত্বে কৈবর্তরা বিদ্রোহ করে। তাই সেনদের অন্যায় শাসনকেও হয়তো মেনে নেবে না তারা। বিদ্রোহ-বিপ্লবে খুব কমই অংশ নেয় উচ্চবিত্তের মানুষ। সাধারণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপ্লবে। তাই সাধারণ বাঙালির কণ্ঠ রোধ করার জন্য সমাজে বর্ণ বিভাজন করলেন সেন রাজারা। সাধারণ বাঙালিকে কোণঠাসা করার জন্য শূদ্র নাম দিয়ে ব্রাত্যজন বানিয়ে ফেলে।

আগামীর বাঙালি প্রজন্ম যাতে পূর্বপুরুষের সংগ্রামী ঐতিহ্য জেনে শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে সেন রাজারা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শূদ্রদের। বিশেষ করে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে সাধারণ বাঙালিকে সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের অন্যায় শাসন নিরাপদ রাখতে চেয়েছে সেন রাজারা।

সেনদের মতো অভিন্ন মানসিকতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের। তারাও চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে। তাই তারা প্রতিবাদী বাঙালির ব্যাপারে সতর্ক ছিল। সেনদের মতো তারা নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে ঐতিহ্য ভোলাতে চেয়েছে। একইভাবে আঘাত হেনেছে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষার বাহন ভাষা। এ কারণে বাংলা ভুলিয়ে উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার দিকে তাকালেও অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। প্রাচীন চীনে দার্শনিক কনফুসিয়াস আর গ্রিসে সক্রেটিস তরুণ প্রজন্মকে মুক্তচিন্তার মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখানোর অপরাধে কি শাসকদের ক্রোধের শিকার হননি?

ইতিহাসের এসব সাক্ষ্য দেখে নিজেদের এখন ঘরপোড়া গরু মনে হয়। সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেতে হচ্ছে। যেভাবে আধুনিকায়নের নামে শিশু শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম নিয়ে বারবার নিরীক্ষা হচ্ছে-ভাবা হচ্ছে না, দেশের সব অঞ্চলের শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের সামর্থ্যরে দিকে; সবার গ্রহণ ক্ষমতার দিকে। এক এক পরীক্ষায় গিনিপিগ মারা গেলে নতুন নিরীক্ষায় চলে যাচ্ছে, অর্থকড়ির মচ্ছব হচ্ছে। এতে শঙ্কা হচ্ছে, কোনো পক্ষ কি ঐতিহ্যসচেতন প্রতিবাদী বাঙালির পথ রুদ্ধ করতে চাইছে? শিক্ষাকে হেলাফেলা করা হয় বলে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আজও আমরা কোনো শিক্ষাবিদকে পেলাম না। সবই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলছে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনও স্বাভাবিক ছন্দে এগোতে পারছে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে দলীয় রাজনীতির দূষিত রক্ত। তাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। রাজনীতিকরণের নোংরা খেলা চলছে নানা নীতিনির্ধারণে। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় ও অবৈধ তদবির শক্ত অবস্থান নিয়েছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবুও সরকারগুলো যেন স্বস্তি পাচ্ছিল না। মুক্তচিন্তার শিক্ষকরা রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে সরব হন। নিজেদের পক্ষে না গেলে তাতে ক্ষুব্ধ হন রাজনৈতিক নেতারা। নিজেদের পক্ষে কথা না বললে অথবা সমালোচনা করলে বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে তির্যক মন্তব্য করতে থাকেন। কখনো কখনো তা সভ্যতা-ভব্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

এদেশের আমলাতন্ত্র সরকারগুলোকে চাহিদা মতো রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেওয়ার বিনিময়ে সরকারকে তাদের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। তাই আমলারা নিজেদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসম্মানিত করা, চাপে ফেলার সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানের মতো শিক্ষকরা সমাজে সম্মানিত হতে পারেন; তেমন বেতন কাঠামো নেই এ দেশে। এদেশের আমলাদের কাছাকাছি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত শিক্ষক সমাজ। এসব তো ধীরে ধীরে অসন্তোষ বৃদ্ধিই করবে।

দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকদের জন্য সুপার স্কেল ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি ছিল। আমাদের মনে হয়, এসব দাবি থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য ‘প্রত্যয়’ নামের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় শিক্ষকদের যুক্ত করতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। শিক্ষকরা নাকি মানুষ গড়ার কারিগর। এ দেশের বাস্তবতায় আজ যারা সরকার রক্ষার কারিগর, তারা সব চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে উদর পূর্তি করছেন, আর মানুষ গড়ার কারিগররা অসম্মানিত হচ্ছেন। শিক্ষকদের অবসরের পর আর কী আছে ওই পেনশনটুকু ছাড়া? সেখানেও এমন গড়াপেটা করতে হচ্ছে কেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে একবার আলোচনারও প্রয়োজন মনে করল না? শিক্ষকরা এতটাই ব্রাত্যজন?

আমরা তো মনে করি আজ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে ক্লাস-গবেষণা, পরীক্ষা বর্জন করে মাঠে নেমেছেন, এর ক্রীড়নক সরকারই। কারণ এ আন্দোলন চলছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বারবার বহু সময় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর পলিসি হচ্ছে, শুরুতে সমাধান করতে চায় না। সব তালগোল পেকে গেলে পরে সমাধানের পথ খোঁজে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনেও তাই মনে হলো। শিক্ষকদের কর্মবিরতি প্রসঙ্গে ৬ জুলাই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্টই জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা নিয়ে এ মুহূর্তে কিছু বলবেন না। শিক্ষকদের কর্মসূচি শুরু হলে পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবস্থা নেবেন। অর্থাৎ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ধীরে চলা নীতিতে যে শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই।

শিক্ষকরা ব্যক্তি স্বার্থে আন্দোলনে নামেননি। যারা দেশজুড়ে আন্দোলন করছেন তারা এ স্কিমের আওতাভুক্ত নন। ১ জুলাই থেকে যারা শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তাই আজকের শিক্ষকরা পরবর্তী সময়ে যারা পেশায় আসবেন, তাদের নিয়ে ভাবছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা স্পষ্ট করেছেন তাদের উদ্বেগের জায়গাগুলো। তারা মনে করেন, এ পেনশন স্কিম স্পষ্টতই শিক্ষকদের মধ্যে একটি বৈষম্যের সীমারেখা টেনে দিচ্ছে। নানা রকম সামাজিক-প্রশাসনিক ও আর্থিক বৈষম্যের কারণেই মেধাবীদের এ দেশে শিক্ষকতায় খুব বেশি আকৃষ্ট করছে না। তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে আকীর্ণ আমলাতন্ত্রে নিজেদের যুক্ত করতে বা দেশান্তরী হতে বেশি পছন্দ করছেন। এর মধ্যে প্রত্যয় নামের পেনশন স্কিম তাদের আরও বিকর্ষণ করবে। এখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি চোখের সামনে সেন রাজা বা মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মতো প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষকদের সাইড লাইনে ফেলে রাখতে চান, কণ্ঠরোধ করতে চান, তাহলে দেশের শিক্ষা ভবিষ্যৎ তো ঘোরতর অন্ধকারেই নিপতিত হবে। মনে রাখতে হবে, মেধাবী মানুষ না থাকলে দুর্নীতিবাজদের পাশে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ বা সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে না। এ সত্য পাকিস্তানি হানাদাররা বুঝতে পেরেছিল বলেই বুদ্ধিজীবী হত্যায় মত্ত হয়েছিল।

শিক্ষকরা তো সরকারকে ভাববার অনেক সময় দিয়েছেন। তারা নরম কর্মসূচি হিসাবে মানববন্ধন করেছেন, অর্ধদিবস ধর্মঘটের কর্মসূচি পালন করেছেন। দাবি না মানলে দিন-তারিখ দিয়ে দিয়েছিলেন সর্বাত্মক কর্মসূচি পালনের। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বুঝিয়ে দিল, এ দেশে এখন কার্যত গণতন্ত্র চর্চা চলছে না এবং সরকার শিক্ষকদের থোড়াই কেয়ার করে। বাস শ্রমিক উইনিয়ন এমন কর্মসূচির ঘোষণা দিলে সরকারপক্ষ কয়েকবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে ফেলত। কিন্তু সরকারপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলারই প্রয়োজন মনে করেনি। বরং আন্দোলন কর্মসূচি চলমান থাকতেই কোনো রকম আলোচনা না করে, ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দিল। বোধহয় তারা বিশ্বাস করে, শিক্ষক নেতাদের নানা পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে আন্দোলন দুর্বল করে দিতে পারবেন।

আমার মনে হচ্ছে, সরকারপক্ষ অঙ্কে কিছুটা ভুল করছে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে কর্মবিরতি চলছে। এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীও অভিন্ন কর্মসূচিতে মাঠে নেমেছেন। আমাদের তো মনে হয়, সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে শিক্ষকদের মুক্ত করা ও স্বতন্ত্র পেস্কেলের দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া, তারা হয়তো আন্দোলন থামাবেন না। আর সরকার দীর্ঘদিন অনড় থেকে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করতে না পারলে, দেশ-বিদেশে খুব সুনাম কুড়াতে পারবে না। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে।

এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম