Logo
Logo
×

বাতায়ন

এ বৈষম্যের অবসান প্রয়োজন

Icon

ড. এম এল আর সরকার

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ বৈষম্যের অবসান প্রয়োজন

বলা হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশন একটি সুন্দর এবং ব্যতিক্রর্মী উদ্যোগ। কিন্তু এর অন্তরালে যে এমন বিষাক্ত ছোবল আছে, তা জানা গেল ‘প্রত্যয় পেনশন স্কিম’ ঘোষণার পর। এ স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষকরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন, এ স্কিম বৈষম্যমূলক, অপমানজনক। শিক্ষকরা এমনিতেই গাড়ি, বাড়ি, পাচক, প্রহরী-এসব পান না; এখন যদি তাদের পেনশনব্যবস্থা থেকেও বঞ্চিত করা হয়, তাহলে এ পেশায়, যাকে অনেকটা অবজ্ঞা করেই বলা হয় ‘মহান পেশা’-মেধাবীরা আসবে কেন বা থাকবেই বা কেন?

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা কোনো সমাধান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষকরা হিসাবনিকাশ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে এ স্কিমের মাধ্যমে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকার বা অর্থমন্ত্রী বলছেন, শিক্ষকদের এ ধর্মঘট অযৌক্তিক।

শিক্ষকরা আপনাদের কাছে এত ভালো কিছু কি চেয়েছে? তাহলে, কেন আপনারা এ নিধিরাম শিক্ষকদের মাসে মাসে লক্ষাধিক টাকা পেনশন দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন? আপনাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্রের আর্থিক সংশ্লেষ হ্রাস করা। এ কথাটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বজনীন পেনশন নিয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। এ বক্তব্যে বাংলা-ইংরেজিতে জগাখিচুড়ির মতো বলা হচ্ছে, ‘আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট পদ্ধতির পেনশনব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বাড়ছে।’ হ্যাঁ, সরকারের আর্থিক দুরবস্থা অবশ্যই বাড়ছে, তবে এর কারণ কী?

রাষ্ট্রের এ দুরবস্থার জন্য শিক্ষক বা ব্যাংকাররা দায়ী নন। দায়ী হচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন ঋণের সুদ, আমলাদের বিলাসবহুল জীবন এবং রাষ্ট্রের সীমাহীন অপচয়। দেশের জনগণ নিত্যনতুন ট্যাক্স বা ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছে! এমন কোনো কাজ নেই যেখানে ট্যাক্স বা ভ্যাট নেই! কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুবার ভ্যাটেরও ব্যবস্থা আছে। মানুষ কেন ট্যাক্স বা ভ্যাট দিচ্ছে? মানুষ ট্যাক্স বা ভ্যাট দেয় শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দেশের উন্নয়নের জন্য। বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। মানুষের কষ্টের টাকার এ বাজেটের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলছে তিনটি খাত : ঋণের সুদ, বিলাসিতা ও অপচয়। দোষ দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পেনশনব্যবস্থাকে। কীভাবে এ তিনটি খাত রাষ্ট্রের আর্থিক দুরবস্থা বাড়াচ্ছে, এর সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা দিচ্ছি।

দেশের বর্তমান বৈদেশিক প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি এবং দেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এ সুদ বল্গাহীনের মতো বাড়ছে এবং আরও বাড়বে। কোথায় ঠেকবে এ সুদ, তা কেউ জানে না। উন্নয়নের জন্য এবং ডলার সংকটের কারণে সরকার আরও বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছে এবং আরও নিতে চাচ্ছে। হ্যাঁ, ধরে নিলাম উন্নয়নের জন্য ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু ঋণের টাকায় বালিশকাণ্ডের মতো অপচয়গুলো কি প্রতিরোধ করা হয়েছে? না, হয়নি। পত্রপত্রিকায় অনেকেই লিখেছেন, ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার হলে এবং মেগা প্রকল্পগুলো দীর্ঘায়িত না হলে প্রায় অর্ধেক টাকা বাঁচানো যেত। আমরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছি; কিন্তু ঋণ-পিপাসা এখনো মেটেনি। সরকার আরও ঋণ চায়, নতুন নতুন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। মোট কথা, ঋণের টাকায় আমাদের ঘি খাওয়াতে চায়। কিন্তু ঋণের টাকায় ঘি খেতে খেতে দেশের সাধারণ মানুষের যে পিঠের চামড়া উঠে যাচ্ছে জনাব। জনগণ আর কত ঘি খাবে, আর কত ট্যাক্স বা ভ্যাট দেবে?

অনেকেই বলছে, ডলার সংকট মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণ নেওয়া ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই। হ্যাঁ, ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশের ২ কোটির মতো লোক বিদেশ থেকে অর্থ পাঠান, সে দেশে ডলার সংকট হয় কী করে? বাদ দিলাম, পাট, চামড়া, চিংড়ি, কাঁকড়া রপ্তানি বা গার্মেন্ট মালিকদের লাভের ডলারের কথা। কিন্তু বিশাল এ শ্রমিক গোষ্ঠীর অর্জিত ডলার যাচ্ছে কোথায়? জনাব, দেশে যারা অবৈধ বা অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে, তারাই তাদের অতিরিক্ত টাকা বিদেশে পাচার করছে। সরকার সবই জানে, কিন্তু নির্বিকার। ডলার সংকট মেটাতে একের পর এক ঋণের গর্ত করতে যাচ্ছে। এ গর্তগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

এবার শুনুন আমলাদের বিলাসবহুল জীবনের কথা। প্রাধিকারের নামে এমন কোনো সুবিধা বাকি নেই যা আমলারা পাচ্ছেন না। গাড়ি, গাড়ি পরিচালনা খরচ, পিওন, নিরাপত্তা প্রহরী, পাচক, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, সিটিং অ্যালাউন্স, ট্রাভেল অ্যালাউন্স আরও কত কী তার ইয়ত্তা নেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাজেটেই দেখুন। বাজেটে কর্মকর্তাদের বেতনের জন্য আছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মচারীদের বেতনের জন্য আছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। তাদের ভাতার জন্য বরাদ্দ আছে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। কী আশ্চর্য, মাত্র ৩৯ হাজার কোটি টাকার ভাতা! বিশাল এ ৩৯ হাজার কোটি টাকার সিংহভাগই যে কর্মকর্তাদের ভাতার জন্য ব্যয় হবে বা হচ্ছে, এ কথা বলার অবকাশ নেই। একটি গরিব দেশে বাজেটে যদি এত টাকা ভাতার জন্য বরাদ্দ থাকে, তাহলে সে দেশের আর্থিক দুরবস্থা হবে না তো কোন দেশে হবে?

মাঠ পর্যায়ে সবচেয়ে দামি গাড়ি ব্যবহার করেন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও। গাড়ি আগেও ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হলো কোটি টাকার গাড়ি প্রদান। বুঝলাম, তাদের গাড়ি প্রয়োজন। কিন্তু এত দামি গাড়ি কেন? মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি এত দামি গাড়ি পান, তাদের উপরের পদে যারা আছেন তাদের জন্য আরও দামি গাড়ি প্রয়োজন। হ্যাঁ, হয়েছেও তাই। সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর যেন ঝকঝকে-তকতকে গাড়ির হাট। এসব গাড়ি দেখলে মনেই হয় না আমরা একটি ঋণগ্রস্ত গরিব দেশের নাগরিক। বিদেশে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের জন্য ভালো গাড়ি থাকে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এত বিলাসবহুল গাড়ি আছে বলে মনে হয় না। এ গাড়ি বিলাসকে অপচয় ছাড়া আর কী বলা যায়?

বাদ দিন গাড়িবিলাসের কথা। এবার দেখুন ট্রাভেল অ্যালাউন্সের নামে কী হচ্ছে। আগে বিমানে ভ্রমণ করার সুযোগ পেত তৃতীয় গ্রেড এবং তদূর্ধ্ব গ্রেডের কর্মকর্তারা। নতুন এক নিয়মে এখন পঞ্চম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব গ্রেডের কর্মকর্তারা বিমানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ধরে নিলাম হয়তো এ নিয়মের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভাড়ার বিষয়টি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের জন্য কত ক্ষতিকর! পূর্বে বিমানে যাতায়াত করলে শুধু বিমান ভাড়াই ফেরত পাওয়া যেত। নতুন নিয়মে পাওয়া যায় প্রতি কিলোমিটার ৩০ টাকা। রাজশাহী থেকে ঢাকার বিমানের দূরত্ব প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার। নতুন নিয়মে রাজশাহী থেকে ঢাকা যাতায়াত করলে পাওয়া যাবে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। রাজশাহী থেকে ঢাকা বাংলাদেশ বিমানের বর্তমান ভাড়া ৪ হাজার ১৫০ টাকা। আগের নিয়মে পাওয়া যেত ৮ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু এখন পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। শুধু এক ভ্রমণেই সরকারের ক্ষতি ৭ হাজার ৭০০ টাকা।

অর্থমন্ত্রী মহোদয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ দেশের কর্মকর্তারা লাখ লাখবার বিভিন্ন কাজে ভ্রমণ করছেন। আমার যোগাযোগ খুবই কম, তারপরও আমি গত বছর দুবার ভ্রমণ করেছি। দুবারে খরচ বাদে শুধু ভ্রমণ বাবদ প্রায় ১৬ হাজার টাকা পকেটস্থ করেছি। শুধু আকাশপথেই নয়, ভালো সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে সড়কপথেও। আমার জিজ্ঞাসা, কী করে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটস্থ করার এ রকম একটি সিদ্ধান্ত অর্থ মন্ত্রণালয় পাশ করেছে? এসব সিদ্ধান্ত যাচাই-বাছাই করার জন্য কি সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ নেই?

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখতে। তিনি স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন শিক্ষকদের ভালোবেসে, তাদের সরকারি সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করার জন্য নয়। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়েই শিক্ষকদের করা হচ্ছে সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এমনটি হতো না। কিন্তু শিক্ষকদের দুর্ভাগ্য যে, তিনি আজ নেই। শিক্ষকদের কাছে আরও কষ্টকর বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকন্যার চোখের সামনে তারই পিতার প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়ে শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। দেশে যেখানে প্রায় ৮ লাখ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাশ হয়েছে, সেখানে সামান্য কয়েক হাজার কোটি টাকার জন্য কেন এ বিভেদের দেওয়াল তৈরি করা হচ্ছে। যারা এসব করছেন, তারা এ শিক্ষকদের কারও না কারও ছাত্রছাত্রী বা কারও না কারও সহপাঠী। কী করে তারা এ রকম কাজটি করলেন/করছেন, তা ভাবা সত্যিই লজ্জাজনক ও কষ্টকর। শিক্ষকরা তো আমলাদের অঢেল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোনো কথা বলেননি! তাহলে তারা কেন এটি করছেন?

এ দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ। সত্যিই যদি দেশের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়, তবে এর জন্য সবাইকে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে। দেশের মানুষ এত বড় বাজেটের জন্য টাকা জোগান দিচ্ছে। কিন্তু সেই টাকার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এখনো সময় আছে, বল্গাহীন ঋণ, বিলাসিতা ও অপচয় পরিহার করুন। ডলার পাচার বন্ধ করুন। এ কাজগুলো করলে সবার জন্যই শুধু পেনশনই নয় বরং মাধ্যমিকের যেসব শিক্ষক দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন তাদের জন্য সঠিক বাড়ি ভাড়া, সঠিক ঈদ-বোনাস দেওয়া সম্ভব। শিক্ষকরাও মানুষ, রাষ্ট্রের অন্যদের মতো তাদেরও সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন! বিনা কারণে শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে অন্যায়।

 

ড. এম এল আর সরকার : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

lrsarker@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম