শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে, বেড়েছে শিক্ষিত বেকারও
বিমল সরকার
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এ লেখা দেশের চাকরির পরিস্থিতি নিয়ে। বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণে অনেকে ‘যত্রতত্র’, ‘হিড়িক’, ‘ব্যাঙের ছাতা’-এমন শব্দ বা শব্দমালা ব্যবহার করে থাকেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমোদন প্রদান বা গড়ে ওঠা, বলতে গেলে ঢালাওভাবে কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুকরণ কিংবা এসবের ব্যবস্থাপনা-বন্দোবস্তের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কখনো সচেতন মহল থেকে এসব শব্দ-শব্দমালা প্রয়োগ-ব্যবহার করা হয়।
ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য প্রদানের সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘যত্রতত্র অনার্স খুলে শিক্ষিত বেকার তৈরি করা হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত বেকার তৈরি করতে চাই না।’ ৯ জানুয়ারি ২০২০ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন তিনি।
রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ভবনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে (ইইডি) সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে আরও মূল্যবান এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হলেও ‘যত্রতত্র’ অনার্স খোলার ব্যাপারে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে উচ্চারিত এমন মন্তব্যটি নিয়ে প্রচারমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে অনেক দিন বেশ আলোচিত হয়। অবশ্য এ বিষয়ে এমন মন্তব্য ও আলোচনা-সমালোচনার শুরু নব্বইয়ের দশক থেকে। বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধির জন্য সাবেক এ শিক্ষামন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
২.
গত ডিসেম্বর (২০২৩) থেকে মার্চের (২০২৪) মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ জন ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণির (১৯তম গ্রেড) ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
এছাড়া রেললাইনের নাট-বোল্টু টাইট দেওয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করে থাকেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান।
যদিও সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসাবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি কাজে যোগদান করার পর অনেক ওয়েম্যানই তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন। আর যারা এখনো কাজ করছেন, তারাও রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো পরিশ্রমের কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারছেন না। ফলে ওয়েম্যান পদে বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না সংস্থাটি।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ওয়েম্যানরা লাইন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, লাইনের অ্যালাইনমেন্ট খারাপ থাকলে সেটাকে ঠিক করা, কোথাও কাদা-মাটি জমে গেলে সেটাকে পরিষ্কার করার কাজগুলো করে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হয়।
কাজগুলো করতে হয় হেঁটে। সঙ্গে রাখতে হয় গাঁইতি, শাবল, কোদালের মতো উপকরণ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ওয়েম্যানের কাজটাই হলো পরিশ্রমের। এবার যারা নিয়োগ পেয়েছেন, সবাই মাস্টার্স করা। উচ্চশিক্ষিত অনেক তরুণ এ পদে মানিয়ে নিতে পারছেন না।
৩.
যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। সত্তরের দশক পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার জন্য দেশে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল; আর ছিল সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকশ কলেজ। কয়েক দশক আগে কলেজগুলোতে বিশ কিংবা বাইশটিতে অনার্স পড়ার সুযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে মাস্টার্স পড়ারও বন্দোবস্ত ছিল অধিভুক্ত অন্তত আট-দশটি কলেজে; অনুষদ, বিভাগ কিংবা ইনস্টিটিউটের সংখ্যাও ছিল সীমিত। পড়ার জন্য বর্তমানে প্রচলিত অর্ধেকসংখ্যক বিষয়ও চালু ছিল না। পাকিস্তান আমলে সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ মিলে সারা দেশে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েকশর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এমনকি স্বাধীনতা লাভের পর সত্তরের দশকেও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ মিলে এ সংখ্যা ১ হাজার কিংবা ২-৪ হাজারের বেশি হতো না। এক্ষেত্রে বর্তমানে পরিস্থিতি একেবারেই পালটে গেছে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের প্রথমবর্ষ অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় গত ৩ এপ্রিল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৩১টি বিষয়ে ৩৩৯টি কেন্দ্রে ৮৮০টি কলেজের মোট ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৮০ জন পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেন। আর গত মাসে (১৯ মে ২০২৪) শুরু হওয়া ২০২২ সালের অনার্স চতুর্থ বর্ষের অর্থাৎ ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থী হলো ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৮ জন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। প্রতিবছর মাস্টার্সের পরীক্ষার্থীও থাকে ১ লাখ, এমনকি ১ লাখের উপরে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে। নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, এ পরীক্ষায় ১৭৫টি কলেজ থেকে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ১৫ হাজার ৯০৯ জন। অর্থাৎ কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এছাড়া প্রতিবছর দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে।
আয়তনে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের একটি দেশ এটি। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বলতে গেলে গোটা দেশ সয়লাব। শিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশে শিক্ষার সঠিক দেখভালের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবছর লাখে লাখে, ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণী পাশ করে বের হচ্ছে। উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় ভুখা ও বেকারের মিছিল কেবলই দীর্ঘতর হচ্ছে। বিষয়টির দিকে এখনই দৃষ্টি না দিলে আমাদের সবার জন্যই কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তা বোধকরি কল্পনার অতীত।
বিমল সরকার : কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক