Logo
Logo
×

বাতায়ন

সহ্যশক্তি বটে সরকারের!

Icon

একেএম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সহ্যশক্তি বটে সরকারের!

আমি যদি ভুল না করি, তবে মনে হয় রাজনীতি বা সরকার পরিচালনায় ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি প্রথম সবচেয়ে বেশি শুনেছিলাম বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরউদ্দিন আহমদের মুখে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের একেবারেই সহ্য করা হবে না। তখন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার পর্যন্ত সব ক্ষমতাসীনরা একই ভূমিকায় আছেন। কাজীর গরুকে আর গোয়ালে পাওয়া যায়নি।

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইশতেহারে আওয়ামী লীগও অভিন্ন ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে। তারপর থেকে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগ নেতারা চারপাশ দুর্নীতিতে ডুবন্ত অবস্থায় দেখেও কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম উদ্ধৃত করে জিরো টলারেন্স ঘোষণার কথা বলে যাচ্ছেন। আরও একটি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে ‘ছাড় দেওয়া হবে না’। এভাবে কখন যে ‘জিরো টলারেন্স’ আর ‘ছাড় দেওয়া হবে না’ শব্দগুলো বাস্তব ভিত্তি হারিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যে পরিণত হয়েছে, মানুষ টেরই পায়নি।

একবার আমার এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল, স্যার, কোনো রাজনৈতিক নেতা কখনো বেফাঁস কোনো কথা বক্তৃতায় বলে ফেলে যদি বিব্রত হন, তখন তার সাথীরা বলেন ‘ও কিছু না, এটি রাজনৈতিক বক্তব্য’। তা হলে এই ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ কথাটির কী মানে দাঁড়ায়? আমি ওকে বলেছিলাম, রাজনৈতিক বক্তব্যের সহজ অর্থ হচ্ছে ‘মিছেকথা’। অর্থাৎ বক্তৃতার মঞ্চে বলতে হয় বলেন। এর কোনো তাৎপর্য বা সত্যাসত্য খোঁজার দরকার নেই।

রাজনৈতিক বক্তব্যও কখনো কখনো ভয়ানক কৌতুকপ্রদ হয়ে ওঠে। যখন বেনজীরকাণ্ড, মতিউরকাণ্ড প্রকাশ্যে এসে বুঝিয়ে দিল কী ভয়ানক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে, সরকার অসহায় হয়ে পড়েছে দুর্নীতি প্রতিহত করতে গিয়ে। ঠিক তেমন অবস্থায়ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা জাবর কাটার মতো করে বলেই যাচ্ছেন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।’ আমাদের ব্যস্ত নেতাদের কথা বলার সময় কি মেধা খরচের প্রয়োজন পড়ে না?

প্রকাশ্যে আসা বেনজীর, মতিউরদের ব্যাপারে দুদক প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর এবং অভিযুক্তরা বিদেশে পালিয়ে নিজেদের অপরাধী প্রমাণের পথ করে দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা-মন্ত্রীদের কেউ কেউ আইনের ভাষা টেনে দুর্নীতিবাজ বলতে নারাজ ছিলেন। পাশাপাশি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিরোধী দলের নেতাদের দুর্নীতির কথা এ প্রসঙ্গে টেনে যেন নিজেদের আশীর্বাদপুষ্টদের অপরাধ আড়াল করতে চাচ্ছেন। অল্প কদিন আগে সংসদে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা আমাদের চমকে দিলেন।

তিনি বেনজীর-মতিউরদের মতো দুর্নীতিবাজদের কঠিনভাবে সমালোচনা করলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবছিলাম, তাহলে কি দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে সরকারি নীতি পালটে গেল! বেশিক্ষণ লাগল না বিস্ময়ের ঘোর কাটতে। তার বক্তব্য এমন, ‘মানুষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ বলে-এবার দেখুন কারা দুর্নীতিবাজ!’ আমি অধিকতর বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবলাম, সত্যিই তো! এসব নেতা দুর্নীতিতে নয়-ঈশ্বরের আশীর্বাদে কেবল সম্পদ বাড়ান। কমিশন দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত যারা, তারা জানেন ডালের মজা কতটা তলে।

সম্প্রতি ঢাকার বাইরে একটি বড় সরকারি কলেজের সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নৈরাজ্য সম্পর্কে খবর রাখি। যেমন রাখতাম বিএনপি জমানায় ছাত্রদলের খবর। ওদের মাধ্যমেই জানতে পারি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির বখরা কত ওপর পর্যন্ত ছড়াতে হয়। এ ছাত্র নেতাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো আগ্রহ দলীয় সরকারগুলোর থাকে না। সব আমলের সরকারই যার যার ছাত্র সংগঠনগুলোর লাগাম ছেড়ে দেয়। আওয়ামী লীগের সরকার অনেক দিন ক্ষমতায়। এমন বাস্তবতায় কলেজগুলোতে ছাত্রলীগের ক্ষমতা কতটা, আমার তেমন জানা ছিল না। এ সেমিনারে আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। কলেজের যে কোনো অনুষ্ঠান, এমনকি সেমিনারের মতো অ্যাকাডেমিক আয়োজনও নাকি ছাত্রলীগ নেতাদের জানিয়ে করতে হয়। কারণ বাজেট যত ছোটই হোক, এখানে ছাত্রলীগের বখরা থাকা চাই। সেমিনার শেষে আমাকে এবং আমার দু-একজন সাথীকে কলেজ কর্তৃপক্ষ লাঞ্চ করাবেন। দেখলাম কলেজে তেমন আয়োজন নেই। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা গাড়ি করে আমাদের এক হোটেলে এনে লাঞ্চ করালেন। দুঃখ প্রকাশ করে বললেন বাধ্য হয়ে তাদের এখানে আসতে হয়েছে। কারণ তাদের বাজেট সীমিত। কলেজে আয়োজন করলে ছাত্রলীগের নেতাদের ২৫ থেকে ৩০ প্যাকেট খাবার দিতে হতো।

আরেক কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের কাণ্ডের কথা জানলাম। কলেজের বিশাল পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন হবে। নতুন ভবনের বরাদ্দ অর্থের বখরাভাগ ছাত্রলীগ নেতারা পাবে এটি বিস্ময়ের কিছু নয়। কিন্তু বেদনাদায়ক হলো পুরোনো ভবনের ইট, রড, দরজা, জানালা-যা প্রায় এক কোটি টাকায় বিক্রি করে সরকারি ফান্ডে জমা রাখা যেত, তা কলেজ কর্তৃপক্ষ মাত্র দেড় লাখ টাকায় ছাত্রলীগের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এখানেও বলা হয় সব টাকা ছাত্রলীগ নেতারা একা খান না। উপরের দিকে নানা স্তরের নেতাদের কাছে ভাগের টাকা পৌঁছে দিতে হয়।

এসব কি দুর্নীতি নয়? কিন্তু এসব বন্ধ করতে জিরো টলারেন্সের প্রবক্তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না কেন? কেমন করে ভূমিকা রাখবেন! দেশের কল্যাণে ব্যস্ত থাকায় তারা হয়তো এসব ভেতরের খবর জানেনই না! আগে জানতাম সরকারের নানা ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা থাকে। দুর্নীতি দূর করতে রয়েছে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ভীষণ ঘুমকাতুরে। কোনো বড় দুর্নীতি নিয়ে জনরব উঠলে, মিডিয়া অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করলে যখন আর আড়াল করা সম্ভব হয় না, তখন সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসে। গোয়েন্দা-দুদক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের অথর্ব দশার কথা জানেন বলেই বোধহয় বেনজীরকাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর এসব সংস্থাকে প্রশ্ন না করে আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা সাংবাদিকদেরই আক্রমণ করলেন-এসব দুর্নীতির কথা আগে কেন মিডিয়ায় প্রকাশ পেল না! এমন জবান শুনে মানুষ হাসবে, না কাঁদবে তা নির্ধারণ করা কঠিন! তিনি কি তাহলে বলতে চাইলেন সরকারের সব অর্গান ফেল করেছে? এখন সাংবাদিকরাই ভরসা?

প্রবল প্রতাপশালী বেনজীর একদিনে নয়, তার পুরো ক্ষমতাকালে শত শত কোটি টাকার সম্পদ বানালেন আর কোনো সংস্থাই টের পেল না! তাহলে জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় এদের লালন করে লাভ কী হলো! সরকারের কাছে এ ধারার দুর্নীতি পুণ্য কর্ম বলেই বোধহয় বেনজীরকে বড় বড় পদক দেওয়া হলো। শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেলেন। আমার এক পরিচিত সরকারি কর্মকর্তা তার সততা ও কর্মনিষ্ঠার কারণেই শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখন এ পুরস্কারটি নাকি তার কাছে গলার কাঁটার মতো বিঁধছে।

সরকারের দুর্বল দশার কারণে না হয় বেনজীর-মতিউরদের হিমালয়সম দুর্নীতি চোখে পড়েনি, কিন্তু সব প্রকাশ্য হলে-দেশজুড়ে শোরগোল উঠলে এদের দেশের ভেতর আটকে রাখার দায়িত্ব তো ছিল সরকারি সংস্থার। একজন জামিনপ্রাপ্ত আসামির বিচারের রায় না হওয়া পর্যন্ত তাকে পুরোপুরি অপরাধী বলা যায় না। এ অবস্থায় কি তিনি অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারেন? অথচ পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর এবং দুদক প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরও নিশ্চুপ থাকল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। দুদকের দেয়া ‘সমনে’র দিন-তারিখ শেষবারের মতো অতিবাহিত হওয়ার পরও এসব অভিযুক্তরা দুদকে হাজির হলো না। বিনা প্রশ্নে দেশ থেকে পালাতে পেরেছিল। ‘পালানো’ শব্দটিতে হয়তো নেতা-মন্ত্রীদের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু দুদকের সামনে হাজির হওয়ার শেষ সুযোগের পরও উপস্থিত না হওয়াকে পালানো ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! নাকি বেনজীর-মতিউররা দেশে থাকলে ঝুলি থেকে আরও বেড়াল বেরিয়ে যেতে পারে! তাই বিনা প্রশ্নে প্রস্থানটাই জরুরি ছিল। জমি-ফ্ল্যাট না হয় পকেটে করে নিতে পারবেন না; কিন্তু বহুসংখ্যক ব্যাংকে রাখা শত কোটি টাকা তো পাচার করা যেতে পারে। সরকার যেখানে নিশ্চুপ থাকে, বাংলাদেশ ব্যাংকও মৌনব্রত পালন করবে এটিই স্বাভাবিক। সৎ চিন্তা থাকলে মিডিয়ায় অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর প্রতি নজরদারি থাকা উচিত ছিল। বাস্তবে অ্যাকাউন্টে রাখা টাকা খালি করে দেওয়ার পর সরকার পক্ষ কি বেনজীরের সবুজ সংকেত পেয়ে অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করলেন! সব যেন সাজানো খেলা।

এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আনতে হয়। সরকারি সংস্থা কিন্তু এ দুর্নীতিবাজদের আবিষ্কার করতে পারেনি। দাপুটে বেনজীর অবসরে না গেলে মিডিয়া হয়তো সাহস করত না। অন্যদিকে গোয়েন্দা ও দুদকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে একটি অভিজাত ছাগল মতিউরের দুর্নীতি রাষ্ট্র করে দিল। এরপর মিডিয়া উৎসাহিত হয়ে বা কর্তব্যবোধ থেকে আরও দু-একজন দুর্নীতিবাজের কথা সামনে নিয়ে এসেছে। দেশের সমাজ-বাস্তবতায় নিশ্চয়ই এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক দুর্নীতিবাজ রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে আমরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির কথা বলে আসছি। এর পক্ষে অনেক তথ্য দেশের মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স যারা ঘোষণা করছেন দুর্নীতি প্রশমনে তাদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না।

আসলে আমাদের মনে হচ্ছে সরকার এখন অনেক বেশি মানবিক হয়ে পড়েছে। সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছিল বলে বা জনগণ সাধুবাদ দেবে ভেবে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিল এক সময়। এখন পায়ের নিচে মাটি শক্ত হওয়ার পর সরকারের সহ্যশক্তি অনেক বেড়েছে। জনগণের ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়েও এখন আর মাথাব্যথা নেই। চারপাশে হাত বাড়ালেই দুর্নীতিবাজের ছোঁয়া পাওয়া যায়। লোম বেছে কম্বল উজাড়ের সাহস দেখানো কি এতই সোজা! তাই সরকার ধ্যানী সন্ন্যাসীর মতো সহ্যশক্তি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। বাস্তবতা এখন যেমন-তাতে মনে হয় দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহ্যশক্তি প্রদর্শনে আমাদের দেশ হয়তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে।

একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com.

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম