স্মরণ
প্রতিবাদী ও আপসহীন এক কণ্ঠস্বর
তাহমিনা কোরাইশী
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন কামাল লোহানী। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, লড়তে হবে’-এই নীতিতে ন্যায়ের পথে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। তিনি একাধারে ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, আবৃত্তিশিল্পী, ভাষা আন্দোলনের কর্মী। বহুগুণে গুণান্বিত শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
তার সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা ছিল বলে আমি নিজেকে গর্বিত ও ধন্য মনে করি। বহুদিন আগের কথা, আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ওমর কোরাইশী কামাল লোহানী ভাইয়ের ছায়াতলে নিজেকে গড়ে নিয়েছেন। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত পরিবেশনের জন্য যেত দলবদ্ধভাবে। কামাল লোহানী ভাইয়ের সেই মতিঝিলের সরকারি কোয়ার্টারে ছিল আমাদের যাওয়া-আসা। ১৯৬৯-৭০-এ গণসংগীত যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে, মানুষের মুখে মুখে, উচ্চকণ্ঠে, যেন গানের মধ্য দিয়েই যুদ্ধে নেমে গেছি। প্রতিবাদী মানুষের চাওয়া-পাওয়া, মানুষের নির্যাতন-নিষ্পেষণের সোচ্চার শব্দগুলোর গান-গণসংগীত। দেশের প্রতি ভালোবাসার ফসল এ গান। মনে পড়ে কামাল ভাইয়ের বাসার কথা। দীপ্তি ভাবির আন্তরিকতার কথা। ভাবি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি হাসিমুখে আপ্যায়ন করতেন। ভাত না খেয়ে আসা যাবে না। এত ভালোবাসা কোথায় পাব? খুব ভালোবাসতেন ভাবি-ভাই আমাদের। নিজের বাড়ির মতোই আমরা ছিলাম কামাল ভাইয়ের বাড়িতে। তখন তাদের সন্তান সাগর আর বন্যাকে পেয়েছি। পরে জন্ম হয়েছে উর্মি লোহানীর। আমরা যেতাম, সঙ্গে মনু ভাই, মাহবুব ভাই, কেনেডি ভাই, ওমর। দলে গান গাইত মিনি হক, তার এক খালা। আমরাও খালা বলতাম। আরও অনেকেই। গানের রিহার্সেল হতো নয়াপল্টনের চৌধুরীর দোকানের পাশেই, যেখানে বর্তমানে বিএনপি অফিস। চৌধুরী ভাইয়ের টেইলার শপ ছিল গলির মুখে। তার বন্ধুত্ব ছিল তরুণদের সঙ্গে, মোটামুটি সবার সঙ্গেই। মুক্তির স্লোগানে মুখরিত পরিবেশ। সবার খবরাখবর তার কাছে থাকত। সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর ভাই তো থাকতেনই, কখনো কখনো থাকতেন ব্যান্ড শিল্পী আমীর আজম ভাই। একাত্তরের আগের কথা। তখন সবাই যেন একটি লক্ষ্যে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, নিবেদিতপ্রাণ। মত-পথ যেন কারও আলাদা ছিল না।
তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, মতিঝিল, সবুজবাগ, কমলাপুর-সব এলাকার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। কামাল লোহানী ভাইরাও চলে গেলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠযোদ্ধা হয়ে। রেজাউল করিম মানিক ভাই, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই, ওমর কোরাইশীরা আগরতলা মেলাঘর ক্যাম্পে চলে যান যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। দুই নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের তত্ত্বাবধানে মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন তারা। যুদ্ধজয় শেষে বাংলাদেশ গড়ার কাজে আবার নিজেদের সম্পৃক্ত করেন।
সংগ্রামী সাধক মানুষ কামাল লোহানীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক ইতিহাস। জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া খান সানতলা গ্রামে। তার পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন ১৯৬০ সালে।
ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন সমাজতন্ত্রের একজন কর্মী হিসাবে। ১৯৬৭ সালে মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী গঠন করেন। তিনি সভাপতি ছিলেন গণশিল্পী সংস্থা ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর। কৈশোরে প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের দুর্ভিক্ষের পীড়ন, পরবর্তী সময়ে দাঙ্গার ভয়াবহতা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সেই সময়ে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ মঞ্চায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন কামাল লোহানী। নিজেই বজ্রসেনের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছায়ানট আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শিল্পী সমবেত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সম্পাদক থাকাকালে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষায় নিরলস কর্মী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে কারামুক্তির পর সুদীর্ঘ সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন।
ছায়ানট, সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখেছেন তিনি।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ পদে দুবার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে আবারও সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কখনো কোনো কাজে আপস করেননি, ন্যায়ের পথে থেকেছেন।
২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা ওমর কোরাইশী না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এর দু’দিন পর মেয়ে বন্যা লোহানীকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে এলেন আমার ধানমন্ডির বাসায়। সেই স্মৃতি ভুলব না। নিজের অসুস্থতাকে তুচ্ছ করে তিনি এসেছিলেন। তার আন্তরিকতায় আমরা আপ্লুত হয়েছিলাম। দুঃখ করে বলেছিলেন, সেই তো এলাম তোমার বাড়িতে, কিন্তু ওমরের সঙ্গে আমার দেখা হলো না।
কামাল লোহানী ভাইও চলে গেলেন না ফেরার দেশে ২০২০ সালের ২০ জুন ৮৫ বছর বয়সে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে। তার মরদেহ মানবতার কল্যাণে ও বিজ্ঞানের সেবায় হাসপাতালে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কারণে তার সে ইচ্ছা পূর্ণতা পায়নি। তার মৃত্যুর পর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোকবার্তা দিয়ে গেছেন তার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার, স্নেহের স্বজনরা। এপার বাংলা, ওপার বাংলার ব্যক্তিত্বরা।
বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মূর্ত প্রতীক তিনি। নিরন্তর লড়াই-আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভ্রুকুটি তোয়াক্কা করেননি।
সাংবাদিক কামাল লোহানী শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনীতি অনেক বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-সংস্কৃতি ভাবনা, মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার, রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার, আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম ইত্যাদি।
আজীবন নমস্য তিনি। সারাজীবন মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। এই জুনে কামাল লোহানী ভাইয়ের শুভ জন্মদিন, সেই সঙ্গে শোকের দিনও। জন্মদিন ২৬ জুন। আর প্রয়াণের দিন ২০ জুন। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালোবাসায় থাকুন। তিনি মিশে আছেন স্বদেশের মৃত্তিকায়।
তাহমিনা কোরাইশী : কবি, কথাসাহিত্যিক