মশা দমনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা জরুরি
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। এক দেশে ছিল এক রাজা। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতেন না। তাই এক বানরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করলেন। বানরটি সুবোধ নিরাপত্তা কর্মীর মতোই মহারাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে থাকে। একদিন বানরটি দেখল মহারাজা বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর একটি মশা তার গালের উপর বসেছে। বানরটি অনেক চেষ্টা করেও মশাকে তাড়াতে অক্ষম হলো। শেষ পর্যন্ত বানরটি রেগে উঠে গিয়ে একটি অত্যন্ত ধারালো তলোয়ার নিয়ে এলো। তলোয়ার এনে দেখে মশাটি গাল থেকে উড়ে গিয়ে মহারাজার গলার ওপর পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বানরটি ধারালো তলোয়ার দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তলোয়ার চালিয়ে দিল। মশাটি স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে গেল আর বাকিটা কী হলো তা বলাই বাহুল্য।
আমাদের বর্তমান অবস্থা এই জ্ঞানী মহারাজার মতো হতে চলেছে কিনা, সেটাই প্রশ্ন। মশক দমনের জন্য শুধুই রাসায়নিক পদার্থ লার্ভি সাইড বা এডাল্টি সাইডের ওপর নির্ভরশীলতা অর্থাৎ একটিমাত্র ব্যবস্থাপনা কি আত্মঘাতী পদক্ষেপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? যেখানে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহৃত হবে সেখানে অবশ্যই পরিবেশ ও পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান, বায়োটিক ও এবায়োটিক উভয়ের উপস্থিতি ও তাদের সংরক্ষণসহ জীববৈচিত্র্যের সুসংহতের কথা অতি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। দায়িত্ব ঠিক তাদের হাতেই দিতে হবে, যারা সাবির্ক দিক বিবেচনায় নিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশ বসবাসকারী জীবজন্তুর জন্য অনুকূল না হলে পুরো ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা স্থলজ বাস্তুসংস্থান বা জলজ বাস্তুসংস্থান যাই হোক। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। আর সার্কভুর্ক্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। জল ও স্থলের পরিবেশে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিষাক্ত উপাদান এমনিতেই ক্ষতিকর। তার ওপর মশার জন্য এডাল্টি সাইডের প্রয়োগ স্থলকে এবং লার্ভি সাইড প্রয়োগ পানিকে করছে উপর্যুপরী বিষাক্ত। এ থেকে রক্ষা পেতে হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ বা সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।
এই সার্বিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে যতগুলো পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, প্রতিটি একে অপরের উপযুক্ত হবে। পরস্পরের সঙ্গে সিনারজিস্টিক হবে; অর্থাৎ একে অপরের কর্ম বা ক্রিয়াশীলতা বাড়াবে, কখনোই একে অপরের সঙ্গে বিরূপ ক্রিয়াশীলতায় থাকবে না। আর কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে যুক্তিযুক্তভাবে। অর্থাৎ যেখানে অত্যধিক মশার ঘনত্ব রয়েছে; এবং অন্য কোনো পদ্ধতি বিবেচনায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখা খুবই প্রয়োজন, কীটনাশক প্রয়োগে কোনোভাবেই মশকের প্রাকৃতিক শত্রু যেমন প্রিডেটরস, প্যারাসাইটস বা প্যাথোজেনের যেন কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়। মশার প্রাকৃতিক শত্রুর ক্ষতিসাধনের অর্থ হলো মশকির শক্তি দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা। তাই আগের গল্পের কথা মনে পড়ছে। টার্গেট ছিল মশা, কিন্তু বানরটি না বুঝে মহারাজাকেই ইতিহাসের পাতায় উঠিয়ে দিয়েছে। একইভাবে কি আমরা না বুঝে, না জেনে এমন অস্ত্র ব্যবহার করছি এবং এমনভাবে ব্যবহার করছি, যার ফলাফল-স্বস্তির বৃষ্টি হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেই এক অজানা আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে আমাদের। এক সময় ডেঙ্গুকে নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ অর্থাৎ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের রোগ বলা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের জীবনযাপনে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী ব্যক্তিরাও এ ভয়াল রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এর মূলে রয়েছে সমন্বিতভাবে সার্বিক পদক্ষেপের অভাব। গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, উত্তরা, ধানমন্ডি ইত্যাদিসহ সব এলাকার বাসিন্দারা জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরির কারখানা বাড়ির গ্যারেজসহ আশপাশে রেখে কখনোই মশাবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারবেন না। রক্ষা পাওয়ার একটাই উপায় আর তা হলো সমন্বিতভাবে সাবির্ক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ। অর্থাৎ সব শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সংঘবদ্ধভাবে এ মহাবিপদের কারণ এডিস মশার দমন নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ ও পরিপার্শ্বিক অবস্থার সার্বিক বিবেচনায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। এই একই ফ্যাকটরগুলোও কাজ করে ক্ষতিকারক কোনো অণুজীব ও পোকা-মাকড়ের ঘনত্ব-হ্রাস বৃদ্ধিতে। একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, প্যাথোজিন ও এর বাহক যে কোনো পোকা বা কীট হলো জীবন্ত উপাদান, যা পরিবেশের সব উপাদান দিয়ে প্রভাবিত হয়।
এখন পরিবেশ যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তার জীবন্ত উপাদান পরিবেশ থেকে অবশ্যই বেশি ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে। আর পরিবেশের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাহলে তার অসুস্থাতার জন্য দায়ী উপাদানগুলোর দুর্বলতার কারণে অনুজীব ও কীটগুলোও দুর্বল থাকে। ফলে বসবাসকারী মানুষও এসব ক্ষতিকারক উপাদান থেকে সুস্থ থাকে। তাই আমাদের মূল দায়িত্ব হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পরিবেশের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। আর এ কাজের জন্য চাই সমন্বয়। সমন্বয় হতে হবে অবশ্যই মিথোজীবিতার ভিত্তিতে। কখনোই যেন কোনো স্থানে প্যারাসাইটিক বা এন্টাজোনেস্টিকভাবে সমন্বয় না হয়। এ সিমবায়েটিক সমন্বয়ের সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক পদক্ষেপ অর্থাৎ সবার নিজ নিজ দায়িত্বের ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। নিয়ে আসতে হবে হারমোনিক সিস্টেম। একটি শব্দ উৎপাদন যন্ত্র যেমন শুধুই শব্দদূষণ করতে থাকে; আর অনেক বাদ্যযন্ত্র একত্রে একটি সুমধুর সুর তৈরি করতে পারে। এ সুর ও তালের মাধ্যমেই তৈরি হয় হৃদয়স্পর্শী গান। ঠিক তেমনি একক পদ্ধতি বা একক চেষ্টা কখনোই নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে সফলতা আনতে পারে না। সফলতা পেতে প্রয়োজন সবার একসঙ্গে একযোগে সমন্বিত সার্বিক পদক্ষেপ।
পরিবেশবান্ধব ও আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার ওপর চালিত এক গবেষণায় দেখা যায় জনবহুল অঞ্চলে এ বায়োলজিক্যাল এজেন্ট অত্যন্ত কার্যকর। এ বিবেচনায় ঢাকা, সিঙ্গাপুর ও ব্রাজিলে এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মশক দমন যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি আর্থিকভাবে দারুণ সাশ্রয়ী। অনুমান করা হচ্ছে, প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার সাশ্রয় হবে এ পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে। সব মিডিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে, একইভাবে স্কুল-কলেজে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামে মশার বংশবৃদ্ধি ও এর প্রজননস্থল ধ্বংস করার প্রক্রিয়াগুলো বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে আমাদের জীবনের ঘনিষ্ঠতা ও প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে পরবর্তী বংশধরকে জানানো এবং দূষণের বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার সব কলাকৌশল শেখাতে হবে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির সব শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হলেও ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে সুস্থভাবে অক্সিজেন নেওয়ার পরিমণ্ডল। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইডসহ সব গ্রিনহাউজ গ্যাস মানুষেরই সৃষ্টি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এনথ্রোপোজেনিক বা মানুষের কর্মকাণ্ডই এ গ্রিন হাউজ গ্যাসের উৎপত্তির মূল কারণ। মানুষের সুস্থতার পূর্বশর্ত যেমন সুস্থ ফুসফুস, একইভাবে পৃথিবীর সুস্থতার জন্য প্রয়োজন গাছপালা শোভিত পরিচ্ছন্ন অক্সিজেনপূর্ণ পরিবেশ। একইভাবে একাকী মানুষ যেমন সংকীর্ণ ও অসহায় হয়ে পড়ে, আর ঐক্যবদ্ধ হয়ে চললে কোনো সমস্যাই সমস্যা হয়ে উঠতে পারে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যত বড় বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে, সব সমস্যার সমাধান হয়েছে ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে। সার্বিক বিবেচনায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমেই একমাত্র এই ভয়ংকর পরিস্থিতির অবসান সম্ভব।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)