Logo
Logo
×

বাতায়ন

উপজেলা নির্বাচনের হালচাল

Icon

দিলীপ কুমার সরকার

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উপজেলা নির্বাচনের হালচাল

আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলভিত্তিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনেকটা নির্দলীয় অবয়ব পেয়েছে। কেননা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও বেশ কিছুসংখ্যক স্থানীয় নেতা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নগণ্যসংখ্যক প্রার্থী দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বেশির ভাগ উপজেলায়ই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বিএনপি থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বা হচ্ছে। এ নির্বাচনে বেশির ভাগ উপজেলাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। প্রশ্ন হলো, আইন পরিবর্তন না করে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে কেন দলীয় প্রতীক ছাড়া এ নির্বাচন করছে?

ধারণা করা যায়, আওয়ামী লীগ আগে থেকেই ধারণা করেছিল, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো এ নির্বাচনে আসবে না। সেক্ষেত্রে ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই অধিকসংখ্যক প্রার্থী যেন নির্বাচনে অংশ নেন, প্রার্থী বেশি থাকার কারণে ভোট যেন বেশি পড়ে, বিএনপির আগ্রহী নেতারা যেন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেন, নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় বিভাজন যেন দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান না হয় ইত্যাদি কারণে আওয়ামী লীগ নির্দলীয়ভাবে অংশ নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। এ কৌশল আওয়ামী লীগকে কি সুফল দেবে? এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ উপজেলায়ই আওয়ামী লীগ থেকে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন মন্ত্রী বা সংসদ-সদস্যের পরিবার-পরিজন, কাছের ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়। আর যাদের আত্মীয়স্বজন নির্বাচন করছে না, সেসব সংসদ-সদস্য সমর্থন দিচ্ছেন অন্ধ অনুগতদের। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মন্ত্রী-এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় তাদের একান্ত আপনজন বা অন্ধ অনুগতদের দিয়ে আধিপত্য ধরে রাখতে চান।

দলের ভেতর যোগ্য প্রার্থী থাকলেও তার অনুগত নয়, এ ধরনের কোনো নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাক, এমনটি তারা মেনে নিতে চান না। দল থেকে সংসদ-সদস্যের স্বজনদের প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেওয়া হলেও সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া প্রার্থীরা সে নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন। সংশ্লিষ্ট এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যেও দলীয় নির্দেশনা প্রতিপালনের কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। একপর্যায়ে দলীয় নেতৃত্বকেই পিছু হটতে দেখা গেছে। তারা প্রথমদিকে কড়া বার্তা দিলেও পরে পরিবার-পরিজনের সংজ্ঞা পালটে ফেলেছেন।

অনেকেই মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগে দল মনোনীত ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে বিভাজন দেখা দিয়েছিল, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা স্থায়িত্ব লাভ করবে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার ও সহিংসতার ঘটনা ঘটার শঙ্কাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছে বিএনপি।

দীর্ঘদিন থেকে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বললেও একদিকে তারা যেমন আন্দোলন জোরদার করতে পারছে না, পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিতে পারছে না। কেননা, যে প্রেক্ষাপটে দলটি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে, তা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই দলটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে তারা সব নেতাকর্মীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারছে না। প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী নেতাকর্মীদের দল থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেওয়া হলেও অধিকাংশই তা শুনছেন না। পরে তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে এবং এতে নিঃসন্দেহে তৃণমূল পর্যায়ে দল দুর্বল হচ্ছে। এখন দলটি ভোটারদের প্রতি ভোটবর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিরও দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ নির্বাচন কি এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাবমুক্ত হবে? সহিংসতামুক্ত হবে? নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে? মন্ত্রী-এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া প্রভাবশালী প্রার্থীরা কি নির্বাচনি আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলবে?

উল্লেখ্য, প্রথম ধাপের নির্বাচনে বেশ কয়েকটি উপজেলায় নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আচরণবিধি ভঙ্গ করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করায় এ আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি আবার ফিরে এসেছে। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শতাধিক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রধানের নির্দেশনায় তা বন্ধ হয়েছিল। এ উপজেলা নির্বাচনে আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে আটজন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ২৮ জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সাতজন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ২১ জন এবং তৃতীয় ধাপে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ছয়জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ও হতে যাচ্ছেন।

প্রথম ধাপে মুন্সীগঞ্জ সদর, বাগেরহাট সদর, মাদারীপুরের শিবচর, নোয়াখালীর হাতিয়া ও ফেনীর পরশুরামে সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই পাঁচ উপজেলায় নির্বাচন করার কোনো প্রয়োজন হয়নি। একই কারণে দ্বিতীয় ধাপে কুমিল্লা আদর্শ সদর ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা এবং তৃতীয় ধাপে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপে ৮ মে ১৩৯ উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ধাপে ১৫২ উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ উপজেলায় সব প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এবং বিভিন্ন কারণে আট উপজেলার নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ১৩৯ উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এ ধাপের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৬.১০ শতাংশ। বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে বেশকিছু উপজেলায় অনিয়মের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অনিয়মগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জালভোট, ভোটারদের মধ্যে অর্থ বিতরণ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়া, বাইরে থেকে সিল মেরে এনে ব্যালট বাক্সে ভরানো, পুলিশ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পুলিশের গাড়িতে হামলা, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩৪ স্থানে সংঘর্ষ হয় এবং ২৫ জন আহত হন। কয়েকজন নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ নির্বাচনি অনিয়মের অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং স্থগিত করা হয়েছে ২টি কেন্দ্রের ভোট। ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তিও হয়েছে কয়েকজনের।

নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ১৩৯ উপজেলার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১১৮টিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী, আটটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী (২৭ উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে), দুটিতে জাতীয় পার্টি, ২টিতে জনসংহতি সমিতির স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ১০টিতে নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ হিসাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বৈরী আবহাওয়া ও ধান কাটার মৌসুমকে দায়ী করেছেন। অনেকের মতে, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার মূল কারণ নির্বাচনব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা না থাকা। পাশাপাশি এ নির্বাচনে বেশির ভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। ভোটারদের সামনে পর্যাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থীর অনুপস্থিতি ভোটার উপস্থিতি হ্রাস পাওয়ার একটি বড় কারণ।

উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতিকালে নির্বাচন কমিশন দুটি ক্ষেত্রে বিধান পরিবর্তন করেছে। একটি হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটারের প্রার্থীর প্রতি সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিধান তুলে দেওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো, জামানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চেয়ারম্যান পদের জন্য এক লাখ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জন্য পঁচাত্তর হাজার টাকা করা। প্রথম উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে, নাকি এটা কাকতালীয়, সে ব্যাপারে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয় উদ্যোগ অর্থাৎ জামানতের পরিমাণ এক লাখ ও পঁচাত্তর হাজার টাকা করার সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে স্বল্প সম্পদের অধিকারী তথা সৎ-যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে কঠিন করে ফেলা হয়েছে; যা কাম্য নয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এ কারণেই উপজেলা নির্বাচনও নির্দলীয়ভাবে হওয়া উচিত। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এবারের নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করছেন। তাদের প্রতি অনুরোধ, আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনগুলো নির্দলীয় ভিত্তিতে করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। পাশাপাশি জামানতের পরিমাণ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।

দিলীপ কুমার সরকার : কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম