Logo
Logo
×

বাতায়ন

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্টেম এডুকেশন

Icon

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার ও ড. মো. বিল্লাল হোসেন

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্টেম এডুকেশন

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের হাতছানি ইত্যাদি সব মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যস্ত এখন বিশ্বের প্রতিটি দেশ। প্রত্যেকেই খুঁজছে প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের সহজ ও টেকসই উপায়। এক্ষেত্রে অনেক দেশ বেশ এগিয়ে রয়েছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিকে বরণ করে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে যারা তাল মেলাতে পারবে না, তারা পিছিয়ে যাবে এমনটাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। টিকে থাকার জন্য অনেক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে। অনেক দেশ আইসিটি খাতের দ্রুত উন্নয়ন করে তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে নারী সমাজকে। প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে অনেক দেশ ইতোমধ্যেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব জয় করে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষার কিছুটা উন্নতি হলেও উচ্চশিক্ষায় তাদের অগ্রগতি এখনো অনেক কম। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ প্রায় শতভাগ (৯৮ শতাংশ), মাধ্যমিকে ৭০ শতাংশ এবং দুই স্তরেই নারী-পুরুষের সংখ্যা কাছাকাছি হলেও উচ্চশিক্ষায় নারীরা অনেক পিছিয়ে। বিবিএসের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সাক্ষরতার হারে নারীদের চেয়ে এগিয়ে আছেন দেশের পুরুষরা। বর্তমানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬.৫৬ শতাংশ হলেও নারীদের সাক্ষরতা ৭২.৮২ শতাংশ। বিগত বেশ কয়েক বছরে কারিগরি শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, তবে এখনো যথেষ্ট নয়। কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অবস্থান আরও পেছনে। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ২০২১-এ আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ ‘ওয়ার্কিং এইজ পপুলেশন’ (১৮-৬৪) তথা শ্রমবাজারে নিয়োজিত হওয়ার উপযোগী বয়সের মানুষ। তাদের প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৩০ নাগাদ এ অনুপাত আরও ২ পয়েন্ট বেড়ে ৫৭ শতাংশ হতে পারে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবকে মোকাবিলা করে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী জনবল তৈরির চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার জন্য স্টেম এডুকেশন সহায়ক হতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। স্টেম এডুকেশন হলো এমন একটি শিখন পদ্ধতি, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতকে আলাদা আলাদা বিষয় হিসাবে না শিখিয়ে বরং এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় যেন শিক্ষার্থীরা এ চারটি বিষয় মিলিয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সেটা তাদের কাছে অত্যধিক জীবনমুখী হয়। কেবলমাত্র জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিক কল্যাণ সাধিত হয়। আমরা জীবনে প্রতি মুহূর্তে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হই, তার কোনোটিই কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ফলে এগুলো সমাধানে দরকার হয় বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বিত জ্ঞান। জ্ঞানের আসলে কোনো বিভাজন নেই। পৃথিবীতে জ্ঞানের সংখ্যা যখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তখন এগুলোকে কাজের ও ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী বিভক্ত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে নামকরণ হয়েছে শুধু রপ্ত করা বা মনে রাখার সুবিধার জন্য। এখনো জ্ঞানকে আয়ত্ত করার সুবিধার্থে বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় বিভক্ত করা হয়। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনের সমস্যাগুলো ইচ্ছামতো শাখা-উপশাখায় বিভক্ত করা যায় না। সেজন্য দক্ষতার সঙ্গে সমস্যার সমাধান করতে অনেক সময় আমরা হিমশিম খাই। এসব বিবেচনায় বর্তমানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতকে সমন্বিত করে শেখানোর কথা বেশ আলোচিত। ব্যবসায় শিক্ষায় সবগুলো বিষয়কে সমন্বয় করে বিবিএ নামে শেখানো হচ্ছে, যা ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। আইবিএ নামক ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। আইনের ক্ষেত্রে সমন্বিত শিক্ষা চলছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমন্বিত শিক্ষা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো এরকম আরও গুচ্ছ তৈরি হতে পারে বাস্তবতার প্রয়োজনে।

আমাদের কারিগরি শিক্ষা এবং প্রযুক্তি শিক্ষা অনেকটাই স্টেম শিক্ষার আদলে হলেও আন্তর্জাতিক মান থেকে এখনো অনেক দূরে। এজন্য আরও নিু লেভেল থেকে স্টেম শিক্ষাকে বিবেচনায় নিলে প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী জনবল তৈরিতে এগিয়ে থাকা সম্ভব। স্টেম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই মুখস্থ করার সনাতনী নিয়মকে কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে। শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ও জীবনমুখী করতে ভূমিকা রাখে। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা এবং আÍবিশ্বাসকে শাণিত করে। স্টেম শিক্ষা তাদের আবেগের পাশাপাশি চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত করে সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং কর্মমুখী করে। সহযোগিতামূলক মনোভাবকে উৎসাহিত করে, কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। স্টেম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশ স্টেম শিক্ষা ফাউন্ডেশন ২০২০ সালে সারা দেশে এক গবেষণামূলক কনসেপ্ট পেপার ও প্রজেক্ট আহ্বান করে এবং সেখানে শতাধিক টিমের ২৩৮টি প্রজেক্ট জমা পড়ে এবং এর মধ্যে জয়ী হয় বুয়েট টিম, ১ম রানার আপও হয় বুয়েট টিম, দ্বিতীয় রানারআপ হয় চুয়েট টিম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তারা সফলতার স্বাক্ষর রাখছে। এবার রোবোটিক্সের অলিম্পিয়াড বলে খ্যাত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশি নামকরা অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হারিয়ে সফল হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এভাবে বাংলাদেশে স্টেম এডুকেশন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্টেম শিক্ষায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রযুক্তির এ অবাধ সুযোগে আমরা এখনো অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিক এবং গার্মেন্টস রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি আঁকড়ে ধরে আছি। মানুষের ইন্টারনেট অ্যাকসেস এখনো ৪০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। অথচ এর মধ্যেই প্রায় ৮-১০ লাখ তরুণ উদ্যোক্তা নিজে নিজেই প্রযুক্তি রপ্ত করে ফ্রিল্যান্সিং কাজে যুক্ত হতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্টেম শিক্ষায় যারা শিক্ষিত, তাদের জন্য প্রতি বছর ১৭ শতাংশ হারে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে অন্য ডিগ্রিধারীদের জন্য এ সুযোগ ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টারশিয়ারি পর্যায়ে স্টেম বিষয়ে পড়ালেখা করছে এমন শিক্ষার্থীদের অনুপাত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ১১ শতাংশ, যা প্রতিবেশী ভারতে ৩৪ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ৪৪ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারিভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিবিষয়ক নতুন নতুন বিষয় খোলা হচ্ছে। এছাড়া সরকারি এবং বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর জন্য ব্যাপক হারে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির মাধ্যমেই সুফল পাওয়া সম্ভব। যেমন কারিগরি শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ জার্মানি সফল হয়েছে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ডুয়েল পদ্ধতি ব্যবহার করে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলে অধ্যয়নকালে উচ্চ বেতনসহ কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। অথচ জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশেরও পরে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও আইসিটি ও স্টেম শিক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আইসিটিভিত্তিক শিক্ষা যে কোনো নারীর চোখ খুলে দিতে পারে, চেঞ্জমেকার হওয়ার মতো মনোবল তৈরি করতে পারে। ইন্টারনেট এবং ই-কমার্সের যুগে গ্রামীণ নারীদের জন্যও সমান সুযোগ রয়েছে। আইসিটি সেক্টরে মেধাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে পুরুষ, মহিলা, সংখ্যালঘু, এমনকি প্রতিবন্ধীসহ সবার জন্য রয়েছে কর্মসংস্থানের বৈষম্যহীন সমান সুযোগ। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট জাতি গঠনই যেখানে আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য, সেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করা খুবই জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যন্ত সর্বস্তরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্টেম শিক্ষার চর্চা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি স্টেম শিক্ষার জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে একুশ শতকের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল গড়ে তুলে এবং অর্জিত জ্ঞান ও উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দিতে পারলেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম হবে।

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মো. বিল্লাল হোসেন : শিক্ষা গবেষক

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম