Logo
Logo
×

বাতায়ন

একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি

শিক্ষকতা আর পাঁচ-দশটি পেশার মতো নয়। এটি একটি মহান ব্রত। শিক্ষকতার সঙ্গে অন্য কোনো পেশার তুলনা চলে না। জ্ঞানদান-চক্ষুদান, জ্ঞানচর্চা-গবেষণা-সাধনা; কী আশ্চর্য এক অনুভূতি! ভাবলেও যে কারও মনে বিমল আনন্দ ও পরম স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করার কথা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, নানা কারণে ও নানাভাবে আজ বিতর্কিত ও আলোচিত-সমালোচিত হয়ে উঠেছে এ মহান পেশাটি। এখন আর এ পেশার সোনালি অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল পরম্পরার কথাও আমাদের মনে খুব একটা রেখাপাত করে না।

আমার দীর্ঘদিনের কর্মক্ষেত্র কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর কলেজ (স্থাপিত ১৯৬৪)। নিজেকে আমি পরম সৌভাগ্যবান মনে করি যে, শিক্ষকতা জীবনে সহকর্মী হিসাবে ফজলে এলাহী গোলাম কাদের এবং এমন গুটিকয় আদর্শ মানুষের স্নেহ-সান্নিধ্য-সাহচর্য লাভ করেছি। ফজলে এলাহী গোলাম কাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর কাছে ফজলে এলাহী স্যার হিসাবেই সমধিক পরিচিত। অনেকের কাছে তিনি ‘ইংলিশ স্যার’। একই কলেজে আমি শিক্ষকতা করেছি টানা ৩৬ বছর (১৯৮৪-২০১৯)। ফজলে এলাহী স্যার করেছেন আমার চেয়ে কিছুটা বেশি সময়, মোট ৩৮ বছর (১৯৬৭-২০০৪)। কর্মজীবনে বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে বা কাছাকাছি অবস্থান করায় তাকে দেখা, তার সম্পর্কে জানা এবং তাকে বোঝার কিছুটা হলেও সুযোগ হয় আমার। আজকাল অনেকের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে গালগল্প কিংবা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে; কিন্তু আমি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি-এ লেখায় তার সম্পর্কে যেসব তথ্য তুলে ধরব, তা কোনো অতিশয়োক্তি নয়, পুরোপুরি বাস্তব।

তার বাবা মো. আশরাফুদ্দীন মাস্টার। আদর্শ মানুষ, একজন আদর্শ শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদধন্য আশরাফ মাস্টার প্রথম সংসদের (১৯৭২-১৯৭৫) একজন সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফুদ্দীন মাস্টার। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে সরকার এ বীরকে এ বছর মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। ফজলে এলাহী গোলাম কাদেররা পাঁচ ভাই ও দুই বোন। সত্তরের দশকে বাবা সংসদ-সদস্য; ভাইয়েরা কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সবার ছোট শরীফ আহমদ সাদী (অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী, সচিব, বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড) মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এমন একটি আলোকিত ও রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও ফজলে এলাহী স্যারকে কলেজে কখনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় দেখা যায়নি। পড়া আর পড়ানো, কলেজ আর বাসা-এই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। ভালো বক্তা, সাংবাদিকতাও করেছেন অনেক দিন। ছিলেন কিশোরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। সহধর্মিণী কাজী মাহবুবা হাসনা বাজিতপুর রাজ্জাকুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে ২০১৭ সালে অবসর নেন। ফজলে এলাহী-কাজী মাহবুবা দম্পতির চার ছেলের প্রত্যেককেই এসএসসির পর বাজিতপুর কলেজে পড়িয়েছেন, পরবর্তীকালে অন্যত্র।

আপাদমস্তক শিক্ষক, একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি তিনি। বাজিতপুর কলেজের ষাট বছরের (১৯৬৪-২০২৪) পথপরিক্রমায় উপাধ্যক্ষ হিসাবে একজনই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তিনি হলেন ফজলে এলাহী গোলাম কাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রিধারী (১৯৬৫) ফজলে এলাহী গোলাম কাদের ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন। ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিক (২০২৩ সালে লোকান্তরিত স্বনামখ্যাত কবি) পদত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলে তার শূন্য পদে অধ্যাপকের পাশাপাশি উপাধ্যক্ষ পদ সৃষ্টি করে ১৯৬৭ সালে ফজলে এলাহী গোলাম কাদেরকে বাজিতপুর কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই থেকে কলেজে কত রকমের চড়াই-উতরাই। কিন্তু একজন ফজলে এলাহী গোলাম কাদেরের স্থানটি একেবারে যেন সুনির্দিষ্ট; উপাধ্যক্ষ। অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত টানা ৩৮ বছর (১৯৬৭-২০০৪) তিনি উপাধ্যক্ষ। ফজলে এলাহী গোলাম কাদেরের অবসর গ্রহণের পর আরও ২০ বছর (২০০৪-২০২৪) অতিবাহিত হয়েছে। বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত উপাধ্যক্ষ হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তার মানে ৬০ বছরে বাজিতপুর কলেজের প্রথম ও শেষ উপাধ্যক্ষ ফজলে এলাহী গোলাম কাদের।

বাংলাদেশের আলোকে অবিশ্বাস্যই বটে, একই প্রতিষ্ঠানে টানা ৩৮ বছর উপাধ্যক্ষ; নিজে কখনো আগ্রহ ব্যক্ত তো করেনইনি, উপরন্তু গভর্নিং বডিও স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে অধ্যক্ষ হতে সম্মত করাতে পারেনি। অথচ এ দীর্ঘ সময়ে পৌনঃপুনিকভাবে ৩ মাস, ৬ মাস, ১২ মাস এভাবে মোট অন্তত ৭ বছর (৭ বছর বা ৮৪ মাস) তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এ এক বিরল ঘটনা। প্রশাসনের চেয়ে শিক্ষাদানকে তিনি বরাবরই উপরে স্থান দিয়েছেন।

বিরতিহীন ২০ বছর (১৯৬৭-১৯৮৬) একাধারে উপাধ্যক্ষ ও কলেজটিতে ইংরেজির মতো আবশ্যিক বিষয়ের একমাত্র শিক্ষক। উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি স্তর। একটির পর একটি সারা দিন ক্লাস আর ক্লাস। অনেক সময়ই অধ্যক্ষের অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে। অন্তত নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমার জানামতে বাড়তি দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো ভাতা (চার্জ এলাউন্স) বরাদ্দ ছিল না। এজন্য তার কোনো চাহিদা কিংবা অনুযোগও ছিল বলে আমরা টের পাইনি। শিক্ষকতার মতোই প্রশাসনিক দায়িত্বটিকেও তিনি মনেপ্রাণে ব্রত হিসাবেই গ্রহণ করেন।

শিক্ষকতা জীবনে কখনো তিনি টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াননি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের পড়ার খুব একটা দরকারও হতো না; দরকার হলে স্যারের বাসায় এলে আগ্রহসহকারে বিনা পারিশ্রমিকেই বুঝিয়ে দিতেন। ছাপোষা শিক্ষক, আর্থিক টানাপোড়েন তো ছিলই। কিন্তু নীতি ও আদর্শের কাছে কখনো নতি স্বীকার করেননি। লোভ-লালসা এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়া ছিল তার ভাবনার বাইরে।

সততা, জ্ঞান-গরিমা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা ও তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও পরিচিতজনরা ভালো বলতে পারবেন। যেমন চেহারা, ঠিক তেমনি তার বাচনভঙ্গি। ২০ এপ্রিল তিনি ইহকাল ত্যাগ করেছেন। দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাজিতপুর কলেজ মাঠ, কিশোরগঞ্জের হাসমত উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এবং নিজ গ্রাম করমুলিতে জানাজার পর বাবা-মায়ের কবরের পাশে তিনি শেষ শয্যা গ্রহণ করেন। সাবেক সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও গুণগ্রাহীরা শ্রদ্ধাভরে তাকে বিদায় জানান।

ফজলে এলাহী গোলাম কাদেরের মতো সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ও আদর্শ মানুষদের সব সময় সমাজের সামনে তুলে ধরা চাই। সভ্যতার এ ‘সংকটকালে’ এমন মানুষদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। কেবল আমি নই, আমার মতো অনেকেরই নিরন্তর অনুপ্রেরণা ফজলে এলাহী স্যারকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম