Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কেন জরুরি

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কেন জরুরি

রাজধানীর বাংলামোটরে ৪ মে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা সংলাপে সংগঠনটির একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, তিন দশক আগেও ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। কমতে কমতে এখন জলাভূমির পরিমাণ ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। অর্থাৎ তিন দশকে ঢাকায় জলাভূমি কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে পরিচালিত এ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। বিআইপির গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণহীন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকায় তাপপ্রবাহের প্রভাব অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। এর পেছনে ব্যক্তি, বেসরকারি গোষ্ঠী ও সরকারি সংস্থা সবার দায় রয়েছে। ‘উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে’ বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন না থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের গুরুত্ব কেন অপরিসীম, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

রামশার কনভেনশন-১৯৭১ অনুযায়ী, জলাভূমির সংজ্ঞা হচ্ছে-‘প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট, স্থায়ী অথবা অস্থায়ী, স্থির অথবা প্রবহমান পানি রাশিবিশিষ্ট স্বাদু, লবণাক্ত অথবা মিশ্র পানিবিশিষ্ট জলা, ডোবা, পিটভূমি অথবা পানিসমৃদ্ধ এলাকা এবং সেই সঙ্গে এমন গভীরতাবিশিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা, যা জোয়ারের সময় ৬ মিটারের বেশি গভীরতা অতিক্রম করে না।’ বাংলাপিডিয়ার (২০০৩) মতে, বাংলাদেশে জলাভূমির আওতায় মোট এলাকা, ভিন্ন ভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, সত্তর থেকে আশি হাজার বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় অর্ধেক।

এখন দেখা যাক, জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের গুরুত্ব কেন অপরিসীম। দেশের প্রতিবেশগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দেশের জলাভূমিগুলো একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল, অন্যদিকে তেমনি এগুলো মানববসতি, জীববৈচিত্র্য, মাছ উৎপাদন, কৃষি বহুমুখীকরণ, নৌ চলাচল ও যোগাযোগ এবং প্রতিবেশ-পর্যটন ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং ন্যাচার কনজারভেশন মুভমেন্ট পরিচালিত এক যৌথ গবেষণা মোতাবেক ৫ হাজারেরও বেশি সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ১৫০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী দেশের জলাভূমিগুলোতে পাওয়া যায়। ৪০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ তাদের জীবনকালের পুরো অংশ বা আংশিক সময়কালের জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল থাকে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, জলাভূমিগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন রিজারভার। জলাভূমিতে পৃথিবীর প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ টেরেস্ট্রিয়াল কার্বন জমা রয়েছে। যদি কোনো কারণে জলাভূমিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, জলাভূমি কার্বন সিংক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বড় জলাশয় যেমন-নদী, হ্রদ ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় মানববসতি গড়ে উঠেছে। দেশে নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর, নগর ও বন্দরগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর। আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। সেখানেও মূল ভূমিকা নদীর। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে। ব্যবস্থা হয়েছে আধুনিক সেচের। এজন্য বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর সবই নদীকে কেন্দ্র করে। ধান চাষে জলাভূমিগুলোর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। উদাহরণস্বরূপ বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার হাওড়াঞ্চলে বোরো চাষ হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরোর কাটা-মাড়াই মৌসুম শুরুর আগেই হাওড়াঞ্চলে ফসলটির কাটা-মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। হাওড়াঞ্চলে উৎপাদিত বোরো দেশে মোট চাল উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় জলাভূমিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’, অর্থাৎ বর্ষাকালে নৌকা আর শুকনা মৌসুমে হাঁটা ছাড়া বিকল্প ছিল না দেশের মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের হাওড়বাসীর। এখন কোনো কোনো হাওড় এলাকায় রাস্তা নির্মিত হলেও এখনো বর্ষাকালে অনেক হাওড় এলাকায় যাতায়াতের অন্যতম অবলম্বন নৌকা। নদীতে চলাচলকারী স্টিমার, লঞ্চ ইত্যাদি এখনো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যখন পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়ছে, তখন টেকসই উন্নয়নে জলাভূমির ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ যে কার্বন নিঃসরণ, তা কমানোরও এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি জলাভূমিগুলো। সোজা কথায়, জলাভূমিগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় একইসঙ্গে অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন ব্যবস্থা।

অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প (রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি) গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জলাভূমিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানববসতি স্থাপনে জমির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য মেট্রোপলিটন নগরীতে এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এতে এসব নগরীর আশপাশের জলাভূমি মানববসতি স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে; যার ফলে অনেক জলাভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। এটি পরিবেশ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

মহানগরী, বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য সরকার ২০০০ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে ‘প্রাকৃতিক জলাধার’ বলতে নদী, খান, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসাবে মাস্টারপ্ল্যান চিহ্নিত বা সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং সলিল পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিকে বোঝানো হয়েছে। এ আইনে ‘কর্তৃপক্ষ’ অর্থ হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত কোনো শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌরসভাসহ দেশের সব পৌরসভা। এ আইনের বিধান অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এ ধরনের জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা এ আইনের যেসব দুর্বল দিক চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-১. এ আইনে প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে মাস্টারপ্ল্যান বা গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা চিহ্নিত স্থানকে বোঝানো হয়েছে। দেশে বর্তমানে নদী দখল ও ভরাট অব্যাহতভাবে চলছে এবং অনেক এলাকা/স্থান রয়েছে, যেখানে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়নি। ফলে এসব স্থানের জলাধারগুলো অরক্ষিত হবে; ২. জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের হাতে এ আইনে কোনো ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি; ৩. সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে, যা জলাধারের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ; ৪. জলাধার রক্ষায় অগ্রগতি বা ব্যর্থতায় এ আইনের অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়নি।

এ আইনটি ছাড়া কয়েকটি সেক্টরাল আইন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক্যানাল আইন ১৮৬৪, মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০, ইরিগেশন আইন ১৮৭৬, পরিবেশ আইন ১৯৯৫। তবে এসব আইনে জলাভূমি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২১ সালের জুলাইয়ে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ দেশের সব জলাভূমির সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক জলাভূমি মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কৃষিজমি, নিুভূমি, জলাভূমি ও মেঘনা নদী অংশের জমি ভরাটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিটের ওপর বেঞ্চটির পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে দেশের সব জলাভূমি রক্ষায় ১১টি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, জলাভূমিকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি (পাবলিক ট্রাস্ট প্রোপার্টি) হিসাবে ঘোষণা এবং জলাভূমি সুরক্ষা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় পৃথক আইন প্রণয়ন। এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

সবশেষে বলতে চাই, প্রতিবেশগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলোর রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই জলাভূমিগুলোর সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আর দেরি নয়।

আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম