Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মরণ

ইঞ্চি-দূরত্ব থেকে দেখা

Icon

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইঞ্চি-দূরত্ব থেকে দেখা

জন্মশতবার্ষিকী বছর দুয়েক আগে পেরিয়ে গেছে; মৃত্যু, তা-ও উনিশ-কুড়ি হয়ে গেল। আজ ২৭ এপ্রিল মৃত্যুদিন। তিনি আবদুস সামাদ আজাদ-একজন সফল রাজনীতিবিদ। ছিলেন একাধারে জাতীয় নেতা, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতার বিশ্বস্ত-ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা, সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শেষের শব্দবন্ধের নানা ব্যাখ্যা ও উদাহরণের মধ্যে প্রথমেই প্রণিধানযোগ্য এই যে, ওদিকে আইকে গুজরাল, এদিকে আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন বলেই দুই দেশের মধ্যে পানিচুক্তি সম্ভব হয়েছিল।

এ প্রথিতযশা রাজনীতিক ১৯২২ সালে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ভূরাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন (এলাকায় বেশি বয়সিরা ছমেদ মিয়া নামে জানতেন তাকে)। তিনি ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দেখেছেন-ছিলেন এই তিন দেশের নাগরিক। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে মেট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও ইতিহাসে এমএ পাশ করেন।

ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি ছাত্র ফেডারেশনের আঞ্চলিক শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন এবং আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি একাধিকবার রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন এবং ’৭৫-পরবর্তী দলের পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ১৯৯১ সালে সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বতক আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ছিলেন পাঁচবারের জাতীয় সংসদ সদস্য। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা একজনের এতসব প্রাপ্তি বিরলই বটে।

সামাদ আজাদ মানুষের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি করেছেন। হাওড়ের এ কৃতীপুরুষ খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অতি সাধারণজনও তার সান্নিধ্য থেকে কখনো বঞ্চিত হয়নি। তাকে রাজনীতির একজন সাধক-পুরুষ বলে মান্য করা হয়। আদতে তার জীবনালেখ্য সমুদ্রের মতোই বিশাল; যেমন ছিল আকাশ সমান তার হৃদয়।

এই রাজনীতিকের সান্নিধ্যে যাওয়ার বহুবার সুযোগ হয়েছিল আর সেটা সরকারি চাকরির সুবাদে। ফলে এক-দুই ইঞ্চি দূর থেকে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে-চোখ বুজলে তাকে কেবল দেখতেই পাই না, শরীরের গন্ধও অনুভব করি। নানা স্মৃতি আছে তার সঙ্গে।

এক. হাওড়ের ফসল শেষ। হঠাৎ বন্যায় সবটাই ডুবে গেছে। একটাই ফসল। ফলে মানুষের, বিশেষত এ বোরোর ওপর নির্ভরশীলদের, দুর্গতির শেষ থাকে না (সেটাও স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেছি)। সামাদ আজাদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। সার্কিট হাউজে সভা চলছে। সব দোষই পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সব বক্তার তীরই ওই একটি সরকারি দপ্তরের দিকে। আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতিসহ নেতাদের ক্ষোভের মুখে নির্বাহী প্রকৌশলীর চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে। ডিসি-এএসপিও প্রমাদ গুনছেন। শেষ বক্তা বিরোধী দলের মাননীয় এমপি-তিনি তো ক্রিমিনাল অফেন্স বলে নির্বাহী প্রকৌশলীকে এক-চোট নিলেন, মামলাই করে দেবেন। মাগরিবের আজানের প্রাক্কালে মাননীয় মন্ত্রী মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা সবাই তো নির্বাহী প্রকৌশলীকে মেরেই ফেলেছেন। দেখি, তাকে বাঁচিয়ে রেখে কী শাস্তি দেওয়া যায়।’ এভাবেই সভাটি শেষ হয়েছিল।

দুই. ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি সভা (সামাদ আজাদ গ্রামে-ইউনিয়নে প্রচুর সভা করতেন)। সভাস্থলে যাওয়ার সময় এসপির গাড়িতে দু-তিনজন তরুণ উঠতে চেয়ে পারেনি। খুব দূরত্বও ছিল না। মিনিট দশ-পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ। এ দুই-তিনজনকে মাননীয় মন্ত্রীর এলাকা ভ্রমণকালে দেখাই যায়। দৌড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মন্ত্রীকে মহা-অভিযোগ : ‘লিডার (স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে লিডারই বলত), সরকারি গাড়ি। পেছনটা খালিই ছিল। আমাদের উঠতে দিল না।’ ডিসি-এসপির বিব্রত-কথা তো সত্য, কী বলবেন! বরং চোখ-মুখ শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম-মন্ত্রীই না এসপিকে কিছু বলে বসেন! সামাদ আজাদ আরও এক গ্লাস ডাবের পানি খেলেন। একটু সময় নিলেন। বাম হাতে নিজের দাড়ি মোচড় দিলেন। এরপর বললেন, ‘এই গাড়িটার দাম কত, জানোস? এই গাড়ির ওজন বুঝোস? ওই গাড়িতে যে চড়ে তার ওজন জানোস (ক্রমেই কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছিল)? আর কখনো ওইসব গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করবি না। বুঝছোস!’

তিন. সি-প্লেন থেকে নামার সময় পাইলট বলে দিয়েছেন, স্যার, ৫টার মধ্যে ফ্লাই করতে না পারলে আজ কিন্তু যাওয়া যাবে না। দুপুরের খাওয়ার পর সভা শুরু। বক্তার তো শেষ নেই। বক্তৃতা চলছেই। সিনিয়র নেতার সামনে সবাই বেশি বেশি বলতে চায়, সময়জ্ঞান পালিয়ে যায় তখন। মাননীয় মন্ত্রীর সিকিউরিটি কিংবা এপিএস হঠাৎ মঞ্চে, কিছু একটা বলছে কানে কানে। সামাদ আজাদও ঘড়ির দিকে তাকালেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে বক্তার থেকে মাইক চেয়ে নিলেন। ইশারায় তকে বসিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন। বলা শেষ, তো মঞ্চ থেকে নেমে সরাসরি গাড়িতে। তখনো অনুষ্ঠানের সভাপতিসহ তালিকার বহু বক্তার বক্তৃতা বাকি।

চার. হঠাৎ ফোন। ও-প্রান্তে সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা (দুভাবেই তাকে পেয়েছি)। বললেন, আপনার পিআইও তো আমার সামনে। কী একটা তালিকার কথা বলছে। বললাম, জি, স্যার। টিআরের বরাদ্দ এসেছে। তারই তালিকা। স্যার বললেন, ক খ গ-এর কথা বলেছিলাম। আর জ ট তো আমার অফিসে এসেছিল। বললাম, জি, স্যার। ওদের নামও তালিকায় আছে। তিনি তখন বললেন, এদের কেউ কেউ তো কাজ করবে না, দেখেন কতটা করাতে পারেন; ওরা আপনাকে সমীহ করে, কিছুটা হলেও আপনি করাতে পারবেন।

বললাম, জি, স্যার।

সই করে দেব?

দিন, স্যার।

সই করে আপনার ফ্যাক্সে দিচ্ছি।

এই হচ্ছেন আব্দুস সামাদ আজাদ। এমন রাজনীতিককে ভোলা যায় না। গভীর শ্রদ্ধা তার প্রতি। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

মোহাম্মদ আবদুল মাননান : ট্রেজারার, বশেফমুবিপ্র; সাবেক অতিরিক্ত সচিব

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম