Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্মরণ

কাছে থেকে যেমন দেখেছি

Icon

আইনুন নিশাত

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাছে থেকে যেমন দেখেছি

স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা দুই পর্বে ঘটেছে। প্রথমবার, ব্র্যাকের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করার সময় এবং এর পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়। প্রথমবার তাকে কিছুটা কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। এভাবেই তার চিন্তাভাবনা কিছুটা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। ব্র্যাককে এতবড় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার পেছনে তার নিষ্ঠা ও পরিশ্রমেরও পরিচয় পেয়েছি। স্যার আবেদের জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশে এ ক্ষুদ্র লেখাটির চেষ্টা।

বোধহয় ২০০০ সালের মাঝামাঝি একসময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্র্যাক থেকে জানানো হয়, তাদের নির্বাহী কমিটিতে আমাকে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চিন্তাভাবনা করা হয়েছে এবং আমি সম্মত থাকলে তা যেন যথাশিগ্গির জানিয়ে দিই। আমি তখন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারে (আইইউসিএন) কর্মরত। স্বাভাবিক কারণেই আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থাৎ আইইউসিএনের রিজিওনাল ডিরেক্টরকে চিঠি লিখে তার সম্মতি চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি তো এলোই; একই সঙ্গে বলা হলো, ব্র্যাকের নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ লাভ আমার জন্য তো বটেই, আইইউসিএনের জন্যও একটি বড় ব্যাপার।

প্রায় দশ বছর অর্থাৎ ২০১০ সাল পর্যন্ত নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম। বেশির ভাগ সভায় যোগ দিয়েছি; দু-চারটি ছাড়া, হয়তো ওই সময়ে বিদেশে থাকার কারণে। ব্র্যাকের নির্বাহী কমিটি বছরে চারবার মিলিত হয় অর্থাৎ প্রতি তিন মাসে একটি সভা। সভার তারিখ বছরের প্রথমেই নির্ধারিত হতো। বলা যেতে পারে, প্রতিটি সভা ঘড়ি ধরেই শুরু হতো। আলোচ্যসূচি ও কার্র্যপত্র অনেক আগেই সব সদস্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। এর মধ্যে কয়েকজন সদস্য কার্যপত্র নাড়াচড়া করে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে সভায় আসতেন। আর কেউ কেউ তেমন প্রস্তুতি ছাড়াই সভায় আসতেন স্যার আবেদের ওপর আস্থার কারণে। কিন্তু প্রথম সভা থেকেই লক্ষ করেছি, স্যার আবেদ পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েই সভা পরিচালনা করছেন। প্রতিটি আলোচ্য বিষয় অল্পকথায়, গুছিয়ে, প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপন করেন। নতুন প্রকল্প প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় ব্র্যাকের মূল আদর্শ অর্জনে প্রকল্পটি কীভাবে সহায়ক হবে, তা ব্যাখ্যা করেন। যেদিন বার্ষিক বাজেট আলোচনা হতো, সেদিন তার প্রস্তুতি ছিল ঈর্ষণীয় মাত্রায়। বাজেটের প্রতিটি অনুচ্ছেদের বিষয়ে যে কোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেন। এসব সভায় উপস্থিত থেকে বুঝতে পারতাম, ব্র্যাকের প্রতিটি প্রকল্পের অগ্রগতি কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব সমস্যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি পূর্ণ ওয়াকিবহাল। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প পর্যবেক্ষণেও তিনি উৎসাহিত করতেন। বেশ কয়েকবারই কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শুরু হওয়ার আগের দিন বোর্ড সদস্যদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও কাজের পদ্ধতি দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে যারা ব্র্যাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন না অথচ ব্র্যাকের নীতিনির্ধারণে সহায়তা করছেন, তারা ব্র্যাকের বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছেন। ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডের পরিধি এত বিস্তৃত যে, সব কাজ সম্বন্ধে ধারণা বোধকরি কেবল স্যার আবেদেরই রয়েছে।

ব্র্যাককে সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা হিসাবে জানে। একজন ঋণগ্রহীতা ২-৩ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা পেতে পারেন। তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তিনি ক্রমান্বয়ে আরও উঁচু ধাপের স্তরেও পৌঁছতে পারেন। অর্থাৎ ঋণ গ্রহণ করে তা ব্যবহার করে সাফল্য পেলে ঋণগ্রহীতাকে আরও উঁচুতে উঠতে সাহায্য করা হয়। আমি এমন ঋণগ্রহীতার বাড়িতে গিয়েছি, যিনি প্রথম ঋণ নিয়েছিলেন ৫ হাজার টাকা এবং কয়েক বছরে তিনি লাখ টাকার ধাপে পৌঁছেছেন এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার করছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেখেছি স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে এবং কাজের মৌসুমে তা ব্যবহার করে যথাসময়ে ফেরত দিতে। ঈদের আগে জামা-কাপড়ের জন্য কাপড়ের দোকান এবং তৎসংলগ্ন দর্জির দোকানের সমন্বয়ে সফল ব্যবসা হতে দেখেছি। কোনো ফসল উৎপাদনের সময় ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে কৃষিজাত দ্রব্য কিনে তা থেকে মুনাফা অর্জন করতে দেখেছি। ক্ষুদ্রঋণের মাহাত্ম্য বলার জন্য একথাগুলো বলছি না, বলছি ব্র্যাকের ওপর এসব ঋণগ্রহীতার পূর্ণ আস্থা এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার স্যার আবেদের প্রতি তাদের অপরিসীম শ্রদ্ধার কথা বলার জন্য। একসময় স্যার আবেদ গ্রামান্তরে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্র্যাকের কার‌্যাবলি দেখেছেন।

দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে অনেকেই ব্র্যাককে একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা মনে করেন। এটি ঠিক নয়। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা হলো ব্র্যাকের চারটি স্তম্ভ রয়েছে। প্রথমটি হলো শিক্ষা, দ্বিতীয়টি হলো চিকিৎসা, তৃতীয়টি হলো ক্ষমতায়ন এবং চতুর্থটি হলো ক্ষুদ্রঋণ। ব্র্যাকের এককক্ষবিশিষ্ট প্রাথমিক স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। আমি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন স্থানে ওই স্কুলের ক্লাসকক্ষে ঢুকেছি। একটা ছোট ঘরে একজন কিংবা দুজন শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে একগুচ্ছ বিভিন্ন বয়সি হতদরিদ্র মানুষের সন্তান কীভাবে লেখাপড়া করছে, তা দেখে অভিভূত হয়েছি। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে তার সঠিক উত্তর পেয়ে অবাক হয়েছি। স্যার আবেদ নিজেও এ ধরনের স্কুলে ভিজিট করতেন এবং শুনেছি, শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট অঙ্ক দিয়ে তাদের পরীক্ষা নিতেন। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে কাজ করার সময় তিনি আমাকে বহুবার বলেছেন গণিতের ওপর শিক্ষার্থীদের দখল বাড়ানোর জন্য। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও গণিতের একটি কোর্স পাশ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তো বটেই, অভিভাবকদের কাছ থেকেও অনুরোধ এসেছে এ কোর্স হয় তুলে দিতে, না হয় সেটিকে ঐচ্ছিক হিসাবে চিহ্নিত করতে। বিষয়টি নিয়ে স্যার আবেদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, গণিতের ওপর সাধারণভাবে একটা দক্ষতা না থাকলে শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে বলে ধরা যাবে না। সাহিত্য কিংবা সমাজবিজ্ঞান যে বিষয়েরই শিক্ষার্থী হোক, গণিতবিষয়ক কোর্সটি তাকে করতেই হবে। তার এই মতের সঙ্গে একমত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের এবং তাদের অভিভাবকদের বুঝিয়েছি কোর্সটি কেন তাদের জন্য আবশ্যক।

গ্রামপর্যায়ে ব্র্যাকের মাধ্যমে যে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, সে বিষয়ে ব্র্যাকের কার্যনির্বাহী পরিষদে যোগদান করার আগে আমি নিজেও জানতাম না। ডায়রিয়া হলে ওরাল স্যালাইনের ব্যবহার দেশের প্রতিটি পরিবারে এখন ডালভাত খাওয়ার মতো একটি সাধারণ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিটি পরিবারের একজন নারী সদস্যকে ওরাল স্যালাইন তৈরি শেখানো এবং এর গুণাবলি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার পেছনে স্যার আবেদের যে অবদান, সেটি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। ব্র্যাক স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য যে পল্লিসমাজ গড়ে তুলেছে, সে বিষয়ে আশা করি কেউ না কেউ বিস্তৃতভাবে লিখবেন।

স্যার আবেদের ওপর দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অপরিসীম। বোধকরি ২০০৪ সালে বন্যার সময় ব্র্যাক নিজস্ব সম্পদের মাধ্যমে ত্রাণকার্য শুরু করে দাতাদের কাছে খবর পাঠায় আর্থিক সহযোগিতার জন্য। ব্র্যাক কত টাকা চেয়েছিল তা মনে নেই; বোধকরি ১৪ মিলিয়ন ডলার। ব্র্যাকের নির্বাহী কমিটিতে আলোচনার পর তা অনুমোদিত হলো দুপুর ১২টা নাগাদ। বোর্ড সদস্যরা চতুর্থ তলার সুরুচি রেস্তোরাঁয় গেলেন দুপুরের খাবার খেতে। খাবার শেষ হওয়ার আগেই একজন কর্মকর্তা এসে স্যার আবেদকে জানালেন, আমরা যা চেয়েছিলাম, তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ব্র্যাকের মাধ্যমে ত্রাণকার্য পরিচালনা করলে তা সঠিক জায়গায় পৌঁছবে এবং যথাসময়ে পৌঁছবে, এ বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলোর ব্র্যাকের ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

এবারে আসি দ্বিতীয় পর্যায়ে স্যার আবেদের সঙ্গে আমার সংস্পর্শের বিষয়ে। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে স্যার আবেদ আমাকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবেই সম্মত হলাম। তিনি জানতে চাইলেন এ পদ গ্রহণের আগে আমার কোনো শর্ত বা বক্তব্য আছে কিনা। আমার একটিই বক্তব্য ছিল, তা হলো, তখন আমি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি এবং কাজটা আমি চালিয়ে যেতে চাই। স্যার আবেদ কোনো দ্বিধা না করেই এ কাজে আমাকে সম্মতি দেন।

তখন যে চাকরিতে কর্মরত ছিলাম, সেখানে তিন মাসের নোটিশ দিতে হয়। অর্থাৎ জুলাইয়ে আমি কার্যভার গ্রহণ করতে পারব, এ কথা জানাই। তিনি ঠিক তখনই একটি নোটবইয়ের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আমার নিয়োগপত্রের খসড়া নিজের হাতেই লিখে ফেললেন এবং তার একান্ত সচিবকে দিলেন টাইপ করে নিয়ে আসতে। অতঃপর টাইপ করা কপিটি আমাকে দেখিয়ে আমার সম্মতি নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে দিলেন। আমার ইচ্ছা হয়েছিল তার হাতে লেখা নিয়োগপত্রটি সংগ্রহ করে রাখি। আমি চার বছর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে কাজ করেছি। তিনি ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজে’র প্রধান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজখবর রাখতেন। আমি নিজে থেকে কিছুদিন পরপর তাকে আপডেট করতাম এবং তিনিও মাঝেমধ্যে ডেকে পাঠাতেন। কখনো কখনো এমন সব খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে চাইতেন যে আমি বিস্মিত হতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তিনি সবসময় চাপ অব্যাহত রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার মূল দায়িত্ব আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের হলেও স্বাভাবিকভাবেই ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’কে সবকিছু জানাতাম। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের বহু সিদ্ধান্ত ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজে’ তুলেছি। স্যার আবেদের কাছে প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা উপস্থাপন করলে তিনি তা গ্রহণ করতেন। উপাচার্য থাকাকালীন চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে তার কোনো হস্তক্ষেপ লক্ষ করিনি বরং পরামর্শ ও উপদেশই পেয়েছি।

স্যার আবেদের মনের মণিকোঠায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছে। কয়েক বছর আগে তিনি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করতে যান। সেখানে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়িত্ব? সম্পর্কে তার আলোচনা হয়। ওই ভদ্রলোক স্যার আবেদকে বলেছিলেন, একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার বাজারের পরিধিকে পরিবর্তিত করতে না পারলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় সহজেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজে নিজেই পরিবর্তিত হয়ে স্থায়িত্ব? লাভ করতে পারে। স্যার আবেদ আমাকে বলেছিলেন, দেশ থেকে দারিদ্র্য চলে গেলে হয়তো ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজন থাকবে না। সরকারি স্কুলের সংখ্যা বাড়লে হয়তো ব্র্যাকের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রয়োজন হবে না এবং দেশ পুরোপুরি উন্নত হলে ব্র্যাকের বাকি কাজগুলো হয়তো কার্যকারিতা হারাবে। কিন্তু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অবস্থাতেই তার প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারিতা হারাবে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়টি যদি শিক্ষার মান সময়োপযোগী করতে পারে এবং তার গবেষণা কার্যক্রমকে জাতির প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়টি হারিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এ কথা যদি বলি তাহলে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, স্যার আবেদের মনোবাসনা হচ্ছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুউচ্চ মান এবং তার ছাত্রছাত্রীরাই স্যার আবেদের নাম চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ে স্যার আবেদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাধারণত বিকালবেলার সময়টিকেই বেছে নিতাম। তার সচিবকে অনুরোধ করতাম দিনের শেষ অ্যাপয়েন্টমেন্টটি আমাকে দিতে। এতে করে তার সঙ্গে কথা বলার সময় আমার পরবর্তী অভ্যাগতকে রুম ছেড়ে দেওয়ার চাপ থাকত না। সারাদিন কাজ করা স্যার আবেদকে কোনোদিন কর্মক্লান্ত দেখতে পাইনি। মনে হতো, কেবলই দিনের কাজ শুরু করেছেন। নিজের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন দেখেছি। যে বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ করার জন্য গিয়েছি, তা নিয়ে কথা বলার পর, বহু বিকালে, তার সঙ্গে খোলামেলাভাবে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছি। সঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগের কথা জেনেছি। সাহিত্য বিষয়ে তার পড়াশোনা, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে তার জ্ঞানের মাত্রা আমাকে বিস্মিত করেছে। একদিনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। আমি বোধকরি ক্লান্ত ছিলাম অথবা হয়তো আমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তখন কী কী কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তা জানতে চেয়েছিলেন। এরপর একটু থেমে আমাকে বললেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রামের জন্য কিছু সময় বের করে নিতে হবে এবং মাঝেমধ্যে কাজে বিরতি দিতে হবে; মাঝেমধ্যে চুপচাপ বসে চিন্তার জন্য সময় বের করতে হবে। বোধকরি ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে স্যার আবেদের ভাবনার সূত্রপাত হয়তো এরকম সময়েই হয়েছে। (স্যার ফজলে হাসান আবেদের ৮০তম জন্মদিনের সংবর্ধনা গ্রন্থে প্রকাশিত)

আইনুন নিশাত : পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম