Logo
Logo
×

বাতায়ন

অশান্ত পাহাড় : এখন যা করা দরকার

Icon

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অশান্ত পাহাড় : এখন যা করা দরকার

বান্দরবানের থানচি ও রুমায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাম্প্রতিক হামলার জেরে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বলা হচ্ছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের একজন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ‘অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক’, নাম চেওসিম বম। মিডিয়ায় আটক ব্যক্তিদের দেখানোও হচ্ছে। এ ধরনের প্রচার কিন্তু আমাদের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, আটক হওয়া ব্যক্তিদের বমসহ নৃ-জাতিগোষ্ঠীতে জনপ্রিয়তাও থাকতে পারে। ফলে মিডিয়ায় তাদের হাতকড়া পরা দৃশ্য উলটো পার্বত্য এলাকায় নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি প্রায় তিন বছর ধরে বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় আছে। সম্প্রতি এ গোষ্ঠীটি অল্প সময়ের মধ্যে থানচি, রুমা ও আলীকদমে হামলা চালিয়ে আলোচনায় এসেছে। সেখানকার বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি-এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে সংগঠনটি গঠিত হয়েছে। জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। প্রথমদিকে তাদের বক্তব্য ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান জাতিগোষ্ঠী চাকমা ও মারমাদের দ্বারা তারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এ কারণে এ দুই জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটটা মূলত তৈরি হয়েছে ১৯৯৮ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর। পার্বত্য চুক্তির ফলে যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশির ভাগই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক এবং সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগ ছিল চাকমা, এরপর মারমা। এখানে যে বঞ্চনা বা বৈষম্য তৈরি হয়েছে, কুকি-চিনদের ভাষ্য হলো, সে কারণে তারা অস্ত্র ধরেছে। কেএনএফকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাথান বম, তিনি কিন্তু বান্দারবানের রুমার ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করলেও এখন সশস্ত্র পথে ঢুকেছেন।

বঞ্চনা বা বৈষম্য থেকে মুক্তির কথা বললেও কেএনএফ কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের চরিত্র বদলেছে, হয়ে উঠেছে আরও দুর্ধর্ষ। দেখা গেল, অর্থের জন্য তারা ইসলামি তথাকথিত জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেয়, হয়তো সেই অর্থ দিয়ে তারা আরও বেশি অস্ত্র কিনেছে। এরপর সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীকে দমনের পর কুকি-চিনের সঙ্গেও শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে তাদের দিক থেকে শান্তি আলোচনার বিষয়টি হচ্ছে পুরোনো খেলা। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম যখন পুরোপুরি সশস্ত্র পরিস্থিতিতে ছিল, তখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এরকম শান্তি আলোচনা বহুবার হয়েছিল। দেখা গেছে, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সশস্ত্রগোষ্ঠী আরও শক্তি সঞ্চয় করে। কাজেই এ ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনার মানে হলো তাদের আপনি স্বীকৃতি দিলেন। তারা তখন আরও লোকবল রিক্রুট করার সুযোগ পায় ও প্রচার চালায়। দেখায় যে, সরকার তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করছে। আরও তরুণ ছেলে তখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। একটি সশস্ত্র সংগঠন যেভাবে বেড়ে ওঠে, কেএনএফও সেভাবেই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে।

পাহাড় ও সাঙ্গু নদ দিয়ে বেষ্টিত রুমা শহর, যেটি মূলত রুমা বাজার নামে পরিচিত, সেটি একটু নিচের দিকে অবস্থিত, অনেকটা উপত্যকার মতো। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে একসময় এলাকাগুলোয় আমি দায়িত্ব পালন করেছি। আমি সেখানে রিজিওনাল এবং ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। আমি দায়িত্বরত অবস্থায় সরাসরি সেখানে যাওয়া যেত না। যেতে হলে একপাশে নদী অতিক্রম করে যেতে হতো। অন্যপাশে পাহাড় থেকে নেমে যেতে হতো, সেখানে ছিল ক্যান্টনমেন্ট। এখন যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, নদের ওপর সেতু হয়েছে। সরাসরি গাড়িতে করে রুমা বাজারে চলে যাওয়া যায়। এখন নিঃসন্দেহে রুমায় জনসংখ্যা বেড়েছে। আর পার্বত্য চুক্তির পর সেনাবাহিনীকে অনেক জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তাদের অবস্থান হয় কয়েকটি নির্ধারিত ক্যান্টনমেন্টে। যেমন রুমা, আলীকদম ও বান্দরবানে রয়েছে।

সেসময় পুরো বান্দরবান ছিল রিজিওনাল কমান্ডারের অধীনে। পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের সবকিছুই সমন্বয় হতো ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে। বান্দরবান এলাকায় একদম গভীর জঙ্গল পর্যন্ত অন্তত ৫০টি অপারেশনাল ক্যাম্প ছিল। প্রতিটি ক্যাম্পের চার কিলোমিটারের আশপাশে তারা নজরদারি ও টহল দিত। এ কারণে আশপাশের পাড়াগুলোর সব খবরই পাওয়া যেত। পার্বত্য চুক্তির ফলে অধিকাংশ ক্যাম্প তুলে ফেলা হলো। এখন একটি ক্যান্টনমেন্টের অধীনে অপারেশনাল এরিয়া হয়ে গেল ৩০-৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। একটি ছোট ক্যান্টনমেন্ট বা ব্যাটালিয়নের পক্ষে পাহাড়ি এলাকায় এ বিশাল এলাকাজুড়ে নজরদারি করা সম্ভব নয়। তাদের ওপর হামলা না হলে তাদেরও তখন কিছু করার থাকে না। এখন সবকিছু দেখে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন। সেনাবাহিনী এখন কিছু চেকপোস্ট পরিচালনা করে মাত্র।

গত কয়েক বছরে সক্রিয় হয়ে ওঠা কেএনএফ যে রুমা, থানচি ও আলীকদমে হামলা চালিয়েছে, ব্যাংকের অর্থ ও অস্ত্র লুট করেছে এবং অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো পুলিশের রাইফেল নিয়ে যাওয়া। যে ১৪টি চায়নিজ রাইফেল ওরা নিয়ে গেছে, এখন তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। তারা দাবি করেছে, ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে অপহৃত ব্যাংক কর্মকর্তাকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। এ টাকা দিয়ে তারা অস্ত্র কিনবে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তাদের অস্ত্রগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে, লুটের টাকা দিয়ে সেগুলো কেনা এখন তাদের জন্য সহজ হবে।

সশস্ত্র অস্থিরতা যেখানে থাকে, সেখানে মাদকও থাকে। এ মাদক ব্যবসাও মূলত অস্ত্র কেনার টাকা সংগ্রহের জন্য। সব মিলে এ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ অঞ্চলে শুধু বাংলাদেশের এসব এলাকাই নয়, সেখানে আছে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশ এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য। এসব এলাকায় কুকি-চিনের বড় প্রভাব আছে। চিন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) লড়াই করছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। সেই গোষ্ঠীর বেশির ভাগ হচ্ছে কুকি-চিন। আবার মিজোরামেও এখান থেকে অনেক কুকি চলে গেছে। সেখানে এ নিয়ে নানা ধরনের অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে।

রুমা, থানচি ও আলীকদম-এ তিন এলাকার দূরত্ব কিন্তু কম নয়। অল্প সময়ের মধ্যে তিন জায়গায় হামলার ঘটনায় এটা প্রতীয়মান হয়, অনেক দলে ভাগ হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়েছে কেএনএফ। তারা যে শক্তি দেখিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, এলাকাটিকে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। এখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি একক নেতৃত্ব থাকতে হবে। সেই নেতৃত্ব যদি সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সব ধরনের পরিস্থিতির দায়দায়িত্বও দিতে হবে। মণিপুরে মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের বড় সংঘাতও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি। ফলে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিনদের নানামুখী আন্দোলন ও তৎপরতার অনুপ্রেরণায় এখানে কেএনএফ গঠিত হয়েছে এবং সক্রিয় হয়েছে। তারা সেসব জায়গা থেকে অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। তারা এখন বান্দরবানের বিশাল এলাকা নিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। যদিও সেটির সঙ্গে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর কথা এখন পর্যন্ত তারা বলছে না।

এমন পরিস্থিতিতে সেখানে র‌্যাব নিজেদের মতো যাবে, পুলিশও প্রতিহত করতে যাবে, এভাবে সমন্বয় হবে না। এটি অনেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। পুলিশ তো এমন পরিস্থিতির জন্য প্রশিক্ষিত বাহিনী নয়। বিজিবি কিছু করতে পারলেও এখানে তাদের জোরালো ভূমিকা দেখছি না আমরা। বান্দরবানসহ ওই এলাকা যে কতটা দুর্গম এবং স্থানীয় না হলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা কতটা দুরূহ কাজ, তা যারা সেখানে আছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। বান্দরবান ও রুমার যে পরিস্থিতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান, সেখানে পুলিশ কিংবা র‌্যাব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কাজেই যৌথ বাহিনী গঠন করে অভিযান চালিয়ে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। এখন সরকারকে চিন্তা করতে হবে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় যদি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়, তাহলে কমান্ড দিতে হবে একটি জায়গা থেকে এবং পুরো দায়দায়িত্বও তাকে নিতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে। বলে রাখা ভালো, কেএনএফকে ছোট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ভাবলে ভুল করা হবে। এদের প্রথম ট্রেনিং হয়েছিল কাচিং ইনডিপেনডেন্ট আর্মির হাতে। প্রথম যে ৪২ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে দুজন মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে মারা গেছে। বলতেই হচ্ছে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে।

এখন সেনাবাহিনীকে এদের প্রতিহত করার দায়িত্ব দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও সামরিকায়নের জন্য সমালোচনা উঠতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন পদক্ষেপ তো নিতেই হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে সেনাবাহিনী আবারও ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম