Logo
Logo
×

বাতায়ন

আন্দোলন শেষ, নাকি নতুন মাত্রা পেয়েছে?

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আন্দোলন শেষ, নাকি নতুন মাত্রা পেয়েছে?

গত ৭ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পর দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সময়টা খুব বড় নয়; অন্তত একটা জাতির ইতিহাসে। কিন্তু আমাদের জন্য এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ একটা ধাক্কা খেয়েছে। গত প্রায় দেড় বছর ধরে লাগাতার যে ক্যাম্পেইনটা চলছিল গণতন্ত্রের পক্ষে, যে বিশাল বিশাল সমাবেশ ছিল এক একটা গণঅভ্যুত্থানের মতো এবং সে সমাবেশগুলোয় নেতাকর্মীদের যে দৃঢ়তা, উদ্দীপনা লক্ষ করা গিয়েছিল, নেতাদের যে সাহসী, বলিষ্ঠ এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ উচ্চারণ ছিল; তাতে মানুষ আশান্বিত হয়েছিল। এর সঙ্গে আগুনে ঘি দেওয়ার মতো, ভালো করে বাংলায় বললে, ঘৃতাহুতির মতো যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মনে করেছিলেন ওরা যদি চায় তাহলে আমরা তো ক্ষমতায় থাকতে পারব না। দেশের মানুষও তেমনটাই ভেবেছিল, এবার ওদের যেতে হবে।

আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিরোধী দলের নেতারা বলেছেন, সূর্য উঠেছে সূর্য ডুবেছে; সেভাবে ৭ জানুয়ারি পার হয়ে গেছে, একটি ছলনার ভোটের পর নিজেদের জয়ী ঘোষণা করেছে শাসক দল। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে জিতেছি আমরা। কারণ দেশের মানুষ আমাদের কথা শুনে ভোট বর্জন করেছে। এটি একটি ইতিহাস।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটি কথা সত্য, সরকার বদলায়নি। এরাই আছে এবং এতে মানুষের মধ্যে একটা বঞ্চনা এবং হাহাকার তৈরি হয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এরাই কি থাকবে আরও পাঁচ বছর? কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন কি ঝিমিয়ে গেল?

মানতে হবে ৭ জানুয়ারির পর থেকে অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে গণতন্ত্র মঞ্চ নামক জোটের দৈনন্দিন মিছিল করা ছাড়া বিরোধী দলের এমন কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল না। কেন? এ প্রশ্ন উঠেছে, ২৮ তারিখে সরকার কী করতে পারে, সে কথা কি অন্তত বিএনপি আগে থেকে বুঝতে পারেনি? তাদের এরকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনে হলো কেন? কেন তারা এ আন্দোলনকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারল না কেন তারা প্রায় তৈরি হওয়া একটা অভ্যুত্থানকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারল না? বর্তমান সরকারকে হটিয়ে দিতে পারল না?

আমি এর আগে আমার দুই-একটি লেখায় বলেছি, বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো নিজেরাই এক একটা গণঅভ্যুত্থানের মতো ছিল। কিন্তু সব বিভাগের কেন্দ্র রাজধানী ঢাকা মহানগরে সেই গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়নি। প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমরা কি গণঅভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে জনগণকে সেভাবে আহ্বান জানিয়েছিলাম? সত্যি কথা হলো, আমরা সেটা নিজেরা বুঝতে পারিনি বা নেতাকর্মীসহ জনগণকে জানাতে পারিনি। তাহলে আজ যখন আন্দোলনের মূল্যায়ন করার প্রশ্ন আসবে, তখন আমরা যে বলতাম গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাব, তার কর্মপরিকল্পনা কী ছিল?

গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। পাঠকরাও হয়তো ১৯১৭ সালে রুশ অক্টোবর বিপ্লবের কথা অবগত আছেন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। রুশ সেনাবাহিনী, যারা সীমান্তে যুদ্ধ করছিল তাদের জার সরকার খাবার দিতে পারছিল না। তারা বিদ্রোহ করে সীমান্ত থেকে শহরের দিকে চলে আসছিল। তখনকার মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে তারা জড়ো হচ্ছিল। যুদ্ধের অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত শ্রমিকরাও তখন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বেড়াচ্ছে। সীমান্ত ফেরত সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সেই মিছিলে যোগ দিচ্ছিল। লেনিন বলেছিলেন, এটাই একটা বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিন্তু তিনি সতর্ক করেছিলেন, অভ্যুত্থান নিয়ে ছেলেখেলা করা যাবে না। নারী যেমন তার সূচিকর্ম করে, মালি যেমন বাগানকে সাজায়, তেমনি আমাদেরও অভ্যুত্থান সাজাতে হবে। এটা শুধু সংগঠনের ইচ্ছা নয়। জনগণেরও ইচ্ছা থাকতে হবে। তাদেরও পরিবর্তন চাইতে হবে। একবার শুরু করলে থামা যাবে না। উপর্যুপরি আঘাত করে পতন ঘটাতে হবে। বিষয়গত ও বস্তুগত অবস্থা বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে সেটা পক্ষে থাকে। পরিকল্পনা হতে হবে নিখুঁত। জানতে হবে কখন কোথায় আঘাত করতে হবে।

লেখাটা একটু কঠিন হয়ে গেল কিনা জানি না; কিন্তু লেনিন বলেছিলেন অভ্যুত্থান নিয়ে ছেলেখেলা করা যাবে না। এটা নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকা চলবে না। আমি মনে করি এ আলোকেই আমাদের সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা দরকার। মনে রাখতে হবে আমরা এমন একটা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি যারা যে কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়।

আমরা কি এ সবকিছুই বিবেচনায় রেখেছিলাম সে আলোচনায় আমি এখানে যাচ্ছি না। ওটা আরও লম্বা আলোচনা। তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা চলে, আমরা কোনো সময়েই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো চ্যালেঞ্জ প্রদান করিনি। এমনকি ২৮ অক্টোবর এবং পরবর্তী সময়ে যখন রাষ্ট্রশক্তি সর্বশক্তি নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখনো আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, এ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মূল দল বিএনপি কি সে রকম একটি দল, যারা এরকম পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে? অনেকেই এরকম করে বলেন, বিএনপি তো আসলে একটা নির্বাচনমুখী দল। তাদের দিয়ে কি একটি গণঅভ্যুত্থান তৈরি করা সম্ভব? আমাকে যদি স্বীকার করতে হয় বিএনপি সেরকম দল নয়, তাহলে এটাও মানতে হবে যত দিন পর্যন্ত সেরকম দল তৈরি না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এ শাসনই টিকে থাকবে। ইতিহাস নিশ্চয়ই এই কথা সত্যায়িত করবে না। জনগণ সব সময়ই তার পক্ষে পরিস্থিতি নির্মাণের সংগ্রাম করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।

তর্কের খাতিরে ধরে নিই বিএনপি একটি বিপ্লবী বা অভ্যুত্থানের দল নয়; পালটা প্রশ্ন করা যেতে পারে আওয়ামী লীগও কি সে রকম দল? আমি যতখানি দেখেছি উভয় দলের চরিত্র কাঠামো প্রায় একই। বিএনপির মধ্যেও প্রচুর শ্রমিক, তরুণ আছেন যারা সাহসী এবং লড়াই করার ইচ্ছা রাখেন। নেতৃত্বের কাজ হচ্ছে তাদের সংঘবদ্ধ করে, উদ্বুদ্ধ করে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে নামানো। মনে রাখা দরকার, শতকরা ৯৫ জন মানুষ আন্দোলনকারীদের আহ্বানে নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থেকেছে। ক্ষমতাসীনরা এটাকে জনগণের অংশগ্রহণ বলে মানতে রাজি হবে না। সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের বুঝতে হবে রাতারাতি সমর্থকরা কর্মী বা লড়াকু সৈনিকে পরিণত হয় না। আন্দোলনে যখন রাস্তায় নামে মানুষ তখন এমন অসাধ্য সাধন করে, যা আমরা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কল্পনাও করতে পারি না।

এতে কোনো সন্দেহ নেই সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ একটি পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। বস্তুগত বা বিরাজিত পরিস্থিতি যদি ইতিবাচক হয় অর্থাৎ ব্যাপক জনগোষ্ঠী যদি সত্যি সত্যি পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়, তখন সংগঠনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠন গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করে, পরিচালিত করে এবং তাকে তার যৌক্তিক অভিধায় নিয়ে যায়। খুবই সাম্প্রতিককালে শ্রীলংকায় একটি বিশাল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যা আমাদের সবার জানা। কিন্তু তা তার যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। আমি যেনতেন প্রকারের একটি সংগঠন থাকার কথা বলছি না। সেই সংগঠনের কথা বলছি, যা এবং যার নেতৃত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রকে বদলে দেওয়ার যোগ্যতা রাখে, গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থানের পর্যায়গুলো অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। যার বোঝার ক্ষমতা আছে আমরা কতদূর যেতে পারি, কোথায় আমাদের থামতে হবে, কোথায় কখন কতখানি শক্তিতে আঘাত করতে হবে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য।

৭ জানুয়ারি পরিস্থিতিকে মৌলিকভাবে একটুও পালটে দেয়নি। বস্তুগতভাবে আগের মতোই আছে অথবা তার চেয়ে পরিপক্ব হয়েছে। বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য এ কারণেও যে, আন্দোলনকারী দল ও শক্তিগুলো এটা মনে করছে যে, তারা হারেননি এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভবিষ্যৎ আন্দোলনের প্রশ্নে কর্মসূচি দিতে শুরু করেছে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির পর বিরোধী দল কোনো প্রতিরোধ কর্মসূচি দেওয়া তো দূরের কথা, শক্ত প্রতিবাদও করতে পারেনি। কিন্তু ৭ জানুয়ারি থেকেই তারা রাস্তায় নামছেন, তাদের মধ্যে ঐক্য অটুট আছে এবং শতসহস্র অত্যাচার নির্যাতনের পরও সরকারবিরোধী দল এবং জোটের মধ্যে কোনো ফাটল তৈরি হয়নি।

কী হবে তা দেখার জন্য হয়তো আমাদের আরও খানিকটা অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা বলা যায়, আন্দোলন শেষ হয়নি। বরং নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।

মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম