Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী ও পরামর্শক নিয়োগ জরুরি

Icon

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী ও পরামর্শক নিয়োগ জরুরি

প্রতিদিন খবরের কাগজ দেখলে চোখে পড়ে যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের খবর, যা খুবই দুঃখজনক। সম্প্রতি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা, যার জন্য তার এক সহপাঠী ও শিক্ষক দায়ী। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক ও সহপাঠীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যৌন হয়রানিসহ নানা অপকর্মে দৃশ্যমান ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর অভিযোগে কিছুটা বোঝা যায়। এ ছাড়া এসব অপরাধের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও অপরাধীদের প্রশ্রয়ের কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো ক্ষেত্রে যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে আমার কর্মস্থান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত এই অপরাধের বিচার হয়েছে সম্প্রতি, যা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য এবং প্রশাসন প্রশংসার দাবিদার। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তির বিচার নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে থিসিসকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করে আসছেন। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন অভিযোগ কমিটিও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এ কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা পায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা সামাজিক অবক্ষয় এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ মারাত্মক ব্যাধি থেকে রক্ষায় আমাদের সবাইকে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, স্ত্রীকে আরও সচেতন করতে হবে। এসব অপরাধ রোধে পরিবারেরও দায়িত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে, এসব বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। অন্যথায় এদের সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এসব অপরাধে নারী প্রগতি থমকে যাবে; রাষ্ট্র ও সমাজ কারও জন্যই তা ভালো কিছু নয়।

দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের পেছনের কারণগুলো হচ্ছে-যৌন ইচ্ছা, যৌন হতাশা, পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাসনা, নারীকে দুর্বল মনে করা, শক্তির প্রকাশ, ক্ষমতার রাজনৈতিক দাপট, প্রতিশোধপরায়ণতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক রীতিনীতি, বন্ধন, মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। এ ছাড়া ধর্ষণের পেছনে আরও কারণ রয়েছে। যেমন-ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না করা, যৌন শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের অভাব। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাড়াও এ জাতীয় অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। কারণ সমাজের কোনো অংশই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলে মনে করি। এ ছাড়া দরকার সুশাসন। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে জনসমক্ষে এসব পুরুষের বিচার করতে হবে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার ঘটনায় দুই শিক্ষককে বহিষ্কার করার রেশ কাটতে না কাটতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন বা কুপ্রস্তাব দেওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভুক্তভোগী উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ওই শিক্ষার্থী বিচার পাচ্ছেন না। এমনকি ওই শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে ফেল করছে শুধু অভিযোগ দেওয়ার কারণে, যা তার কথায় প্রকাশ পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহনন করেছেন ২৪.৭৫ শতাংশ এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ। একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা একটি পরিবারের স্বপ্ন হত্যা। আমাদের অবহেলা বা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আমরা আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের অকালে হারাচ্ছি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে যৌন নিপীড়ন ও মানসিক রোগ। অনেক শিক্ষার্থীকে তার শারীরিক গঠন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি বা অন্য অনেক কারণে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এমনকি তার পোশাক নিয়ে ঠাট্টা করতে দেখা যায়, যা একসময় ওই শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। আমরা অন্য রোগ প্রতিরোধে যেভাবে কাজ করছি, আত্মহত্যা প্রতিরোধে গবেষণা করা হয় না বা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তাই আত্মহত্যার প্রতিরোধে ব্যাপক গবেষণা হওয়া জরুরি এবং সে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

ক্যাম্পাসে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেজন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলকে কার্যকর করতে হবে। অতীতের সব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সেলকে কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন বা হয়রানি নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়। কারণ অনেকেই জানি না যে কোন কাজ বা আচরণ যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির আওতাভুক্ত। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংখ্যক শিক্ষক বা শিক্ষার্থী রয়েছে, তাতে প্রতি বিভাগ বা অনুষদে একজন মনোবিজ্ঞানী বা ছাত্র পরামর্শক থাকা একান্ত প্রয়োজন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নেই বললেই চলে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আইন প্রণয়ন করে প্রতি বিভাগে ছাত্র পরামর্শক ও মনোবিজ্ঞানীর পদ সৃষ্টির মাধ্যমে খুব দ্রুত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের মুক্তচিন্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারলে ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, যা কোনোভাবেই জাতির জন্য মঙ্গল নয়।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম