Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাইডেনের নির্বাচন মিশিগানে পথ হারিয়েছে

Icon

মাহমুদ রহমান

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাইডেনের নির্বাচন মিশিগানে পথ হারিয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ চলতি বছর ৫ নভেম্বর হলেও নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মধ্য জানুয়ারি থেকেই। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলই তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য প্রাইমারি নির্বাচন শুরু করেছে। এ বছর মধ্য জানুয়ারিতে আইওয়া স্টেইটের প্রাইমারির মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটি শুরু হয়েছে। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে প্রাইমারি ইলেকশন চলবে মধ্য জুন পর্যন্ত। এরপর দল দুটো তাদের কনভেনশনে ফাইনাল রেইসের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করবে। এ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যখন উভয় দলেই শক্ত অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী থাকেন। প্রাইমারি ইলেকশনের একপর্যায়ে যখন সুপার টুইসডে আসে, তখন মোটামুটি সবাই ধারণা পেয়ে যান কে হবেন কোন দলের পরবর্তী নমিনি। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম।

ঐতিহ্যগতভাবে রানিং প্রেসিডেন্ট পরবর্তী নির্বাচন করতে চাইলে দলের অন্য কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করেন না। এ হিসাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। যদিও কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে মনে করছেন, নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আসতেও পারে ডেমোক্র্যাট শিবিরে।

অন্যদিকে রিপাবলিকানদের পক্ষে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রার্থিতার বিপরীতে প্রথমে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসেন্টিস এবং নিকি হ্যালি প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও প্রাইমারি ইলেকশন শুরু হতেই ডিসেন্টিস ছিটকে পড়েন। এরপর রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান নিকি হ্যালিও। তাই রিপাবলিকান দলের চূড়ান্ত প্রার্থী যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ব্যাপারে এখন কারও কোনো সন্দেহ নেই। তবুও কেউ কেউ এখনো আশা করছেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলমান মামলায় হয়তো যে কোনো সময় তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন।

ফেব্রুয়ারির শেষ মঙ্গলবার ছিল মিশিগান অঙ্গরাজ্যে প্রাইমারি ইলেকশন। প্রাইমারি শেষ হওয়ার আগেই নভেম্বরের চূড়ান্ত লড়াই হবে বাইডেন বনাম ট্রাম্পের মধ্যে এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। তবুও মিশিগানের প্রাইমারি ইলেকশনের দিকে সবার চোখ ছিল দুটো কারণে। প্রথমত, আমেরিকার মিশিগান অঙ্গরাজ্যে সবচেয়ে বড় আরব আমেরিকান ও এশিয়ান মুসলিম কমিউনিটির বসবাস। দ্বিতীয়ত, মিশিগান অঙ্গরাজ্যে ওপেন প্রাইমারি ইলেকশন হয়। ওপেন ইলেকশনের কারণে নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলের কিছুটা আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

মিশিগানে যারা ডেমোক্র্যাটিক লাইনে ভোট দিয়েছেন তাদের প্রায় ১৩ শতাংশ ভোটার ‘আনকমিটেড’ বেছে নিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ভোটের হিসাবে এক লাখের ওপর ডেমোক্র্যাট ভোটার বাইডেনকে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেননি। বিগত তিনটি নির্বাচনে এ ‘আনকমিটেড’ ভোটারের সংখ্যা ছিল বিশ হাজারের কাছাকাছি। হঠাৎ এবার এত বেশি সংখ্যায় ভোটাররা বাইডেনকে ‘না’ বলার কারণ হচ্ছে ইসরাইলের গাজায় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। মুসলিম এবং সচেতন আমেরিকানদের অভিযোগ, বাইডেন প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইলকে বাধ্য করার জন্য যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ভোটারদের ক্ষোভের এ বিষয়টি অবগত। তাই তিনি সত্যিকারের কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার আগেই ঘোষণা দিয়েছেন আগামী সপ্তাহে ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধ বিরতিতে যাচ্ছে। যদিও উভয়পক্ষ এরকম সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে। বাইডেনের এ ঘোষণা মিশিগানের আরব ও এশিয়ান মুসলিমদের মন গলাতে পারেনি। মিশিগানের ডিয়ারবন এবং হ্যামট্রামিক দুটো সিটির মেয়র আরব মুসলিম। ডিয়ারবন সিটিতে বাইডেনকে ‘না’ (আনকমিটেড) ভোট দিয়েছেন প্রায় ৫৬ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার। হ্যামট্রামিক সিটিতে এ হার ৬১ শতাংশ। হ্যামট্রামিক সিটিতে আরব মুসলমানদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি মুসলমানদেরও বসবাস রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান এলাকায় প্রায় ১৯ শতাংশ তরুণ ভোটার বাইডেনের বিরুদ্ধে ‘আনকমিটেড’ বেছে নিয়েছেন। মিশিগানের মতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই যে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে হয়ে থাকে এবং বলা হয়, এসব সুইং স্টেইট-ই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারক। ২০২০-এর নির্বাচনে মিশিগানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রায় দেড় লাখ ভোট বেশি পেয়ে জিতেছিলেন। পরাজিত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ২০১৬ সালেও প্রায় ১১ হাজার ভোট বেশি পেয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এবার এ গুরুত্বপূর্ণ মিশিগান অঙ্গরাজ্যের মুসলিম এবং তরুণ ভোটারদের বিক্ষুব্ধ মনোভাব ডেমোক্র্যাট শিবিরে বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।

এছাড়া মিশিগানে ওপেন প্রাইমারি হওয়ার কারণে যে কোনো ভোটার যে কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে নিয়ম হচ্ছে প্রাইমারিতে শুধু ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান রেজিস্টার্ড ভোটাররা যার যার ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। মিশিগান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে যে কোনো ভোটার প্রাইমারিতে যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। এখন ক্ষুব্ধ ডেমোক্র্যাট ভোটারও ডেমোক্র্যাট ব্যালটে বাইডেনের বিরুদ্ধে ‘আনকমিটেড’ দেওয়ার পরিবর্তে প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। মিশিগানে কতসংখ্যক ডেমোক্র্যাট বাইডেনের পরিবর্তে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন এ হিসাব পাওয়া কঠিন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এরকমও অনেক ভোটার রয়েছেন। ডেমোক্র্যাটরা আপাতত বিপদে আছেন এ পক্ষ ত্যাগকারী ভোটারদের নিয়ে। এদের কীভাবে ফিরিয়ে আনবেন তার উপায় তাদের খুঁজতে হবে। অন্যদিকে যারা ‘আনকমিটেড’ ভোট দিয়েছেন, তাদের ক্ষোভ কীভাবে প্রশমন করবেন তা-ও এক জটিল প্রশ্ন। এরা ক্ষুব্ধ থাকলে নভেম্বরে এদের অনেকেই রিপাবলিকান শিবিরে ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।

ডেমোক্র্যাট নীতিনির্ধারকরা এখনই মুসলিম ভোটারদের ক্ষোভ প্রশমনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে নভেম্বরে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে বলে-মিশিগানের ডিয়ারবন সিটি মেয়র আবদুল্লাহ হামমুদ জানিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসকে। আরব আমেরিকান এবং মুসলিম ভোটাররা ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে থাকে। অভিবাসীরাও ডেমোক্র্যাটদের উদার নীতির কারণে তাদের পছন্দ করে থাকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন এবং মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদী মন্তব্য এবং কর্মকাণ্ড যে কোনো বিচারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। তাই প্রাইমারি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিবর্তে ‘আনকমিটেড’ বেছে নেওয়া সচেতন সমর্থকরা আসলে বাইডেন প্রশাসনকে তাদের নীতি পরিবর্তনে ভোটারদের পক্ষ থেকে বার্তা দিতে চাচ্ছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই জো বাইডেনের বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী করা নয়; কিন্তু রাজনীতির বল অনেক সময় কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ভোটারদের এ বার্তা ও আবেগকে যথাযথভাবে হ্যান্ডল করতে ব্যর্থ হলে ক্ষোভ বিদ্রোহে রূপ নেবে। ভয় এখানেই। এখন দেখার পালা ডেমোক্র্যাট শিবির মিশিগানে সুনির্দিষ্ট বার্তা পাওয়ার পর কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।

ব্যাপকভাবে মনে করা হয়, গাজায় যুদ্ধের শুরুতে বাইডেন প্রশাসনের অবাধ সমর্থন পেয়ে ইসরাইল হামাস নির্মূলের নামে জাতিগত আরব ফিলিস্তিনিদের নির্মূলের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন পর্যন্ত প্রায় ২৯ হাজার গাজাবাসীকে হত্যার দায় ইসরাইলের পাশাপাশি বিশ্বমোড়ল হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রও এড়াতে পারে না। গাজায় মানবিক বিপর্যয়ে শুধু মুসলমানরা নয়, বিবেকবান আমেরিকানরাও বিক্ষুব্ধ। এরকম ক্ষুব্ধ একজন আমেরিকান মিলিটারি সদস্য অ্যারন বুশনেলের আত্মহত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। ওয়াশিংটনে ইসরাইলের দূতাবাসের সামনে ফিলিস্তিনের সমর্থনে এবং গণহত্যার প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার আগে অ্যারন মুখে বলছিলেন, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’।

মিশিগানের মুসলিম কমিউনিটিসহ পুরো আমেরিকার মানবতাবাদী মানুষের সামনে এ নির্বাচন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাট পলিসি মেকাররাও মহাবিপদে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য ডেমোক্র্যাটদের খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। অর্থনীতি ভালো করলেও সাধারণ মানুষকে দ্রব্যমূল্যের কারণে তা বোঝানো কঠিন। অন্যদিকে মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমনও জরুরি। সব মিলিয়ে জো বাইডেনের ভাগ্য অনিশ্চিত পথেই এগোচ্ছে বলে মিশিগান প্রাইমারি জানিয়ে দিল।

এর চেয়েও বড় বিপদে মুসলমান ও অভিবাসীরা। বাইডেনকে বার্তা দিতে গিয়ে যদি বল মাঠের বাইরে চলে যায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট হয়ে আসবেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; যিনি শুধু মুসলমান এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন-তা নয়। তিনি ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের খল নায়ক। রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সেদিন ঐতিহাসিক ভূমিকা না রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এতদিনে ট্রাম্পের হাতের পুতুলে পরিণত হতো। তাই বলা যায়, সত্যি সত্যি ভোটারদের সামনে কোনো ভালো বিকল্প নেই। এখন দেখার বিষয় মিশিগানের বার্তা কোনো কাজে লাগে কিনা। নাকি মিশিগানের দেখানো পথেই নভেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউজে ফিরে আসেন।

মাহমুদ রহমান : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র

mahmudpukra@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম